তিন মাস আগে দেশ গার্মেন্টস লিমিটেডের চট্টগ্রাম ইপিজেডস্থ কারখানায় এভিটেক ব্র্যান্ডের সিসি ক্যামেরাগুলো সম্পূর্ণ অকার্যকর হয়ে যায়। পরবর্তীতে ফার্মওয়্যার পরিবর্তন করে কারখানাটির নিরাপত্তা ব্যবস্থা সচল করতে হয়। নকল হওয়ায় আইপি প্রযুক্তির ক্যামেরাগুলোর ফার্মওয়্যার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে বিপাকে পড়তে হয় কারখানা কর্তৃপক্ষকে।
শুধু দেশ গার্মেন্টস নয়, নকল সিসি ক্যামেরার সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়তে হচ্ছে অনেক ব্যবহারকারীকে। এমনই আরেকটি প্রতিষ্ঠান রেলওয়ের ট্র্যাক নির্মাতা ম্যাক্স গ্রুপ।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, নিরাপত্তা উদ্বেগজনিত কারণে গত কয়েক বছরে দেশে সিসি ক্যামেরার ব্যবহার বহুলাংশে বেড়েছে। ব্যক্তিগত বাসাবাড়ি থেকে শুরু করে বাণিজ্যিক, শিল্প সব ধরনের প্রতিষ্ঠানেই প্রযুক্তিটির ব্যবহার হচ্ছে। আর চাহিদার উল্লম্ফন ও অনেক ক্ষেত্রে ব্যবহারকারীর অসচেতনতার সুযোগ নিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা বাজারে নকল সিসি ক্যামেরার সরবরাহ বাড়িয়ে দিয়েছে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, স্যামসাং থেকে শুরু করে ডাহুয়া, এইচআইকে ভিশন, ক্যামপ্রো, এভিটেকসহ প্রতিষ্ঠিত প্রায় সব ব্র্যান্ডের নকল সিসি ক্যামেরা বাজারে পাওয়া যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিভিন্ন কারসাজির মাধ্যমে নকল সিসি ক্যামেরা চালু করা গেলেও পরবর্তীতে নেটওয়ার্কিংয়ে সমস্যা হতে পারে। এছাড়া প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোও যেকোনো সময় ফার্মওয়্যার কোড বন্ধ করে দিতে পারে। এ কারণে নকল সিসি ক্যামেরার ফার্মওয়্যার আপডেটে সমস্যা হতে পারে। এছাড়া ক্যামেরাগুলো বন্ধও হয়ে যায়। এতে করে সিসি ক্যামেরানির্ভর নিরাপত্তা ব্যবস্থাও অচল হয়ে পড়তে পারে।
ব্যবসায়ীরা জানান, অ্যানালগ, এইচডি ও আইপি— এ তিন প্রযুক্তির সিসি ক্যামেরা দেশে পাওয়া যায়। তবে উন্নত প্রযুক্তি ও গুণগত মানের কারণে দিন দিন আইপি ক্যামেরার ব্যবহার বাড়ছে। সিসিটিভি নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ক্যামেরার সঙ্গে অন্যতম যন্ত্রাংশ হিসেবে ব্যবহার হয় ডিভিআর (ডিজিটাল ভিডিও রেকর্ডার)। দেশে বিভিন্ন নামি ব্র্যান্ডের ক্যামেরার পাশাপাশি নকল ডিভিআরও বাজারজাত হচ্ছে।
বাজার ঘুরে জানা যায়, বিশ্বখ্যাত ইলেট্রনিকস পণ্য প্রস্তুতকারক স্যামস্যাং ইলেকট্রনিকস সিসি ক্যামেরাও প্রস্তুত করে। তবে বাংলাদেশে স্যামসাংয়ের এ পণ্যটির অনুমোদিত কোনো পরিবেশক নেই। তা সত্ত্বেও দেশের বাজারে স্যামসাংয়ের বিভিন্ন সিসি ক্যামেরা পাওয়া যাচ্ছে। যার সবই অননুমোদিত ও নকল। শুধু স্যামসাং নয়, বিশ্বে সিসি ক্যামেরা বিক্রিতে অন্যতম শীর্ষে থাকা প্রতিষ্ঠান এইচআইকে ভিশন ও ডাহুয়া ব্র্যান্ডের ক্যামেরা ও ডিভিআরও নকল করে বাজারজাত হচ্ছে দেশে।
মূলত চীন থেকে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নামাঙ্কিত নকল সিসি ক্যামেরা দেশে আনা হয়। নকল সিসি ক্যামেরা আমদানির পর দেশে বসেই বিভিন্ন ব্র্যান্ডের লেবেল এবং মোড়ক লাগিয়ে বাজারজাতের ঘটনাও ঘটছে। রাজধানীর স্টেডিয়াম মার্কেটে এ ধরনের অপরাধমূলক কাজ বেশি হচ্ছে বলে একটি সূত্র জানায়।
বাংলাদেশে এইচআইকে ভিশনের পরিবেশক এক্সেল টেকনোলজিস লিমিটেডের ব্যবস্থাপক (মার্কেটিং অ্যান্ড সেলস) মো. মিজানুর রহমান বলেন, আমাদের অনেক পণ্যের নকল বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। তবে অ্যানালগ পণ্যের নকল বেশি হচ্ছে। মূলত পণ্যের মডেল নাম্বার, লেবেল, মোড়ক নকল করে সেগুলো বিক্রি করা হচ্ছে। আসল এইচআইকে ভিশন ক্যামেরা পাঁচ বছরেও নষ্ট হয় না। ক্যামেরার রেজুলেশনও অনেক বছর ব্যবহারে নষ্ট হয় না। কিন্তু নকল পণ্য ব্যবহারের এক বছরের মধ্যে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। আর মূল প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ফার্মওয়্যার বন্ধের কারণে নকল সিসি ক্যামেরানির্ভর নিরাপত্তা ব্যবস্থা যেকোনো সময় সম্পূর্ণ অচল হয়ে যেতে পারে। এতে ব্যবহারকারী আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবেন।
সিসি ক্যামেরার বাজারে প্রতারকদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে তিনি জানান, আমরা সরকারকে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে অনুরোধে আগ্রহী ছিলাম। কিন্তু এতে ভোক্তাদের মাঝে এইচআইকে ভিশন সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হতে পারে, এমন আশঙ্কায় এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসি।
বাংলাদেশে ডাহুয়ার অনুমোদিত সরবরাহ কেন্দ্র এশিয়াবিজ টেকনোলজির স্বত্বাধিকারী অসীম কুমার সিন্ধ বলেন, প্রতিটি পণ্যের একটি নির্দিষ্ট কোড নাম্বার থাকে। প্রতারকরা নিজেরা পণ্য তৈরি করে নকল কোড দিয়ে থাকে। মূলত রাজধানীর স্টেডিয়াম মার্কেটে এ ধরনের কাজ হয়ে থাকে। তিনি আরো জানান, চায়নায় ইংসিং নামে এক ব্যক্তি ডাহুয়া ব্র্যান্ডের নকল পণ্য তৈরি করে আসছিল, তার বিরুদ্ধে চীনে লেবেল নকলের মামলা হয়েছে। তবে দেশে কারো বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
এ বিষয়ে এভিটেক বাংলাদেশের পরিবেশক ইউনিকোড টেকনোলজির ব্যবস্থাপক আহমেদ শাহীন বলেন, ফার্মওয়্যার অচলের কারণে সিসি টিভি ব্যবস্থা যেকোনো সময় অকার্যকর হতে পারে। নকল পণ্য ব্যবহারের ফলে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়ে থাকে।