“ঢাকা; মাহমুদা খানম মিতু হত্যার পেছনে তাঁর স্বামী পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার জড়িত বলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ করেছেন মিতুর মা ও বাবা। মিতুর বোনের অভিযোগের তীরও দুলাভাইয়ের দিকে। তবে এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল রোববার গণমাধ্যমকর্মীরা বাবুল আক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তিনি কোনো জবাব দেননি।
আজ সোমবার বাবুল আক্তার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসে এ অভিযোগের জবাব দিয়েছেন।
বাবুল আক্তারের পুরো বক্তব্য এখানে দেওয়া হলো :
অনেকের অনেক জানতে চাওয়া আমার কাছে। আমি কথা বলার জন্য মানসিকভাবে কতটা প্রস্তুত, তা নিয়ে কারও বিকার নেই। তবে আমার নিরুত্তর থাকার সুযোগটুকু কাজে লাগিয়ে মনের মতো কাহিনি ফাঁদতে ফাঁদতে পরকীয়া থেকে খুন পর্যন্ত গল্প লেখা শেষ করে ফেলেছেন অনেকে। আমার কোনো মাথাব্যথা নেই এসব নিয়ে, আমি আমার মা–হারা সন্তান দুটিকে নিয়েই ব্যস্ত এখন। তা ছাড়া প্রমাণের দায়িত্ব, যারা অভিযোগ করেন তাঁদের। তবে আমার পরিবার–পরিজন এবং শুভাকাঙ্ক্ষীদের কথা ভেবে কিছু কথা না বললেই নয়।শেষ থেকেই শুরু করি। ওই শেষটা, যেখান থেকে আমার আর আমার সন্তানদের সব গ্লানির শুরু।
বাচ্চা দুটি হয়েছে তাদের মায়ের মতো। ছিমছাম সাজানো ঘর ছেড়ে ঢাকায় বাবার বাড়ি বেড়াতে আসলে মিতু চট্টগ্রামে নিজের বাসায় ফেরার জন্য অস্থির হয়ে উঠত। ছেলেমেয়ে দুটিও কিছুদিনের মধ্যেই নানার বাড়ি ছাড়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠল। কিন্তু সন্তান আমার হলেও তাদের ওপর নানা-নানির অধিকারটুকু আমি বিলীন করতে চাইনি। ভেসে যাওয়ার দিনগুলোতে তারা (আমার শ্বশুরপক্ষ) আমায় আর আমি তাদের আঁকড়ে ছিলাম। তাই ছেলেমেয়ে নিয়ে দূরে সরে গিয়ে আমি অকৃতজ্ঞ হতে চাইনি। যত কষ্ট আর অস্বস্তিই হোক, বাচ্চাদের নানা-নানির কথা ভেবে আমি তাঁদের ঘরেই ছিলাম, কৃতজ্ঞ ছিলাম।
আমরা বাসায় কেব্ল লাইন রাখা মোটেও পছন্দ করতাম না শুধু ছেলেমেয়ে অরুচিকর অভ্যাসে বন্দী হবে বলে। আর মিতু মারা যাওয়ার পর থেকে নানার বাড়িতে তার বাচ্চাদের দিন শুরু হতো স্টার জলসা দিয়ে, শেষও হতো স্টার জলসা দিয়ে। যে মিতুর দিন শুরু হতো নামাজ দিয়ে তার সন্তানেরা সকাল সাতটায় জেগে টিভিতে সিরিয়াল দেখে দেখে বেলা ১১টায় নাশতা খেতে পেত। আমরা এ ধরনের খাদ্যাভ্যাসে অভ্যস্ত ছিলাম না। ছেলে শাকসবজি খেতে পছন্দ করলেও মাসে দু-একবারের বেশি তা খাওয়া হতো না। অন্যের বাড়িতে বাচ্চার ক্ষুধা আর স্বাস্থ্যের তাগাদা দেওয়ার সুযোগ আমার ছিল না। তবুও আমি চুপ ছিলাম, কৃতজ্ঞ ছিলাম।
আমার ছেলেটার চোখের সামনে তার মা খুন হয়েছে। নিয়মিত কাউন্সেলিং করিয়েছি তাকে। কাউন্সিলরের একটাই কথা, কোনো অবস্থাতেই ছেলের সামনে তার মায়ের মৃত্যুসংক্রান্ত কোনো কথা বলা বা তাকে এ ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। ছয়টা মাস আমি চব্বিশ ঘণ্টা ছেলেটার পাশে পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। খেয়াল রেখেছি যেন সে এসব কথাবার্তার মুখোমুখি না হয়। তবে বাইরে একদম না বের হয়ে তো পারা যেত না। যেদিনই বাইরে যেতাম ফিরলে দেখতাম ছেলে আমার মুষড়ে আছে। বাইরে থেকে ফেরার পর এক মধ্যরাতে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ছেলেটা আমায় প্রশ্ন করে, ‘বাবা, কান্না চেপে রাখলে কী বুকে ব্যথা হয়? আমার বুকে এত ব্যথা করে কেন?’ আমি তাকে বুকে জড়িয়ে শান্ত করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হয়েছে?’ সে বলল, ‘নানা-নানি সারা দিন আম্মুর কথা বলে, আমার খুব কান্না আসে। কিন্তু কান্না করতে পারি না, আমার বুকে ব্যথা করে।’ তারপর আমাকে বলল যেন তাকে চট্টগ্রামের বাসার মতো সুন্দর বাসায় নিয়ে যাই, দুই মাসের মধ্যেই।
ছেলের নানার বাড়িতে অস্বস্তি হওয়ার অনেক কারণ ছিল। আমার শ্বশুরবাড়িতে যৌথ পরিবার। অর্থাৎ, আমার শ্বশুর-শাশুড়ি, আমার শ্যালিকা ও তার স্বামী, আমার শাশুড়ির নিজের বোন এবং সেই বোনের স্বামী-সন্তানসহ মোট তিনটি পরিবার আমার শ্বশুরের চার বেডরুমের ঘরটিতেই থাকে। আমার শ্বশুরপক্ষের জামাতারা নিজের শ্বশুর-শাশুড়ি নিয়ে শ্বশুরের ঘরেই থাকে, এটা তাদের পারিবারিক রীতি (যাতে আমি অভ্যস্ত নই)। মিতু মারা যাওয়ার পর আমি ছেলেমেয়ে নিয়ে শ্বশুরের ঘরের একটি রুমে থাকতাম। ঘরটা যেন আরও ঘিঞ্জি হয়ে উঠল। শ্বশুরের ঘরের লোকজনেরও আরও কষ্টে পড়তে হলো। তা ছাড়া চারপাশে বস্তিবাসীর চেঁচামেচি আর অশ্লীল কথোপকথন ছেলেকে আরও খিটখিটে করে তুলছিল।
জন্মের পর থেকে যে সন্তানদের আমরা সুবচনে অভ্যস্ত করেছিলাম, তারা মায়ের মৃত্যুর পর চারপাশ থেকে গালমন্দ শিখতে শুরু করল। এভাবেই দিন কাটছিল। মাঝে আর বাসা পরিবর্তন নিয়ে ছেলের সঙ্গে কোনো কথা হয়নি, ভাবলাম হয়তো সে ভুলে গেছে। কিন্তু হঠাৎ একদিন ছেলে আমাকে টেনে ক্যালেন্ডারের কাছে নিয়ে গিয়ে বলল, ‘বাবা, আজ তোমার দুই মাসের সময় শেষ।’ আমি অবাক হয়ে দেখলাম, ছেলে আমার দুই মাস ধরে ক্যালেন্ডারে দাগ দিয়ে দিন গুনছিল নানার বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার। তারপর আমি ছেলের কাছ থেকে আরও ১৫ দিন সময় চেয়ে নিলাম।
সবদিক বিবেচনা করে আমি শ্বশুর-শাশুড়িকে জানালাম যে বাচ্চারা এই পরিবেশে অনভ্যস্ত এবং থাকতে চায় না, তাই তাদের নিয়ে সুন্দর পরিবেশে থাকা প্রয়োজন। তারা খুব সুন্দর সমাধান দিলেন। বললেন, তাঁদের ঘরের ওপরেই আরও ঘর তৈরি করতে আমি যেন ১০ লাখ টাকা দিই এবং সেখানেই থাকি। আমি যে দশ টাকার লোকও নই, এ কথা বোঝানোর মতো সাধ্য আমার ছিল না। আর ঘর ঘিঞ্জি না হওয়ার সমাধানস্বরূপ বললেন যেন আমার মা-বাবা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন কেউই আমার কাছে না আসে। আমার শ্বশুর বললেন, হয় আমাকে আমার বাবা-মা ছাড়তে হবে, নাহয় শ্বশুর-শাশুড়ি ছাড়তে হবে। আমি কম মরে যাওয়ার অপেক্ষায় ছিলাম? কী জানি! তবে আমি চুপ ছিলাম, কৃতজ্ঞ ছিলাম।
দিন কাটছিল যুগের গতিতে। ছেলেমেয়ে রাত ১২টা পর্যন্ত পড়াশোনা করতে শুরু করল। আমি ভীত হয়ে উঠলাম। কারণ, শিশু বয়সে পড়াশোনার চাপ নেওয়াটা আমি মানসিক বিকাশের অন্তরায় হিসেবেই দেখি। তাছাড়া মা হারিয়ে আমার সন্তানেরা এমনিতেই তীব্র মানসিক চাপের মাঝে ছিল। আমি একদিন ছেলেকে জিজ্ঞেস করলাম এত রাত পর্যন্ত তারা কী পড়াশোনা করে। তখন ছেলে বলল, নানি বলেছে তাকে বনশ্রী আইডিয়াল স্কুলে চান্স পেতেই হবে এবং তাই ‘ছোট আম্মু’ তাদের মধ্যরাত পর্যন্ত পড়ায়। ভাবলাম মিতুর ছোট বোন শায়লার কথা বলছে। কিন্তু পরে আবিষ্কার করলাম মিতুর সদ্য এসএসসি পাস করা ১৬ বছর বয়সী খালাতো বোনকে (যে তার পরিবারসহ মিতুর বাবার বাড়িতেই থাকে) আমার ছেলেমেয়েকে ‘আম্মু’ ডাকা শেখানো হয়েছে এবং আমাদের সবকিছুর তদারকিও সেই বাচ্চা মেয়েটিকে দিয়ে করানো হয়।
একদিন ছেলের স্কুলের একটি অনুষ্ঠানে মায়ের ভূমিকায় পাশে এসে বসে মেয়েটি। বিভিন্ন সময়ে তাকে এগিয়ে দেওয়া হতো বাচ্চাদের মায়ের ভূমিকায়। রাতে ফিরে দেখতাম, ছেলেমেয়ে নিয়ে সে আমার ঘরেই আছে। আমার স্ত্রী মারা যাওয়ায় আমি এতটা বিকারগ্রস্ত হইনি যে একটা ইন্টার পড়ুয়া ১৬ বছরের বাচ্চা মেয়েকে বিয়ে করে আমার বাচ্চাদের ‘মা’ বানাতে হবে। তাদের একটাই কথা, শ্বশুরের বাড়িতেই নতুন ঘর বাঁধতে হবে এবং সেখানেই থাকতে হবে। আমার ওই সময়ের অনুভূতি কোনো শব্দে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তবে দিন দিন এসব আচরণ এতটাই বিঁধতে লাগল যে আমি আমার দ্বিমত প্রকাশের জন্য কোনো শব্দ না খুঁজে বরং একটা চাকরি ও বাসা খুঁজে নিলাম। আমার শ্বশুরপক্ষকে জানিয়েই বাসা নিয়েছি এবং এতে তারা ভীষণ মনঃক্ষুণ্ণও হয়েছিলেন। বলেছিলেন, এর পরিণাম হবে খারাপ এবং আমাকে পচিয়ে ছাড়বেন তাঁরা। তবে প্রস্থানে আমি চুপই ছিলাম, কৃতজ্ঞ ছিলাম।
বাস্তব জীবনটা কোনো চলচ্চিত্র নয়। আমি সুপারকপের মতো উঠে গিয়ে স্ত্রীর খুনী বের করে ফেলব? সবকিছুর নিয়ম থাকে, প্রক্রিয়া থাকে। তদন্ত তদন্তের নিয়মে চলছে এবং সেই প্রক্রিয়ায় আমার যতটুকু প্রয়োজন অংশগ্রহণও রয়েছে। আমাকে যখনই তদন্তের প্রয়োজনে ডাকা হয়েছে, আমি ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম গিয়েছি, তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে ফোনে কথা বলেছি।
বাদীর কাজ সাক্ষীকে তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া, এটা আমি বুঝতে পারিনি। আমার মা-বাবা কিংবা শ্বশুর-শাশুড়ি কাউকেই তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাওয়ার মতো বিলাসিতা করার সুযোগ আমার নেই। কারণ মায়ের মৃত্যুর পর থেকে একরাতও বাচ্চারা আমায় ছেড়ে থাকেনি। জন্মের পর থেকেই তারা রাতে আমার সঙ্গে ঘুমিয়েই অভ্যস্ত। আমাকে কয়েক ঘণ্টা না দেখলেই কেঁদে অস্থির হয় তারা। আমাকে দিনের মধ্যে কয়েকবারই বাসায় যেতে হয়, অনেক সময় ছেলেমেয়েকে নিয়েই অফিসে যেতে হয়। তাই প্রথমে আমার শ্বশুরের পছন্দমতো তাঁর বাড়ির কাছের স্কুলটিতে ভর্তি করালেও ছেলের দিকে তাকিয়ে তাকে আবার আমার অফিসের কাছাকাছি একটি স্কুলে ভর্তি করাই।
আমার মুখ্য অপরাধের তালিকায় বাচ্চা মেয়ে বিয়ে না করে শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে ছেলেমেয়ে নিয়ে নিজের মতো থাকাটাই হয়তো এক নম্বরে জায়গা পাবে। নাহয় মিতুর মৃত্যুর পর তাঁর মা কেঁদে কেঁদে বলেছিলেন, ‘১৪ বছরের সংসারে অশান্তি হয়নি বাবুল-মিতুর।’ আমার শাশুড়ি আরও বলেছিলেন, ‘বাবুল হইল ফেরেশতা।’ এমনকি গত মাসে (২৫ জানুয়ারি, ২০১৭) তিনি চট্টগ্রামে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আমি বাবুলকে সন্দেহ করি না।’ মিতুর বাবা মিডিয়ায় আমাকে নিয়ে নানা অপপ্রচারের পরিপ্রেক্ষিতে বলেছিলেন, ‘এসব কথা ভিত্তিহীন। তদন্ত ভিন্ন খাতে নেওয়ার জন্য এসব রটানো হচ্ছে।’ আমার শ্যালিকা শায়লা বলেছিল, ‘ভাইয়া আর আপুর সংসারে কোনো অশান্তি ছিল না।’ আর কয়েক মাস গড়াতেই আজ ভিন্ন কথন!
মিতু মারা যাওয়ার আট মাস পর তার মা-বাবা আর বোনের মনে পড়ল আমি মিতুকে অবহেলা করেছি, তার সঙ্গে খারাপ আচরণ করেছি দিনের পর দিন, প্রতিনিয়ত পরকীয়ার সম্পর্ক চালিয়ে গিয়েছি, মিতু আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল এবং মিতু নিতান্তই অপারগ হয়ে আমার সংসারে ছিল। আর এই আট মাসে একবারও মিতুর মায়ের মনে হয়নি যে মিতুর মৃত্যুর আগে তার সঙ্গে আমার আচরণ বদলে গিয়েছিল। মিতু আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল এটা ২–৩ মাস আগে জানলেও গত মাসেই চট্টগ্রামে সাংবাদিকদের বলে এসেছেন, তাঁরা আমাকে সন্দেহ করেন না। আমার অবুঝ দুই সন্তানের দিকে তাকিয়ে নাকি তাঁরা চুপ ছিলেন। তাহলে কী এখন আমার সন্তানেরা সব বুঝতে শিখেছে, আট মাসেই সাবালক হয়ে গেছে? ছেলেমেয়ের প্রতি মায়া উবে গেছে?
আমি বুঝলাম না, কোন মা-বাবা তাঁদের মেয়ের স্বামীর পরকীয়ার সম্পর্ক আছে জেনেও কীভাবে মেয়েকে ওই স্বামীর সংসারে রেখে দেয়! অন্তত যৎসামান্য চেষ্টাও কী কেউ করে না তাঁর মেয়েকে সুখী করার? আর যে মেয়ের স্বামী পরকীয়ায় আসক্ত, যার সাথে দিবানিশি অশান্তির সংসার ছিল, সে খুন হওয়ার পর আট মাসেও তার মা-বাবার একটিবারের জন্যও মনে হলো না যে স্বামীই তার হত্যাকারী? বরং ছয় মাস সেই জামাতাকে নিজের ঘরে রেখে তাঁদেরই আরেক মেয়ের সাথে বিয়ে দিতে চাইলেন?
আরও কত গল্প যে শুনতে হবে জানি না। কারণ, আমার শ্বশুর তো বলেই রেখেছেন যে আমার দেশে-বিদেশে পরকীয়া রয়েছে। তাদের কথা শুনে আমার এখন মনে হয়, পরকীয়া ছিল আমার ফুলটাইম পেশা, আর চাকরি ছিল পার্ট টাইম!
আমার শ্বশুরপক্ষ তাঁদের কথা রেখেছেন, আমাকে অপমানিত করার জন্য চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখেননি। ‘তোমারে পচাইয়া ছাড়মু, শান্তিতে থাকতে দিমু না।’—কথাটি অক্ষরে অক্ষরে রাখার নিরন্তর সাধনা করে যাচ্ছেন তাঁরা। আমি যে বড়ই অবাধ্য জামাতা, আমার মা-বাবা, পরিবারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে, ষোড়শী শ্যালিকাকে বিয়ে করে শ্বশুরবাড়িতেই ঘর তৈরি করে ঘরজামাই হওয়ার মতো বাধ্য যে আমি নই!
মিতু যেদিন মারা যায়, সেদিন সারা দেশই ছিল দিশাহারা। আমার শাশুড়ি ও শ্যালিকাও (শায়লা) ছিল শোকে বিহ্বল। তাঁরা সেদিন দুঃখে মিতুর লাশ বাদ দিয়ে আমাদের আলমারি থেকে আমাদের সব কাপড়চোপড়, গয়নাগাটি আর জমানো কিছু টাকাপয়সা ব্যাগে ভরে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় নিয়ে আসাতেই ব্যস্ত ছিল। তাছাড়া এর কিছুদিন পর তারা মিলাদ পড়ানোর নামে চট্টগ্রাম গিয়ে বাইরে থেকে মিস্ত্রি ডেকে নিয়ে আমার বাসার আলমারি ভেঙে বাকি যা কিছু ছিল, তা–ও নিয়ে আসেন। পরবর্তীকালে মিতুর ব্যবহৃত জামাকাপড় ও জিনিসপত্র তাঁর আত্মীয়স্বজনদের ব্যবহার করতে দেখে কষ্ট পেয়েছিলাম। মায়ের স্মৃতি হিসেবে বাচ্চা দুটির জন্য আমার কাছে আর কিছুই নেই। শোকগ্রস্ত আমি চুপই ছিলাম, কৃতজ্ঞ ছিলাম।
পৃথিবীর এমন একটি দম্পতি আমি দেখতে চাই, যাদের মধ্যে মতবিরোধ ও মনোমালিন্য হয় না। আমি কী আকাশের চাঁদই হাতে চেয়ে ফেললাম? হ্যাঁ, অতি অবশ্যই হ্যাঁ। আমি আগেও বলেছি, নির্ঝঞ্ঝাট সংসার দেবদূতেরও হয় না। আমার সংসারেও ছোট–বড় রাগ–অভিমান হতো, যেভাবে আর দশজনের হয়। সবাই নিশ্চয় এ জন্য একে অন্যকে মেরে ফেলে না। তা ছাড়া একে অন্যকে মেরে ফেলার জন্য কেউ চৌদ্দ বছর সংসার করে না। একে অন্যকে মেরে ফেলার জন্যই কী কেউ দুটি সন্তানের জন্ম দেয়?
আর আমার পরকীয়া সম্পর্কে সংবাদমাধ্যম থেকে জেনে একজন যৌক্তিক পাঠক হিসেবে আমার প্রশ্ন এসবের কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ রয়েছে কি না?
নিহত আকরামের বোন রিনি অভিযোগ করেছেন যে আমার প্রভাবে পুলিশ আকরাম হত্যার অভিযোগ থেকে আমার নাম বাদ দিয়েছিল। অথচ তিনি তখন আমার নামে কোনো অভিযোগই করেননি। রিনি তখন আদালতে অভিযোগ করেছিলেন যে আকরামের স্ত্রী তাঁর ফুপাতো ভাই মুনের সঙ্গে পরকীয়ার সম্পর্কের জের ধরে আকরামকে খুন করে। ওই অভিযোগে আকরামের স্ত্রী, তাঁর কথিত প্রেমিক মুন এবং আকরামের শ্বশুর-শাশুড়ির নাম উল্লেখ করা হয়। তাছাড়া ঘটনার সময় আমি দেশেও ছিলাম না।
এত বছর পর রিনি আগের সব অভিযোগ ভুলে গিয়ে আমার বিরুদ্ধে তাঁর ভাই হত্যার বিচার চাইতে গিয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশের (আমার শ্বশুর) কাছে! আর নিহত আকরামের স্ত্রী থাকেন মাগুরা এবং ঝিনাইদহে; আমার পদোন্নতির আগ পর্যন্ত আমি থাকতাম চট্টগ্রামে। আর আমার বছরে একবারও বাড়ি যাওয়ার মতো সময়–সুযোগ হতো না। পরিচয় ছাড়া, যোগাযোগ ছাড়া, দেখা সাক্ষাৎ ছাড়াও যে পরকীয়া হয়, এটা জানা ছিল না।
আকরামের বোন অভিযোগ করেছেন যে ছেলের শোকে তাঁর মা মারা গিয়েছেন। এখন আকরামের মায়ের মৃত্যুর দায়ও যদি আমার ওপর চাপানো হয় আশ্চর্য হব না! কারণ, তিনি তো বিচার চাইতে গেছেন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশের (আমার শ্বশুর) কাছে। এটা ঠিক যে মৃত আকরামের স্ত্রী মাগুরায় আমাদের একই এলাকায় থাকতেন এবং তাঁর স্বামী মারা যাওয়ার পর আকরামের রেখে যাওয়া সম্পদ নিয়ে পারিবারিক বিরোধের কারণে সে আমার ছোট ভাইয়ের (পেশায় আইনজীবী এবং মাগুরায় থাকে) কাছ থেকে আইনি সহায়তা নিয়েছিলেন, যে ঘটনায় আমার কোনো সংশ্লিষ্টতাই ছিল না। একই এলাকায় থাকলে কিংবা বাবা-ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় থাকলেই যদি পরকীয়া হয়ে যায়, তবে আমার পরকীয়ার প্রেমিকাদের নাম লেখা শুরু করলে তা পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধ থেকে শুরু হয়ে দক্ষিণ গোলার্ধে পৌঁছালেও শেষ হবে না।
যখনই আমি শ্বশুর-শাশুড়ির অমতে বাচ্চাদের নিয়ে আলাদা বাসায় আমার মা-বাবাকে নিয়ে থাকা শুরু করলাম, তখনই আমার শ্বশুর আমার পরকীয়ার খোঁজ পেলেন, ঠিক তখনই আমার শাশুড়ি মিতুর সঙ্গে আমার খারাপ সম্পর্কের কথা জানতে পারলেন, আর তখনই আকরামের বোন জানতে পারলেন তাঁর ভাইয়ের স্ত্রীর সঙ্গে আমার পরকীয়া ছিল; তখনই তারা জানলেন চিত্রনাট্যের নাট্যকার ছিলাম আমি! আমার শ্রদ্ধেয় শ্বশুর-শাশুড়ি হয়তো সেই নীতি অনুসরণ করেছেন, ‘একটা মিথ্যা দশবার বললে তা সত্যে পরিণত হয়।’ তারপরও আমি কৃতজ্ঞ তাদের প্রতি। কারণ, তারা তো আমার স্ত্রীর বাবা-মা, আমার সন্তানের নানা-নানি।
আমি চাই আমার স্ত্রী হত্যার সঠিক বিচার হোক। সে আমার সন্তানদের মা, আমার পৃথিবীর ভিত ছিল সে। তাকে হারিয়ে আমি ও আমার বাচ্চা দুটির চেয়ে বেশি কষ্ট কেউ পেয়েছে বলে আমার বোধ হয় না। এখনো সামলে উঠতে পারিনি আমরা। বাচ্চাদের একটা স্বাভাবিক জীবন দেওয়ার জন্য অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এর মধ্যেই যে যা ইচ্ছে বলছে, ছাপছে। আমার ছেলেটা যখন এসব সংবাদ পড়ে ও দেখে, তখন তার মানসিক অবস্থাটা কী দাড়ায়? কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য–প্রমাণ ছাড়া শুধু কারও ব্যক্তিস্বার্থে করা মিথ্যা অভিযোগের ভিত্তিতে যারা কথা বলছেন, তারা আমার জায়গায় নিজেকে একবার রাখুন, নিজের সন্তানটিকে আমার ছেলের জায়গায় ভাবুন। তারপর কলম হাতে নিন, সংবাদ–বাণিজ্য করুন।
আজ আমার ছেলের জন্মদিন, মাকে ছাড়া প্রথম জন্মদিন তার। কী ভাবছে সে মনে মনে? কতটা কষ্ট পাচ্ছে সে? এসব নিয়ে ভাবার সময় কোথায় কার?
কথাগুলো একান্তই পারিবারিক। মেয়ে হারিয়ে মা-বাবার কষ্ট প্রকাশের একটা মাধ্যম হয়তো এসব ভিত্তিহীন অসংলগ্ন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কথাবার্তা। তাই আমি প্রত্যুত্তরে এতটুকু শব্দ করতেও নারাজ। কিন্তু এখন কথাগুলো পরিবারের সীমা পেরিয়ে লোকের ঘরে ঘরে বিনোদনের উৎস হিসেবে স্থান পেয়েছে। তাই আজ কিছু বলতে হলো।
এত স্বল্প পরিসরে সবটুকু বলে শেষ করা সম্ভব নয়। যদি সব বলতে বসি, তবে হয়তো একটা বই-ই হয়ে যেত।