সংলাপে অনীহা, কোন পথে রাজনীতি

Slider বাধ ভাঙ্গা মত


দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর মাত্র ৪ মাসের মতো বাকি। এই সময়ে দেশে নির্বাচনী হাওয়া থাকার কথা থাকলেও পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিলেও বিরোধী দলগুলো নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে রাজপথে চূড়ান্ত পর্যায়ের আন্দোলনের দিকে এগোচ্ছে। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ বলছে, সংবিধান অনুযায়ীই নির্বাচন হবে। অন্য দিকে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো বলছে, আওয়ামী লীগের অধীনে অতীতের কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু হয়নি। এবারও সুষ্ঠু হবে না। এজন্য নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনেই নির্বাচন হতে হবে। এই অবস্থায় আন্তর্জাতিক মহল ও দেশীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা সংলাপের ওপর গুরুত্বারোপ করলেও সরকারি দলের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, নিরপেক্ষ সরকারের প্রশ্নে কোনো সংলাপ হবে না। অন্য দিকে বিএনপি ও সমমনাদলগুলোর পক্ষ থেকেও বলা হচ্ছে, একমাত্র নির্বাচনকালীন সরকার ছাড়া কোনো সংলাপ হবে না। এভাবে নির্বাচন সামনে রেখে সংলাপ-সমঝোতা প্রশ্নে ক্ষমতাসীন এবং ক্ষমতার বাইরে থাকা দলগুলোর অনড় অবস্থানে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বড় ধরনের সংঘাত ও সহিসংতার দিকে এগোচ্ছে বলেই আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।

সুশীলসমাজের প্রতিনিধি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারের কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বলেন, নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর মুখোমুখি অবস্থানের কারণে আমরা সহিসংতা এবং এক দলীয় নির্বাচনের দিকে ধাবিত হচ্ছি। রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, রাজপথে সমাধান করবে তারা। কিন্তু রাজপথে কোনো সমাধান হয় না। সমাধান করতে হলে আলোচনার টেবিলেই বসতে হবে।

সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, দেশের রাজনীতিবিদদের একগুঁয়েমির কারণে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। আগামী দুই মাস পরে দেশের রাজনীতি ও অর্থনৈতি দুটোই প্রায় অচল হয়ে পড়বে।

নির্বাচন সংশ্লিষ্টরা বলছে, নির্বাচন কমিশন (ইসি) জানুয়ারিতে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিলেও মাঠের বর্তমান রাজনীতির গতিবিধি ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। সংবিধানের মধ্যে থাকার কথা বলে সরকারি দল নিজেদের অধীনেই নির্বাচন করতে চায়। সেক্ষেত্রে বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নের সমাধান কী হবে- এখনো নিশ্চিত করে কেউই বলতে পারছে না। বিএনপির পক্ষ থেকে বরাবরই বলা হচ্ছে এবার দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে দেয়া হবে না। দলটি সমমনাদের নিয়ে ধারাবাহিকভাবে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করে আসছে। চলতি অক্টোবর মাসেই দাবি আদায়ে জোরালো কর্মসূচিতে যাবে বলে জানা যাচ্ছে। নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে সমঝোতা ছাড়া একতরফা নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর বিএনপি জোট বড় ধরনের কর্মসূচিতে যাবে বলেও জানা যাচ্ছে।

তবে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সর্বশেষ সাংবাদিক সম্মেলন এবং দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য থেকে অনেকে মনে করছেন সরকারি দল বিরোধী দলের আন্দোলনের মুখে নির্বাচনকালীন সরকারের দাবি মানতে রাজি নন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনের কথা বলে আসছে। এমনকি এই ধরনের নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাধা দিলে ভিসানীতি প্রয়োগের ঘোষণাও দিয়ে তা প্রয়োগও শুরু করেছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার যে নির্বাচনকালীন সরকারের দাবি মানতে রাজি নয় তা গত সোমবার বনানীতে হোটেল শেরাটনে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী প্রাক-প্রতিনিধিদলের সাথে বৈঠক শেষে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য থেকে বোঝা যায়। বৈঠক শেষে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি দল জানতে চেয়েছে, সমঝোতা ও সহাবস্থানের সুযোগ আছে কি না। জবাবে আমরা বলেছি, সে সুযোগ বিএনপি রাখেনি। তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ চায়, মৃত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আনতে চায়, নির্বাচন কমিশন বাতিল এবং সংসদের বিলুপ্তি চায়। এসব করা সম্ভব নয়। নির্বাচন নিয়ে সমঝোতার কোনো সুযোগ নেই। সংবিধান লঙ্ঘন করে বিএনপির সঙ্গে সমঝোতা করা যায় না।

অন্যদিকে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, একটা বিষয়ে আলোচনা বা সংলাপ হতে পারে। এছাড়া আর কোনো আলোচনা বা সংলাপ হবে না। আর সেটা হচ্ছে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের বিষয়ে। বর্তমানে সব প্রাক নির্বাচনী পর্যবেক্ষকরা দেশে আছেন তারা আগামী নির্বাচনের পর্যবেক্ষক পাঠাবে কি পাঠাবে না সে বিষয়ে কথা বলছেন। দেশে নির্বাচনী কোনো পরিবেশ পরিস্থিতি আছে কি না সেটা দেখার জন্য তারা এসেছেন। বিএনপির পক্ষ থেকে পরিষ্কারভাবে তাদের জানানো হয়েছে, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা দেয়া ছাড়া, এ অবস্থায় দেশে কোনো নির্বাচন হতে পারে না। শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচন হতে পারে না। সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। সংসদকে বিলুপ্ত করতে হবে।

বিএনপিসহ বিরোধীদলগুলো মনে করছে, আওয়াম লীগ সরকার আগের ১৪ এবং ১৮ সালের মতো নির্বাচন করে পুনরায় ক্ষমতায় আসতে চায়। এ কারণে এবার দলীয় সরকারের অধীনে তারা কোনোভাবেই নির্বাচনে অংশ নেবে না বলে পরিষ্কারভাবে আগে থেকেই বলে আসছে। দুই পক্ষের এই অনমনীয় মনোভাবের মধ্যেই বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে বিদেশ পাঠানো নিয়ে প্রসঙ্গ সামনে আসে। প্রথমে মনে করা হয়েছিল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন গুরুতর অসুস্থ বেগম জিয়াকে বিদেশে নেয়ার ব্যাপারে সরকারি দল নমনীয়। কিন্তু পরে সরকারি দলের পক্ষ থেকে যেসব বক্তব্য আসে তাতে পরিষ্কার হয়ে ওঠে সরকারি দল এ ব্যাপারে নমনীয় নয়। বেগম জিয়া বিদেশে যাওয়ার অনুমতি পাননি।

এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে দেশের রাজনীতির গতিপথ ও ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি নিয়ে দেশের সুশীলসমাজসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কাজ করছে। অতি সম্প্রতি সুশাসনের জন্য নাগরিক- সুজন আয়োজিত এক সংলাপে সুশীলসমাজের প্রতিনিধিরা বলেছেন, এই উদ্বেগের কথা ব্যক্ত করে বলেছেন, পরিস্থিতি উত্তরণের জন্য রাজনৈতিক সংলাপ ও সমঝোতার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু এই সংলাপ ও সমঝোতা প্রশ্নে সরকারি দল ও বিরোধীদলের শর্তযুক্ত বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তাদের অনীহার মনোভাবই ফুটে উঠে বলে মনে করা হচ্ছে।

তবে আবার অনেকে বলছেন, অতীতের যেকোনো নির্বাচনকালীন সময়ের তুলনায় এবারের নির্বাচনকালীন সময়টা ভিন্নরূপ নিতে পারে। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব কোনোভাবেই এবার ২০১৪ ও ২০১৮ সালের স্টাইলের নির্বাচন হোক এটি চাচ্ছে না। তাদের নানা ধরনের তৎপরতা ও কার্যক্রম থেকে এটা পরিষ্কার বোঝা যায়। এই প্রেক্ষিতে এবারের নির্বাচনকে ঘিরে সামনের দিনগুলোতে কোনো ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে এ নিয়ে সাধারণ মানুষসহ সর্বমহলে নানা ধরনের আলোচনা রয়েছে। অনেকে মনে করছেন, এবার বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো অনেকটাই আটঘাট বেঁধেই শেষ মুহূর্তে রাজপথে নেমে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনকে ঠেকানোর চেষ্টা করতে পারে। সেক্ষেত্রে সংলাপ সমঝোতায় না গেলে সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে। তাতে জানমালের ক্ষতি ছাড়াও দেশের অর্থনীতিও মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার পরিস্থিতির ব্যাপারে বলেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর মুখোমুখি অবস্থানের কারণে আমরা সহিসংতা এবং একদলীয় নির্বাচনের দিকে ধাবিত হচ্ছি। নাগরিক সমাজ ওয়াচডগ হিসেবে কাজ করে। কাউকে ক্ষমতায় বসানো বা ক্ষমতাচ্যুত করা আমাদের কাজ নয়। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর স্বার্থপর মানুসিকতার জন্য এমন অনিশ্চিয়তা তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো বলছে রাজপথে সমাধান করবে। কিন্তু রাজপথে কোনো সমাধান হয় না। সমাধান করতে হলে আলোচনার টেবিলেই বসতে হবে।

এ ব্যাপারে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক এ ব্যাপারে বলেন, বর্তমানে বিশ্বের ২০টি অধিক দেশে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করছে। বাংলাদেশও সেই পথে এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের একগুঁয়েমির কারণে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। একদলের ক্ষমতা হারানোর ভয় আরেক দলের ক্ষমতায় যাওয়ার লালসার কারণে পিষ্ট হচ্ছে সাধারণ মানুষ। আগামী দুই মাস পরে দেশের রাজনীতি এবং অর্থনীতি দুটোই প্রায় অচল হয়ে পড়বে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *