ইন্টারপোলের হুলিয়া হয় আসামি ফেরানো যায় না

Slider বাংলার মুখোমুখি


ইন্টারপোলের রেড নোটিশ তথা হুলিয়া মাথায় নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পালিয়ে বেড়াচ্ছে ৬৩ বাংলাদেশি অপরাধী। তাদের ফিরিয়ে আনতে বিভিন্ন সময় নানা ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও আইনি, কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক জটিলতার কারণে দেশে আনা যাচ্ছে না। ফলে বিচারের মুখোমুখি করা যাচ্ছে না; বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন বিচারপ্রার্থীরা।

ইন্টারপুলের রেড নোটিশভুক্ত বাংলাদেশি অপরাধীদের মধ্যে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে পলাতকের সংখ্যা সর্বাধিক। এ ছাড়া যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, সুইডেন, দক্ষিণ আফ্রিকা, পাকিস্তানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এসব অপরাধী গা-ঢাকা দিয়ে আছে। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা, ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালান মামলা, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা, একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধ, আলোচিত হত্যাকা-সহ অনেক মামলার আসামি বছরের পর বছর ধরে বিদেশে পলাতক।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, বঙ্গবন্ধুকে যারা খুন করেছিলেন, তাদেরও আমরা বিচারের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করেছি। কয়েকজন এখনও পালিয়ে বেড়াচ্ছে। তাদের দেশে ফিরিয়ে আনতে আমরা বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। আমরা চেষ্টা করছি অচিরেই তাদের ফিরিয়ে এনে ফাঁসির রায় কার্যকরের।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের দুই কর্মকর্তা খুনের আসামি তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান আহমেদকে ২০১৯ সালে আটক করেছিল সংযুক্ত আরব আমিরাতের পুলিশ। ইন্টারপোলের রেড নোটিশের তালিকায় থাকা জিসানকে দুবাইয়ে আটকের পর বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। কিন্তু বিভিন্ন উপায় অবলম্বনের পরও শেষ পর্যন্ত তাকে ফেরত দেয়নি দুবাই। সর্বশেষ, পুলিশ কর্মকর্তা মামুন হত্যামামলার আসামি রবিউল ইসলাম ওরফে আরাভ খানের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করেছে ইন্টারপোল। তাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে ঢাকার পক্ষ থেকে চেষ্টা করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, আরাভকে ফেরানো সহজ হবে না।

২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারতে গ্রেপ্তার হয় ইন্টারপোলের রেড নোটিশভুক্ত শীর্ষসন্ত্রাসী মোল্লা মাসুদ। সে সময় বাংলাদেশ পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, তাকে দেশে ফেরত এনে বিচারের মুখোমুখি করতে সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে। কিছুদিন পর পুলিশের সেই চেষ্টা থেমে যায়। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামি এমএ জাহিদ ওরফে খোকন ওরফে খোকন মাতুব্বর সুইডেনে পলাতক। তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার কথা কয়েক বছর ধরেই সরকারের পক্ষ থেকে বলা হলেও এ পর্যন্ত তা সম্ভব হয়নি। একই অপরাধের দায়ে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আরেক আসামি জামায়াতে ইসলামীর রুকন আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধেও ইন্টারপোলের রেড নোটিশ রয়েছে। ফাঁসির রায় হওয়ার আগেই ২০১২ সালে সবার চোখ এড়িয়ে দেশ ছাড়েন এই যুদ্ধাপরাধী। সে সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ভারত হয়ে পাকিস্তানে পালিয়ে গেছেন বাচ্চু রাজাকার। এখনো পাকিস্তানেই তিনি গা ঢাকা দিয়ে আছেন বলে জানা গেছে। মডেল তিন্নি হত্যামামলার প্রধান আসামি গোলাম ফারুক অভি। ৮০ দশকের তুখোড় এই ছাত্রনেতার মাথার ওপর ঝুলছে ইন্টারপোলের রেড নোটিশ। গোলাম ফারুক অভি বর্তমানে কানাডায় অবস্থান করছেন জানা গেছে। তাকেও দেশে ফেরানো যায়নি।

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের নেতা মাওলানা তাজউদ্দিন আহমেদকে ধরতে ২০০৭ সালে ইন্টারপোল রেড নোটিশ জারি করেছিল। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর তাকে দেশে ফেরত আনার তোড়জোড় শুরু হয়। যদিও শেষ পর্যন্ত তা সম্ভব হয়নি। জঙ্গি এই নেতা পাকিস্তান হয়ে বর্তমানে দক্ষিণ আফ্রিকায় অবস্থান করছেন বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সূত্রের খবর। তাকে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিরিয়ে আনতে ঢাকার পক্ষ থেকে দেশটির সঙ্গে দফায় দফায় যোগাযোগ করা হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে তার শারীরিক বর্ণনাও পাঠানো হয় দক্ষিণ আফ্রিকার সংশ্লিষ্ট দপ্তরে। এমনকি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে তাকে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে চুক্তির প্রস্তাবও দেওয়া হয়। সেই চুক্তি এখনো খসড়া পর্যায়েই রয়ে গেছে।

ইন্টারপোলের রেড নোটিশভুক্ত আরেক আসামি বিএনপিদলীয় সাবেক এমপি মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ। তিনি কখনো থাইল্যান্ড, কখনোবা সৌদি আরব কিংবা দুবাইয়ে অবস্থান করেন বলে গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে।

ইন্টারপোলের রেড নোটিশভুক্ত বাংলাদেশের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের বেশিরভাগই ভারতে বসবাস করছে। তাদের মধ্যে চট্টগ্রামের শিবির ক্যাডার শীর্ষসন্ত্রাসী সাজ্জাদ হোসেন ওরফে ক্যাডার সাজ্জাদ, সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদকে দেশে ফেরাতে কয়েক বছর আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নানা ধরনের চেষ্টা চালানো হয়। বর্তমানে সেই চেষ্টা থেমে গেছে। তাদের বাইরে ইন্টারপোলের হুলিয়া মাথায় নিয়ে ভারতে পলাতক জীবনযাপন করছে আব্দুল জব্বার ওরফে মুন্না, নবীন হোসেন ওরফে নবী, প্রকাশ কুমার বিশ^াস, খোরশেদ আলম, শাহাদাৎ হোসেন ওরফে শাহাদাত, দীপু ওরফে নুরুল, রফিকুল ইসলাম ওরফে কাজল, নাসিরউদ্দিন রতন, হারুন শেখ, শৈলেন্দ্রনাথ বিশ্বাস, মকবুল হোসেনসহ আরও বেশকিছু শীর্ষসন্ত্রাসী। তারা সেখান থেকেই বাংলাদেশে চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধী কর্মকাণ্ডে কলকাঠি নাড়ছে।

ইন্টারপোলের হুলিয়া মাথায় নিয়ে বুদ্ধিজীবী হত্যাকা-ের দায়ে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত দুই আসামি আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মঈনউদ্দিন বিদেশে পলাতক। এর মধ্যে চৌধুরী মঈনউদ্দিন যুক্তরাজ্যে ও আশরাফুজ্জামান খান যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন।

ইন্টারপোলের রেড নোটিশে থাকা বঙ্গবন্ধু হত্যামামলায় মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামিদের দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়ায় কোনো অগ্রগতি নেই। পলাতকরা হলেন- আব্দুর রশীদ, শরীফুল হক ডালিম, রাশেদ চৌধুরী ও এবিএমএইচ নূর চৌধুরী। তাদের মধ্যে রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে, নুর চৌধুরী কানাডায় অবস্থান করছেন। বাংলাদেশ তাদের ফেরত পাঠাতে বিভিন্ন সময়ে আবেদন জানালেও দেশ দুটির সরকারের সাড়া মেলেনি। এ ছাড়া শরীফুল হক ডালিম এবং খন্দকার আব্দুর রশিদ পাকিস্তানে পলাতক জীবনযাপন করছে বলে জানা গেছে। নানা চেষ্টা করেও সরকার তাদের দেশে ফেরত আনতে পারছে না।

সাবেক স্বরাষ্ট্র সচিব এবং জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, বঙ্গবন্ধুর দুই খুনির অবস্থান চিহ্নিত করা গেছে। অন্যদের অবস্থান নিশ্চিত করা যায়নি। তাদের বিভিন্ন সময়ের ছবি বিদেশে পাঠানো হলেও চিহ্নিত করা যায়নি।

শীর্ষসন্ত্রাসীদের দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে বহিসমর্পণ চুক্তিবিষয়ক এই বিশেষজ্ঞ বলেন, তারা বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছে। তাদের ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে সেই অর্থে জোরালো কাজ হয়নি। তিনি বলেন, রেড নোটিশভুক্ত আসামিরা যে সব দেশে অবস্থান করেন, সে সব দেশ তাদের গ্রেপ্তার না করলে কিংবা ফেরত না দিলে ইন্টারপোলের কিছু করার নেই।

পুলিশ সদর দপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, বিদেশে পলাতক যে কোনো আসামিকে দেশে ফেরত আনতে ইন্টারপোলের সহায়তা নেওয়া হয়। ইন্টারপোল সংশ্লিষ্ট আসামির অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর বাংলাদেশ পুলিশকে জানায়। এরপর সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে আলোচনা করে কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় ফেরত আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়। রেড নোটিশের তালিকায় থাকলেও কাউকে গ্রেপ্তারের ক্ষমতা নেই ইন্টারপোলের। এক্ষেত্রে যে রাষ্ট্রে আসামি পলাতক, সেই রাষ্ট্র এবং যে রাষ্ট্র গ্রহণ করবে সেই রাষ্ট্রের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করে আসামিকে তার দেশে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া।

ইন্টারপোলের হুলিয়া জারি করা ৬৩ বাংলাদেশির মধ্যে কেউ আঞ্চলিক গডফাদার, নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের নেতা, কেউবা মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসির দ-প্রাপ্ত। পলাতক এসব আসামির কেউ কেউ বসবাসরত দেশের নাগরিকত্ব নিয়ে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছে।

জানা গেছে, ইন্টারপোল কারও বিরুদ্ধে একবার রেড নোটিশ জারি করলে সেটি সংস্থাটির সদস্যভুক্ত ১৯৪টি দেশের কাছে সে তথ্য পাঠানো হয়। দুর্নীতি, যুদ্ধাপরাধ, সন্ত্রাসবাদ, মানব-পাচার, অস্ত্র চোরাচালান, মাদক পাচার, সাইবার ক্রাইম, মানি লন্ডারিং, শিশু সহিংসতাসহ ১৭ ক্যাটাগরির অপরাধ তদন্তে ইন্টারপোল তার সদস্য দেশগুলোকে সহায়তা দিয়ে থাকে।

বিচার ও দ-াদেশ কার্যকর করতে বিদেশে পলাতক আসামিদের ফিরিয়ে আনতে ২০১৯ সালের ১৫ অক্টোবর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কয়েকজন খুনিসহ বিভিন্ন মামলার দ-প্রাপ্ত আসামি বিভিন্ন দেশে পালিয়ে আছেন। এছাড়া বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অনেক মামলার আসামি বিদেশে গা-ঢাকা দিয়েছেন তাদের ফিরিয়ে আনতে এই টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। ১১ সদস্যের নতুন টাস্কফোর্সের সভাপতি আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী। টাস্কফোর্স বিদেশে অবস্থানরত আসামিদের (বাংলাদেশের নাগরিক) বিচারার্থে ও দ-দানার্থে বাংলাদেশে আনতে তাদের নামের তালিকা প্রণয়ন করে। যথাযথ সূত্র ব্যবহার করে আসামিদের অবস্থান চিহ্নিতকরণ, দেশে ফিরিয়ে আনার উপায় নির্ধারণ, ফেরত আনার কার্যক্রম তদারকি এবং কোনো আসামি ইতোমধ্যে বিদেশে নাগরিকত্ব গ্রহণ করে থাকলে সেক্ষেত্রে তাকে ফিরিয়ে আনার উপায় নির্ধারণ ও এ সংক্রান্ত কার্যক্রম তদারকি করার ক্ষমতা দেওয়া হয় টাস্কফোর্সকে। তবে টাস্কফোর্স গঠন করার ৫ বছর হয়ে গেলেও এসব আসামিদের ফিরিয়ে আনার বিষয়ে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *