গত দু’টি নির্বাচন নিয়ে দেশ ও আন্তর্জাতিক মহলে নানা প্রশ্ন রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা বিশ্ব বাংলাদেশে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠানের জন্য বছরের শুরুতেই সরকারকে নানাভাবে চাপ দিয়ে আসছে। ব্যাপক তৎপরতার মধ্যেই আওয়ামী লীগ সরকারও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠানের কথা বলে আসছে। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বকে সুষ্ঠু নির্বাচনের আশ্বাস দেয়ার পরও বাংলাদেশের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের ভিসানীতি প্রয়োগ শুরু করায় নতুন করে ভাবাচ্ছে ক্ষমতাসীনদের।
যদিও দলটির শীর্ষ নেতারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি ঘোষণা করার পর থেকেই এটাকে কোনোভাবেই আমলে নিতে চাইছেন না। যুক্তরাষ্ট্রের স্যাংশনের পর পাল্টা স্যাংশন দেয়ার কথাও বলছেন আওয়ামী লীগ নেতাদের কেউ কেউ। গেল শনিবার সিঙ্গাপুর থেকে চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি ও নিষেধাজ্ঞার পরোয়া করে না আওয়ামী লীগ।
দলটির নেতারা মনে করেন, মার্কিন ভিসানীতি শুধু আওয়ামী লীগের জন্য নয়। এটি বিরোধী দলের জন্যও প্রযোজ্য; অর্থাৎ যারা সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধা দেবে তাদের ওপর ভিসানীতি প্রয়োগ হবে। তবে এই ভিসানীতি কার্যত সরকার ও সরকারের স্টেক হোল্ডারদের ওপর প্রয়োগ হচ্ছে বলে বিভিন্ন মহল থেকে এমনটি জানা গেছে। গতকাল ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) উপকমিশনার (মিডিয়া) ফারুক হোসেন সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, আমেরিকার ভিসানীতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্যের ওপর আরোপ করা হয়েছে, তবে তারা কারা তা জানি না। যদি ভিসানীতি আসে তারা হয়তো দেশটিতে যেতে পারবেন না।
আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ দেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। আওয়ামী লীগ সরকারও এ দেশে আগামী নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়ার কথা বলে আসছে। এ পর্যন্ত কূটনৈতিক মহলে যতগুলো বৈঠক হয়েছে তার সবগুলো বৈঠকে সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়ার আশ্বাস দিয়ে আসছে দল ও সরকার। তার পরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে নতুন করে ভিসানীতি প্রয়োগের ঘোষণা দেয়ায় একটা রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আসলে এ দেশে কী চায়? বিশেষ কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এই ভিসানীতি প্রয়োগ করা হচ্ছে কি না- এটাও এখন ভাববার বিষয়। খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসঙ্ঘের অধিবেশন শেষে গত শুক্রবার নিউ ইয়র্কে জাতিসঙ্ঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আশা করি, যে দেশ ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে তারা উভয়পক্ষ থেকে বা নিরপেক্ষভাবে বিষয়টি বিবেচনা করবে। তবে শুধু আওয়ামী লীগকে টার্গেট করলে কিছু বলার নেই।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, কে স্যাংশন দিলো কি দিলো না তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না। আমরা সুষ্ঠু নির্বাচন চাই। আমি মনে করি, এ দেশে যারা সুষ্ঠু নির্বাচন চায় না তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে উৎসাহিত করছে এ ধরনের ভিসানীতি ও নিষেধাজ্ঞা দেয়ার জন্য। কারণ ভিসানীতি প্রয়োগের ঘোষণার পরই বিএনপি ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথাবার্তা বলছে, তারা উৎফুল্ল হয়ে পড়েছে। তিনি আরো বলেন, বিএনপি-জামায়াত সুষ্ঠু নির্বাচন চায় না বলে নির্বাচন বানচাল করার ষড়যন্ত্র করছে। তারা বিভিন্নভাবে প্রচ্ছন্ন হুমকি দিচ্ছে। দেশের জনগণের আস্থা বিশ্বাস গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নস্যাৎ করে স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে উৎসাহিত করলে, বিএনপি-জামায়াত আবারো অগ্নি সন্ত্রাস করলে তাদের কঠোরভাবে প্রতিহত করা হবে।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে সরকার পতনের এক দফা আন্দোলন করছে বিএনপি ও তার মিত্ররা। এদিকে সংশোধিত সংবিধানের আলোকে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানে অনড় রয়েছে আওয়ামী লীগ এবং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য পুরো প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে দলটি। এই প্রেক্ষাপটে এ বছরের শুরু থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা বিশ্বের বেশ কয়েকটি রাষ্ট্র ও সংস্থা বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চায় বলে সরকারকে জানিয়ে আসছে। সরকারের আশ্বাসের পরও গত ২৪ মে বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র। এতে বলা হয়, বাংলাদেশে নির্বাচন জালিয়াতি ও নির্বাচন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করার সাথে যারা জড়িত থাকবেন তাদের যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা দেয়া হবে না।
ভিসানীতি দেয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করে সরকার। চলতি মাসে ভারতে অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সেলফি দেখে উজ্জীবিত হয় কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। এর সুফলও ঘরে তুলতে চায় কেন্দ্রীয় নেতারা। কিন্তু সরকার প্রধান জাতিসঙ্ঘ সাধারণ অধিবেশনে যোগ দেয়াবস্থায় গেল শুক্রবার বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের পদক্ষেপ নেয়া শুরুর কথা জানায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার এক বিবৃতিতে এ সিদ্ধান্তের কথা জানান। এ ঘোষণায় আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা এখন অনেকটা হতাশ হয়ে পড়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক নেতার সাথে আলাপকালে জানা গেছে।
তাদের মতে, আওয়ামী লীগের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক দীর্ঘদিন থেকে ভালো যাচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি দিলেও দলের মধ্যে তেমন সমস্যা হয়নি। শেষমেশ ভারতে অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলনে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সেলফি তুলে বড় উদারতার পরিচয় দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এটা বেশ প্রভাব পড়তে থাকে। আওয়ামী লীগের সব পর্যায়ের নেতাকর্মীর মনোবল চাঙা হয়ে উঠে এবং নির্বাচনী প্রস্তুতি নতুন করে শুরু হয়। কিন্তু ভিসানীতির প্রয়োগ শুরু হওয়ায় দলটির তৃণমূল থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ে কিছুটা ভাটা পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পর ইউরোপীয় ইউনিয়নও নিষেধাজ্ঞা বা কঠোর ব্যবস্থার পথে গেলে বিপদে পড়তে হবে বলে মনে করেন সরকারি দলের নেতাদের কেউ কেউ। সে রকম কিছু ঘটলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হয়ে যেতে পারে বলেও আশঙ্কা রয়েছে।
তবে সব পরিস্থিতি সামাল দিয়ে সংবিধান অনুযায়ী যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিকল্প নেই বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন। তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, আমরা আমাদের নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছি। অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে যেভাবে নির্বাচন হয় আমাদের দেশেও সেভাবে নির্বাচন হবে। ওই নির্বাচনে আমরা আশা করি, দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে জনগণ আওয়ামী লীগকে বেছে নেবে।