রোজিনার ঘটনা, শপথ, সংবিধান ও আইন ভাঙার খেলা!

Slider সম্পাদকীয়

ঢাকা: প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ নিরাপদ জায়গা সচিবালয়ে একজন নাগরিককে জিম্মি করার পর ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে, স্বাীকারোক্তি আদায়, অসম্মানজনক এমনকি হত্যা চেষ্টা সহ নানা ধরণের ভীতিকর ‍ভিডিও তৈরী এবং সম্মান নষ্ট করতে ও জাতিকে ভয় দেখাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার নিঃসন্দেহে একটি গর্হিত অপরাধ। আর এই অপরাধকে প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়ে এবং জিম্মি দশায় তৈরী স্বাীকারোক্তিমূলক ভিডিও ভিকটিমকে ফাাঁসাতে বাদীপক্ষ আদালতে আলামত হিসেবে জমা দেয়ায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী সহ দায়ী কতিপয় সরকারী কর্মচারী শপথ ভঙ্গ হয়েছে। এই জন্য মন্ত্রীকে তার পদ থেকে ও সরকারী কর্মচারীদের তাদের চাকুরী থেকে অব্যাহতি দিয়ে বিচারের মুখোমুখি করা উচিত।

প্রসঙ্গতঃ সাংবাদিকের পেশাগত কাজে ১৭ মে সচিবালয়ে গেলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী রোজিনাকে জিম্মি করেন। সেখানে শারীরিক-মানসিক অবমাননাকর নিগ্রহের পর তাঁর একটি রাত কাটে শাহবাগ থানায়। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ নথি চুরির অভিযোগে তাঁর নামে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট এবং দণ্ডবিধির ৩৭৯ ও ৪১১ ধারায় মামলা দায়ের হয়। পরদিন তাঁকে আদালতে পাঠানো হয়। এরপর গতকাল পর্যন্ত রোজিনার কেটেছে কাশিমপুর কারাগারে। অসুস্থ হয়ে পড়া রোজিনা এখন হাসপাতালে।
সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম প্রথমত রাষ্ট্রের একজন নাগরিক ও দ্বিতীয়ত তিনি বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদের ক্ষমতা এবং অধিকার কর্মী। সংবিধানের বাক্‌স্বাধীনতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে বাংলাদেশের সংবিধানে মৌলিক অধিকারের অনুচ্ছেদটিতে গণমাধ্যম সম্পর্কে আলাদা একটি চরণ যুক্ত করা হয়েছে। সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদের ২(খ)-তে বলা হয়েছে, ‘সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।’ আমাদের অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন সংবিধান-রচয়িতারা যেন এক সুদূর ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে ‘সংবাদক্ষেত্র’ শব্দটি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। শুধু সংবাদপত্র নয়, যেকোনো ক্ষেত্রেই সংবাদ পরিবেশন করা হোক না কেন, আমাদের সংবিধান তা চর্চা করার অধিকারের নিশ্চয়তা দিয়েছে। আমরা অসম্ভব উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করে আসছি যে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, সাংবাদিকের সুরক্ষা এবং সাংবাদিকতার স্বাধীন চর্চা বিপন্ন করার করার মতো উপনিবেশ আমলের আইনগুলো তো বিলোপ করা হয়ইনি, স্বাধীন দেশে নিবর্তনমূলক নতুন নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে আছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ফৌজদারি কার্যবিধির মানহানিসংক্রান্ত ধারা, শপথ আইন, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইন ইত্যাদি। বিভিন্ন সময়ে সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিবাদ এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট পক্ষের নানা প্রতিশ্রুতির পরও সংবিধানের চেতনাবিরোধী এই আইনগুলো বহাল তবিয়তে থেকে গেছে এবং সংবাদপত্র, গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের ওপর তার অন্যায় প্রয়োগ অব্যাহত রয়েছে।

ড. শাহদীন মালিক, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষক। তিনি বলেছেন, রোজিনা ইসলামকে হয়রানি, হেনস্তা, নির্যাতন ও বানোয়াট মামলার জন্য দায়ী কর্মকর্তাদের বদলি না করে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তদন্ত শুরু করতে হবে। দ্বিতীয়ত, এক বছরের বেশি সময় ধরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে যেসব অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাটের অভিযোগ এসেছে, সেগুলোর তদন্ত করার জন্য দ্য কমিশন অব এনকোয়ারি অ্যাক্ট, ১৯৫৬–এর আওতায় নিরপেক্ষ তদন্ত করে সরকারের জন্য সুচিন্তিত সুপারিশমালা প্রয়োজন। করোনা মহামারিতে ১২ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছে, আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ৮ লাখ। সরকারি এই হিসাবের বাইরেও আরও অনেক ভুক্তভোগী আছে। রোজিনা ইসলামের সাম্প্রতিক অনেক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে যে মোদ্দা কথাটি উঠে এসেছে তা হলো, করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ঘাটতি ও সমন্বয়হীনতার জন্য বহুলাংশে দায়ী স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি ও লুটপাট–বাণিজ্য। এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকার যদি এখনো রোজিনা ইসলামকে আক্রোশের বশবর্তী হয়ে শায়েস্তা করতে চায়, তাহলে শেষ বিচারে মূল্য দিতে হবে সরকারকেই। কারণ, তখন সরকার হয়ে যাবে জনগণের চরম শত্রু।

পর্যালোচনায় জানা যায়, দেশে বহু ক্ষেত্রে দায়িত্ব গ্রহণের ঠিক আগে শপথ নিতে হয়। এটি অনেকের জন্যই একটি সাংবিধানিক দায়িত্ব। আমাদের সংবিধানের ১৪৮(৩) ধারায় বলা আছে, ‘এই সংবিধানের অধীন যে ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তির পক্ষে কার্যভার গ্রহণের পূর্বে শপথগ্রহণ আবশ্যক, সেই ক্ষেত্রে শপথ গ্রহণের অব্যবহিত পর তিনি কার্যভার গ্রহণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে।’ এখন প্রশ্ন হলো, কী বলা হয় সেই শপথে, কী শপথ নিতে হয়? বিভিন্ন শপথে একটু-আধটু পার্থক্য থাকলেও মূল বক্তব্যটি এরকম, ‘আমি ক বা খ…সশ্রদ্ধ চিত্তে শপথ করিতেছি (বা ঘোষণা করিতেছি) যে, আমি যে কর্তব্যভার গ্রহণ করিতে যাইতেছি তাহা যথাযথ আইনানুযায়ী ও বিশ্বস্ততার সহিত পালন করিব। আমি দেশের প্রতি অনুগত থাকিব এবং সকল আইনকানুন মানিয়া চলিব। অনুকম্পা বা ক্ষোভের বশবর্তী হইয়া, অথবা ব্যক্তিগত স্বার্থের দ্বারা আমার কর্তব্য পালনকে প্রভাবিত হইতে দিব না।’ শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা বিশ্বের শপথের ভাষা প্রায় একই রকম।

একজন সাংবিধানিক পদধারীর স্বপঠিত শপথের পরিপন্থী অথবা শপথের সাথে সাংঘর্ষিক যেকোনো কাজ আইনের দৃষ্টিতে অসদাচরণ বা গুরুতর অসদাচরণ। সংবিধান একজন সাংবিধানিক পদধারীর গুরুতর অসদাচরণকে নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধ হিসেবে গণ্য করেছে। এরূপ গুরুতর অসদাচরণ সংবিধান লঙ্ঘনের সমার্থক। একজন সাংবিধানিক পদধারী দেশের যেকোনো সাধারণ নাগরিকের চেয়ে অনেক বেশি দায়িত্বশীল হবেন এটিই জনমানুষের প্রত্যাশা। একজন সাংবিধানিক পদধারী নির্বাচিত বা নিযুক্ত যাই হোন না কেন, তাকে অবশ্যই সংবিধান ও আইনকে সমুন্নত রেখে স্বপঠিত শপথ অনুযায়ী স্বীয় কার্য সমাধা করতে হয়। এর যেকোনো ধরনের ব্যত্যয় একজন সাংবিধানিক পদধারীর জন্য কঠিন পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটালেও ক’জন সাংবিধানিক পদধারী এরূপ ব্যত্যয়ের সাথে সম্পৃক্ত নন এবং ক’জন ব্যত্যয় পরবর্তী অভিযুক্ত হয়ে পদ হারিয়েছেন এ হিসাবটি সঠিকভাবে করতে পারলে ভবিষ্যতে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব খুব কমই ঘটবে।

সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ১৯৮৫-তে অসদাচরণ বলতে- অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি এমন আচরণকে বোঝানো হয়েছে যা একজন কর্মকর্তা অথবা ভদ্রলোকের পক্ষে অনুচিত। দুর্নীতি অসদাচরণ বা গুরুতর অসদাচরণ হিসেবে পরিগণিত। অসদাচরণ বা গুরুতর অসদাচরণকে দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭ এ ঘুষের সমার্থক হিসেবে অপরাধমূলক অসদাচরণ বলা হয়েছে। একজন সাংবিধানিক পদধারীর ক্ষেত্রে অনুরাগ বা বিরাগ অথবা কর্তব্য পালনে ব্যক্তিগত স্বার্থে প্রভাবিত হওয়া অথবা সরকারি কার্য ও সরকারি সিদ্ধান্তকে ব্যক্তিগত স্বার্থে প্রভাবিত হতে দেয়ার প্রশ্ন তখনই দেখা দেয় যখন তিনি দুর্নীতিগ্রস্ত অথবা পক্ষপাতদুষ্ট।

ভারতীয় স্বাক্ষ্য আইন ১৮৭২ এর ধারা ২৪ থেকে ৩০ এর মধ্যে কোথাও লেখা নেই যে, আদালতের বাইরে কোন স্বাীকারোক্তি গ্রহনযোগ্য হবে।

এ ছাড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ অনুযায়ী কোন নাগরিককে জিম্মি করে ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার অডিও ভিডিও তৈরী ও প্রচার গুরুতর অপরাধ। আর অন্যায়ভাবে সৃজিত ওই সব কনটেন্ট হয়রানি ও ভুল বিচার করতে অপচেষ্টার জন্য আদালতে দাখিল আরো গুরুতর অপরাধ।

সাম্প্রতিক সময়ে রেজিনা ইসলামের সাথে যে কান্ড হয়েছে, ওই ভিডিওতে দেখা সকল কর্মচারী শপথ ভেঙে অপরাধ করে ফেলেছেন। একই সঙ্গে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জিম্মিদশায় রোজিনার আত্মরক্ষার সাংবিধানিক অধিকার নিয়ে কটাক্ষ ও অরাধীদের পক্ষ নিয়ে বক্তব্য দিয়ে শপথ ভেঙেছেন।

এমতাবস্থায় পুরো ঘটনা তদন্ত করার জন্য দ্য কমিশন অব এনকোয়ারি অ্যাক্ট, ১৯৫৬–এর আওতায় নিরপেক্ষ তদন্ত করে আইনী ব্যবস্থা নেয়া উচিত।

লেখক
রিপন আনসারী
সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *