বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম, তুমব্রু এবং উখিয়ার রহমতেরবিল ও আনজুমানপাড়া সীমান্তের পরিবেশ এখন অনেকটা শান্ত। তবে শান্তিতে নেই টেকনাফ সীমান্তবাসী। প্রচণ্ড গোলার শব্দে আতঙ্ক কাটেনি তাদের। বিদ্রোহী গ্রুপ আরাকান আর্মির সাথে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীদের মধ্য চলমান যুদ্ধে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ সীমান্তে থেমে থেমে গুলির শব্দ ভেসে আসছে।
সীমান্তের ওপারে যুদ্ধ তীব্র হওয়ায় প্রাণ বাঁচাতে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে রোহিঙ্গারা। তবে সীমান্তে বিজিবি ও কোস্টগার্ড নাফ নদীতে টহল জোরদার রেখেছে।
রোববার (১৮ ফেব্রুয়ারি) সকাল ৮টা থেকে টেকনাফ শাহপরীর দ্বীপ সীমান্তে গোলাগুলির শব্দ শুনতে পেয়েছেন স্থানীয়রা। শনিবার দিবাগত রাত ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত টেকনাফের হোয়াইক্যং কানজরপাড়া-খারাংখালী এলাকায় বিকট গুলির শব্দ শুনেছেন লোকজন।
এ বিষয়ে কোস্ট গার্ড চট্রগ্রাম পূর্বজোনের মিডিয়া কর্মকর্তা বলেন, ‘অনুপ্রবেশ রোধে নাফ নদীতে আমাদের টহল জোরদার করা হয়েছে। আমরা ২৫ জানুয়ারি থেকে ১৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ২ শতাধিকের বেশি রোহিঙ্গাকে প্রতিহত করেছি। সর্বশেষ গতকাল তিনজনকে শাহপরীর দ্বীপ থেকে ফেরত পাঠানো হয়েছে।’
টেকনাফের হোয়াইক্যং সীমান্তের বাসিন্দা মোহাম্মদ সাইফুল বলেন, ‘শনিবার রাতে আমাদের সীমান্তে দুই ঘণ্টা থেমে থেমে গোলাবর্ষণ চলছিল। এপারের ঠিক ওপারে বলিবাজারে আরাকান আর্মির সাথে সেনাবাহিনীদের মধ্য চলমান যুদ্ধে এখনো চলমান রয়েছে। যার কারণে এপারে গোলার শব্দ পাওয়া যায়।’
এদিকে রোববার সকাল থেকে শাহপরীর দ্বীপ সীমান্তে থেমে থেমে মিয়ানমারের গোলার শব্দ এপারে শুনতে পায় সীমান্তের লোকজন।
শাহপরীর দ্বীপ সীমান্তের বাসিন্দা আমান উল্লাহ বলেন, ‘রাতে গোলার শব্দ পাওয়া না গেলেও রোববার সকাল ৮টা থেকে মিয়ানমার সীমান্তের গোলার আওয়াজ বাড়ি পর্যন্ত পাওয়া গেছে। জীবনে এমন গুলির আওয়াজ কোনো সময় পাইনি আমরা। গোলার এমন ভয়ঙ্কর আওয়াজ ছিল, আমার দেড় বছরের শিশু সন্তান ভয়ে ঘুম ভেঙে কেঁদে উঠে। কয়েকদিন ধরে যে গোলার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে, শিশুদের জন্য খুবই আতঙ্কের।’
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো: আদনান চৌধুরী বলেন, ‘সীমান্তে প্রায় সময় গোলাগুলির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু সীমান্তে নাফ নদী থাকার কারণে আমরা অনেকটা ‘সেফ জোন’ আছি। তবুও আমরা সীমান্তের বসবাসকারীদের সর্তক থাকতে বলেছি।’
সীমান্তের বাসিন্দারা বলছেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি ও সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষের জেরে গত শনিবার বিকেলে টেকনাফ শাহপরীর দ্বীপ জেটিঘাটে গুলিবিদ্ধ রোহিঙ্গা নারীসহ ৫ জন আসে। পরে তাদের ফেরত পাঠানে হবে বলে জানানো হয়।
শাহপরীর দ্বীপ সীমান্তের ওপারে কাদিরবিল, নরবনিয়া, নয়াপাড়া, নুরুল্লা পাড়া, বাগগুনা, পংদা ও পাতনজা এলাকায় যুদ্ধ চলছে। তাই সেসব গ্রামের বসবাসকারী রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। শাহপরীর দ্বীপ সীমান্ত সড়কস্থল নাফ নদী তীরের লাগোয়া বাজারপাড়া, জালিয়াপাড়া, মিস্ত্রিপাড়া ও গোলাপাড়া। এসব এলাকায় প্রায় ১০ হাজার মানুষের বসবাস।
শাহপরীর দ্বীপ মিস্ত্রিপাড়ার বাসিন্দা আলী আকবর (৪৭) বলেন, ‘নাফ নদীতেই আমাদের বেড়ে উঠা। এখানে বাপ-দাদাদেরও জীবন কেটেছে। মিয়ানমার সীমান্তের ওপারে আজকেও ব্যাপক গোলাগুলির শব্দ শুনা গেছে। কিন্তু অন্যদিনের চেয়ে আজ একটু কম।’
টেকনাফ শাহপরীর দ্বীপ ৯ নাম্বার ওর্য়াডের ইউপি সদস্য আব্দুস সালাম বলেন, ‘মিয়ানমার সীমান্তে এখনো গোলাগুলি বন্ধ হয়নি। গতকাল গুলিবিদ্ধ নারীসহ পাঁচজন রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশ জল সীমানায় ঢুকে পরেছিল।’
মিয়ানমারের রাখাইনে সেনাবাহিনী ও বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির মধ্যে লড়াইয়ের মুখে প্রাণে বাঁচতে রোহিঙ্গারা নিজেদের আদি নিবাস ছেড়ে রাজ্যের নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে। এই পরিস্থিতিতে দুই দেশের সীমান্ত এলাকায় আসা কয়েক শ’ রোহিঙ্গাকে মানবিক কারণে আশ্রয় দিতে বাংলাদেশকে অনুরোধ করেছে জাতিসঙ্ঘ। কিন্তু বাংলাদেশ স্পষ্ট করেই জানিয়েছে, নতুন করে কোনো রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেয়া সম্ভব নয়।
চলতি মাসের শুরু থেকে মিয়ানমারের রাখাইনে সেনাবাহিনী ও বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির মধ্যে লড়াইয়ের তীব্রতা বাড়তে থাকে। দুই দেশের সীমান্ত এলাকা বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি এবং কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ থেকে ওপারের গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে।
সীমান্তের ওপারে লড়াই চলছে।
টেকনাফের স্থানীয়রা জানিয়েছেন, শাহপরীর দ্বীপ ও সেন্ট মার্টিন ইউনিয়নের সীমান্তের ওপার থেকে গত শুক্রবার রাত থেকে রোববার (১৮ ফেব্রুয়ারি) পর্যন্ত থেমে থেমে গুলির শব্দ শোনা গেছে। শনিবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) বিকেল ৫টার দিকে নাফ নদী হয়ে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ জেটিঘাটে একটি নৌকা ঢুকে পড়ে বলে জানা গেছে। স্থানীয় লোকজন বলছেন, নৌকায় পাঁচজন রোহিঙ্গা আছে। তাদের মধ্যে একজন গুলিবিদ্ধ।
শাহপরীর দ্বীপ জেটিঘাটে প্রবেশপথে লোকজনের ভিড়। বিজিবির সদস্যরা কাউকে ঢুকতে দিচ্ছেন না। নৌকায় করে আসা ব্যক্তিদের বিষয়ে বিজিবির আনুষ্ঠানিক বক্তব্য পাওয়া যায়নি। সঙ্ঘাত থেকে বাঁচতে চাওয়া লোকজনের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার স্বার্থে ইউএনএইচসিআর অব্যাহতভাবে বাংলাদেশের সাথে কাজ করে যাবে। বাংলাদেশে প্রবেশের জন্য দুই দেশের সীমান্তের ১৯টি পয়েন্টে অপেক্ষমাণ প্রায় ৯০০ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেয়ার আহ্বান জানান জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) প্রতিনিধি সুম্বল রিজভী। তিনি মানবিক কারণে অপেক্ষমাণ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার অনুরোধ জানান।
বর্তমানে রাখাইনের গৃহযুদ্ধের ব্যাপকতা এবং আরাকান আর্মির একের পর এক শহর দখল অব্যাহত থাকার প্রেক্ষাপটে সেখানকার লড়াই থামার কোনো সম্ভাবনা নেই। ফলে নতুন করে যেসব রোহিঙ্গা আসবে, তারা কবে ফিরবে বা আদৌ ফিরতে পারবে কিনা, সেটাই বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।
২ ফেব্রুয়ারি রাত থেকে সীমান্তের ওপারে রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সাথে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির লড়াই চলছে। ৫ ফেব্রুয়ারি বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুমে সীমান্তের ওপার থেকে আসা মর্টার শেলের আঘাতে দুজন নিহত হন। নিহত দুজনের মধ্যে একজন বাংলাদেশী নারী, অন্যজন রোহিঙ্গা পুরুষ। দুই পক্ষের সংঘর্ষে ইতোমধ্যে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যসহ দেশটির ৩৩০ জন বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছিল। ১৫ ফেব্রুয়ারি সকালে তাদের মিয়ানমারে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারে সেনা অভিযানের মুখে রাখাইন রাজ্যে বাস্তুচ্যুত প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গা টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে। বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয় শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। গত ছয় বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি।