গত ৮/৯ বছরে ঢাকা বন বিভাগের গাজীপুর জেলায় জমি এবং অসংখ্য বাগান সামাহীন লুটপাটের কারণে বর্তমানে সম্পূর্ণ বেদখল ও বিরান ভূমিতে পরিণত হয়েছে। এই সময়ে প্রায় ১৫,০০০ একর মূল্যবান বনের সম্পত্তি বেদখল বা বেহাত হয়েছে। ২০০৮ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ইউনুছ আলী ঢাকা কেন্দ্রীয় বন সার্কেলের বন সংরক্ষক ছিলেন এবং ২৬ ডিসেম্বর ২০১২ থেকে প্রধান বন সংরক্ষক থাকাকালীন এসব জমি বেদখল হয়। ঢাকা বন বিভাগের কালিয়াকৈর, সালনা, রাজেন্দ্রপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় ভাওয়াল এস্টেটের প্রায় ২৪০০০ একর জমি বন বিভাগের অধীনে ছিল। কিন্তু, বর্তমানে এর অধিকাংশই ভূমিদস্যুরা দখল করে নিয়েছে। মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে ইউনুছ আলী তার সিন্ডিকেট সদস্যদের মাধ্যমে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির কাছে অভিনব পন্থায় হস্তান্তরে/ বেদখলে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করেছেন। হাতে গোনা কয়েকটি ঘটনা ছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রে নানাভাবে দখলদারদের উৎসাহিত ও প্ররোচিত করে দখলে সহযোগিতা করা হয়েছে। জানা গেছে, ২০১০ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সময়ে ইউনুছ আলীকে বনের জমি বেদখলে একান্তভাবে সহযোগিতা করেছেন ঢাকা বন বিভাগের ডিএফও অবনী ঠাকুর। ইউনুছ আলী এবং ডিএফও অবনী ঠাকুর পরষ্পর যোগসাজশে বনের ভূমি বণিজ্য এবং ওই ভূমিতে থাকা মূল্যবান বাগানের যাবতীয় বনজ সম্পদ বিক্রয় ও পাচারে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। এ বাণিজ্য আয়ের বিশাল অর্থ বিদেশে পাচারের বিষয়টি উপযুক্ত তদন্ত সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত হলেই বেরিয়ে আসবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এমনকি ইউনুছ আলী ও তার সহযোগীদের নানান অপকর্মের আরো অনেক অজানা তথ্যও বেরিয়ে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, বনের জমি বেদখলে সহযোগিতার বিনিময়ে ইউনুছ আলী ও তার সিন্ডিকেটের সদস্যরা অবৈধ দখলদার ব্যক্তি এবং শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে শ’ শ’ কোটি টাকা ঘুষ নিয়েছেন। বর্তমানে ঢাকা বন বিভাগের বেদখলকৃত ভূমিতে যারা অবস্থান করছে ওইসব শিল্প প্রতিষ্ঠান, মানুষ জন এবং তাদের কাছে কাগজপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেই দেখা যাবে, ৯৫% বনভূমি ২০০৮ সালের পর বেদখলে গেছে। এর আগে ওইসব স্থানে কোনো বসতি বা জোতদার ছিলে না। কিন্তু, এই ৮/৯ বছর ধরে দুর্নীতিবাজ বন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাথে এডিসি (রেভিনিউ) গাজীপুর ও এসিল্যান্ড অফিসসমুহের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং এক শ্রেণীর প্রতারক দালালচক্রের পরষ্পর যোগসাজশে ভুয়া জোত তৈরিসহ বিভিন্ন জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে বনের জমি বেদখলে সহযোগিতার রমরমা ব্যবসা চলে আসছে। টাকার পাহাড় গড়তে এটি সহজ বাণিজ্য, তাই হাতছাড়া করেননি ইউনুছ আলী ও তার সহযোগীরা। তাদের এই লাগামহীন দুর্নীতির কারণে দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, ঢাকা বন বিভাগ হারিয়েছে ১৫০০০ একর জমি ও বনজ সম্পদ। ২০০৮ সাল থেকে গাজীপুর জেলার বিভিন্ন ফরেস্ট রেঞ্জ ও বিটে যারা কর্মরত ছিলেন এবং এখনো আছেন তাদের অর্থ সম্পদ এবং বনের জমি বেহাতে নেতৃত্বদানকারী সিন্ডিকেট সদস্যদের বিরুদ্ধে যথাযথ তদন্ত টিমের মাধ্যমে সরেজমিনে বা গোপনে তদন্ত পরিচালত হলে প্রকৃত ঘটনা বর্ণিত তথ্যের চেয়েও ভয়াবহ বলে প্রতীয়মান হবে। বনের রাজা সদ্য অবসরে যাওয়া সিসিএফ ইউনুছ আলীর আপন বড় ভাইয়ের ছেলে বাগান মালী হাশেম আলী মাতব্বর ৪ বছরেরও বেশি সময় ঢাকা বন বিভাগে কর্মরত ছিলেন। বাগান মালী হাশেম আলী মাতব্বর ঢাকা বন বিভাগে মূলত সিসিএফের পক্ষে গোপন লেনদেন এবং বনের জমি বিক্রয়ের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। এ বাগান মালীর ভয়ে বনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সর্বদা তটস্থ থেকেছে। বাগান মালী তাতে কী? সিসিএফ সাহেবের আপন ভাতিজা বলেই কথা! সিসিএফ ইউনুছ আলীর অবৈধ অর্থ ও সম্পদের একটি অংশ রক্ষণাবেক্ষণ করেন হাশেম আলী মাতব্বর। সাবেক সিসিএফ ইউনুছ আলী সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য ছিলেন নন-ট্রেইন্ড জুনিয়র ফরেস্টার নাজমুল হক সরদার। তিনি গত ৭ বছর ঢাকা বন বিভাগে কর্মরত ছিলেন। বন নীতিমালা অনুযায়ী একটি বন বিভাগে একজন কর্মচারী ২ বছর এবং সার্কেলে সর্বোচ্চ ৫ বছর চাকরিকাল নির্ধারিত আছে। ফরেস্টার নাজমুল প্রায় তিন বছর আগে মনিপুর বিটে কর্মরত থাকাকালে ওই এলাকার হুয়া থাই কোং এবং সান ফাওয়ার সিরামিক থেকে বনের জমি বেদখলে সহযোগিতার বিনিময়ে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। এ ঘটনা জানাজানি হলে তৎকালীন রেঞ্জ কর্মকর্তা গোলাম রসুল তার বিরুদ্ধে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর অভিযোগপত্র দায়ের করেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে ফরেস্টার নাজমুল হক সরদার ও সিসিএফ ইউনুছ আলীর ভাতিজা বাগান মালী হাসেম আলী মাতব্বর শারীরিকভাবে গোলাম রসুলকে মারধোর করেন। অভিযোগপত্র দায়ের করার অপরাধে রেঞ্জ কর্মকর্তা গোলাম রসুলকে তাৎক্ষণিকভাবে সিলেট বন বিভাগে বদলি করা হয়। আর অপরাধী ফরেস্টার নাজমুল হককে সবচেয়ে লোভনীয় পোস্টিং, কালিয়াকৈর চেক স্টেশনে পদায়ন করা হয়। অত্যন্ত লোভনীয় কালিয়াকৈর চেক স্টেশনে এক বছরেরও বেশি সময় থাকার পর পুনরায় তাকে সিসিএফের নির্দেশে চন্দ্রা বিটে অর্থাৎ আরেক আকর্ষণীয় পদে পোস্টিং দেয়া হয়। এ চন্দ্রা বিটে কর্মরত থাকাকালে ফরেস্টার নাজমুল হক সরদার ২০১৫ সালে ব্যাপকহারে বনের জমি অবৈধ দখলে সহযোগিতা করেন। দখলদারদেরকে অবৈধভাবে জমি দখলে সহযোগিতার মাধ্যমে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। এছাড়া বনের জমির উপর দিয়ে নীতিবহির্ভুতভাবে গ্যাস পাইপ লাইন স্থাপনেও তিনি অবৈধ সহযোগিতা করেন। গোপন সমঝোতার মাধ্যমে এখান থেকেও মোটা অংকের টাকা পান। বিষয়টি জনসমক্ষে প্রকাশ হলে সিসিএফ কৌশলে নাজমুল হককে ২৮ দিনের জন্য লোকদেখানো সাসপেন্ড করেন। ২৮ দিন পর সাসপেন্ড প্রত্যাহার করে তাকে প্রশিক্ষণের নাম করে সিলেট পাঠিয়ে দেন। অথচ বার বার বিভিন্ন স্থানে বনের ভূমি বেহাতের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অপরাধে তার কোনো শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়নি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ফরেস্টার নাজমুল কয়েক কোটি টাকা খরচ করে ঢাকার উত্তরায় বাড়ি করেছেন এবং একাধিক গাড়িও রয়েছে তার। এছাড়া অতি অল্প সময়ে গ্রামের বাড়িতে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন বলেও তারই এলাকার অন্য বন কর্মচারীরা নিশ্চিত করেছেন। এভাবে দেশব্যাপী বন অধিদফতরের বিভিন্ন বন বিভাগ ও সার্কেলে কর্মরত ইউনুছ আলী নেতৃত্বাধীন সিন্ডিকেট সদস্যরা গত কয়েক বছরে বনের গাছ ও জমি বেদখলে সহযোগিতা করে দেশে-বিদেশে অর্থ ও সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন। ভুয়া জোত পারমিটের নামে চট্টগ্রাম বন অঞ্চলের লামা বন বিভাগ, সুন্দরবন বন বিভাগ এবং চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের গহিণ বনাঞ্চলের মূল্যবান সেগুন, গজারি, শাল, গামৈর প্রভৃতি বাগানের মূল্যবান বন সম্পদ গত কয়েক বছরে পাচারের মাধ্যমে এ এলাকাগুলোকে বিরান ভূমিতে পরিণত করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্যমতে, বন সংরক্ষক আবদুল লতিফ মিয়ার নেতৃত্বে ওই তিন বন বিভাগের ডিএফওরা ইউনুছ আলীর লাগামীন অর্থের চাহিদার যোগান দিতে গিয়ে এসব বন উজাড় করেছেন। জানা গেছে, সিলেটের ডিএফও আবুল বাশার মারা যান ২০১৪ সালে। তার মৃত্যুর পূর্বে ১৩ মাস তিনি শারীরিক অক্ষমতার কারণে একদিনও অফিস করতে পারেননি। ওই ১৩ মাস অসুস্থ ডিএফও আবুল বাশারের স্থলে কাউকে দায়িত্বে দেয়া হয়নি, যদিও এটি অপরিহার্য ছিলো। তৎকালীন সিসিএফ ইউনুছ আলী সিলেট বন বিভাগে ওই সময় কর্মরত ফরেস্ট রেঞ্জারদের মাধ্যমে সমগ্র সিলেট বিভাগের সরকারি বনজ সম্পদ বিরানের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। আবুল বাশারের অসুস্থতার সুযোগ নেন ইউনুছ আলী। দীর্ঘ সময় মরহুম আবুল বাশার কর্ম অক্ষম থাকার বিষয়টি তিনি যথাসময়ে বন মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেননি বলেও জানা গেছে। সুন্দরবনে ২০০৭ সালে রয়েল বেঙ্গল টাইগার ছিলো সর্বমোট ৪২০টি। ২০১৫ সালে এর সংখ্যা কমে মাত্র ১০৬টি অবশিষ্ট পাওয়া যায়। বাকি ৩১৪টি বাঘ সুপরিকল্পিতভাবে পাচার করা হয়েছে। এভাবেই জমি বেদখল, গাছ উজাড়সহ সব রকমের বনজ সম্পদ ধ্বংস করেছেন বনের রাজা ইউনুছ আলী।