মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টি হলেই রাজধানীর অধিকাংশ এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে। গত শনিবার বিকালে ঢাকা মহানগরীতে ৯১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। তাই ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটির অনেক জায়গায় ৫ থেকে ৬ ঘণ্টার জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। এতে বিপাকে পড়েন নগরবাসী। ঘর থেকে বের হওয়া ও নানা কাজে বাইরে যাওয়া মানুষের ভোগান্তি ছিল চরম পর্যায়ে।
প্রত্যেক অর্থবছরেই ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন জলাবদ্ধতা নিষ্কাশনে বিপুল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ রাখে। সে বরাদ্দ মাফিক কাজও হয়, কিন্তু ভোগান্তি যায় না। তাই নগর পরিকল্পনাবিদসহ ঢাকাবাসী প্রশ্ন তুলেছেন, নাগরিকদের স্বস্তি দেয়ার জন্য নাকি উন্নয়নের নামে অর্থ ব্যয় করার জন্য বড় বড় প্রকল্প নেয়া হয়।
ডিএসসিসি বলছে, নিষ্কাশনের মুখগুলো প্লাস্টিক, ডাবের খোসাসহ ভারি বর্জ্যে আটকে যাওয়ায় পানি নামতে সময় লাগছে। অন্যদিকে ডিএনসিসি এটিকে জলাবদ্ধতা বলতে নারাজ। উত্তর সিটিতে এর চাইতে বেশি বৃষ্টি হলেও জলাবদ্ধতা হবে না বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
তবে নগর পরিকল্পনাবিদরা মনে করেন, দায় সিটি করপোরেশনকেই নিতে হবে। নালা, নর্দমার মুখ যদি আটকেও থাকে সেটি
পরিষ্কার করার দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। তারা আগে থেকে প্রস্তুতি না নিলে বর্ষা মৌসুমে এটা হবেই। তাছাড়া যেভাবে ঢাকার উন্নয়ন হয়েছে তাতে জলাবদ্ধতা এখন নিত্যদিনের সঙ্গী করে নিতে হবে বলেও মনে করেন নগর পরিকল্পনাবিদরা।
আবহাওয়া অফিসের তথ্যমতে, শনিবার রাজধানী ঢাকায় সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ৯১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এই মাঝারি মানের বৃষ্টিতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকার অনেক সড়ক পানির নিচে ডুবে যায়। পরবর্তী ৫ থেকে ৬ ঘণ্টার মধ্যেও জমে থাকা পানি নামেনি।
অথচ ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশন নালা, নর্দমা পরিষ্কার করার নামে প্রতি অর্থবছরই আলাদা বরাদ্দ দিয়ে যাচ্ছে। জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ থেকে মুক্তি দিতে ১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে দুই বছরের বেশি সময় আগে থেকে নালা সংস্কারের কাজ করে আসছে ডিএসসিসি। প্রকল্পের টাকা খরচ হলেও তার সুফল পাচ্ছে না রাজধানীবাসী। গত কয়েক দিনের বৃষ্টিতে পুরান ঢাকার কাজী আলাউদ্দিন রোড ও আশপাশের এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়।
দক্ষিণ সিটির প্রকৌশল বিভাগের তথ্যানুযায়ী, কাজী আলাউদ্দিন রোড, আগা সাদেক রোডসহ আশপাশের সড়কের পানি সরাতে তারা নতুন করে আরেকটি সংযোগ লাইন করার পরিকল্পনা করেছে। ওই সংযোগ লাইনের কাজ শেষ হলে এসব এলাকার পানি বুড়িগঙ্গা নদীতে গিয়ে পড়বে। এতে ব্যয় হবে আরও ১৭ কোটি টাকা। কাজটি শেষ হলে পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের জলাবদ্ধতার ভোগান্তি স্থায়ীভাবে ঘুঁচবে।
গত কয়েক দিনের বৃষ্টিতে পূর্ব জুরাইনের মেডিকেল রোড, কুসুমবাগ, চেয়ারম্যানবাড়ি, নবীনবাগ, মিষ্টির দোকান ও আশ্রাফ মাস্টার স্কুল এলাকার বিভিন্ন সড়ক কোমর সমান পানিতে তলিয়ে যায়। কোনো কোনো জায়গায় এখনো জলাবদ্ধতা রয়ে গেছে।
জুরাইন মেডিকেল রোডের বাসিন্দা দেলোয়ার হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, দীর্ঘ ১২ বছর ধরে এই এলাকার রাস্তার কোনো কাজ হয় না। ঘর থেকে বের হলেই হাঁটু পানি। সিটি করপোরেশন কাজ ধরব ধরব বলে ধরে না। এই এলাকার মেডিকেল রোড, পোকার বাজার, হাইস্কুল রোড, বাগিচা রোড, নোয়াখালী পট্টির খুব বাজে অবস্থা। বাচ্চারা স্কুল-মাদ্রাসায় যেতে পারে না।
তাছাড়া নিউমার্কেট ও ধানমন্ডি-২৭ নম্বর এলাকার সড়কে অনেকক্ষণ পানি জমে ছিল। ধানমন্ডির জিগাতলা, গ্রিন রোড, পুরান ঢাকার বংশাল, আগা সাদেক রোড, আবুল হাসনাত রোডসহ আশপাশের এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাশের সড়ক ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রধান ফটক এলাকায় মধ্যরাত পর্যন্ত পানি জমে ছিল।
অথচ গত ১৪ জুন বংশাল এলাকার ৩২ নম্বর ওয়ার্ডে সামসাবাদ খেলার মাঠের উদ্বোধন শেষে গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে ডিএসসিসির মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেছিলেন, ‘সময়োপযোগী পদক্ষেপের কারণে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন এলাকার জলাবদ্ধতা ৭০ থেকে ১০ ভাগে নেমে এসেছে। কিছু কিছু বিচ্ছিন্ন জায়গা ছাড়া এখন আর জলমগ্নতা নেই।’ দক্ষিণ সিটির যেসব কাজ চলমান, সেগুলো শেষ হলে আগামী মৌসুমে আর জলাবদ্ধতা থাকবে না বলেও আশ্বাস দেন তিনি।
এদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বর, বেগম রোকেয়া সরণি, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, ভাষানটেক, কল্যাণপুর, কারওয়ান বাজার, নাখালপাড়া, ইব্রাহিমপুর, মোহাম্মদপুরসহ বেশ কিছু এলাকায় পানি জমে ছিল। তবে রাত ৯টার দিকে বেশির ভাগ এলাকার পানি রাস্তা থেকে সরে যায়। জলাবদ্ধতা নিরসনে ডিএনসিসির কুইক রেসপন্স টিম প্রস্তুত থাকে। বৃষ্টির মধ্যে তারা নর্দমার পিটগুলো খুলে দেয়, ফলে দ্রুত পানি নেমে যায়।
উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় পানি জমে থাকলেও জলাবদ্ধতা হয়নি বলে দাবি করে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. সেলিম রেজা আমাদের সময়কে বলেন, গত কয়েক দিনে অতি বৃষ্টিতে কোথাও কোথাও পানি জমে ছিল; তবে এটিকে আমরা সেই অর্থে জলাবদ্ধতা বলি না। আমাদের কর্মীরা মাঠে ছিল, আমরাও মাঠে ছিলাম। রাস্তার পিটগুলো খুলে দেওয়ায় এক থেকে দেড় ঘণ্টার মধ্যে পানি নেমে গেছে।
তিনি বলেন, এর চাইতে বেশি বৃষ্টি হলেও জলাবদ্ধতা হবে না। আমরা সেভাবেই প্রস্তুতি নিয়েছি। কোথাও পানি জমে থাকলে পাম্প মেশিনের মাধ্যমে তা অপসারণ করা হবে। আমাদের ভালো প্রস্তুতি আছে। আশা করি জলাবদ্ধতা হবে না।
জলাবদ্ধতা নিয়ে ডিএসসিসির মুখপাত্র ও জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আবু নাছের আমাদের সময়কে বলেন, দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় যেসব জায়গায় জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে সেগুলোর দুটি কারণ চিহ্নিত। প্রথমত গত কয়েক দিন অব্যাহত বৃষ্টির ফেলে বৃষ্টির পানি যেখানে নেমে যাবে সে জায়গার পানির স্তর উপরে উঠে গেছে। তাই খুব ধীরগতিতে পানি নামছে। দ্বিতীয়ত, যেসব নালা-নর্দমা দিয়ে বৃষ্টির পানি গড়িয়ে খাল, জলাশয় বা নদীতে নামবে, সে নালা বা নর্দমার মুখ প্লাস্টিকের বোতল, ডাবের খোলা, পলিথিনের ব্যাগে আটকে গেছে। যে কারণে সেখানে বড় একটা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে। তাই শনিবারের বৃষ্টিতে বেশ কিছু জায়গায় জলাবদ্ধতা হয়েছে। তবে সিটি করপোরেশনের ত্বরিত পদক্ষেপের ফলে অল্প সময়ের মধ্যে পানি অপসারণ করা সম্ভব হয়েছে।
একটু ভারী বৃষ্টি হলেই ঢাকায় জলাবদ্ধতা হবে এটা মেনে নিয়েই চলার পরামর্শ দিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ও ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক আদিল মুহাম্মদ খান। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, সিটি করপোরেশন যদি বলে নালা-নর্দমার মুখ প্লাস্টিকের বোতলে আটকে গেছে, তাহলে সেটা পরিষ্কার করার দায়িত্ব কার? এসব দায় এড়ানো কথা বলে লাভ নেই।
তিনি বলেন, ঢাকা শহর ৮০ থেকে ৯০ ভাগ কংক্রিটে আচ্ছাদিত। এই অনিয়ন্ত্রিত উন্নয়ন ঢাকাকে ডোবাবেই। যেখানে একটি শহরে ৩০ থেকে ৩৫ ভাগ সবুজ এবং জলাশয় থাকার কথা, সেটা তো নেই। তাহলে বৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতা হবে এটা মেনে নিয়েই চলতে হবে। সিটি মেয়ররা ১০ ভাগে নামিয়ে আনার দাবি করেছেন, এগুলো অযৌক্তিক কথা। ঢাকা ওয়াসা থেকে খালগুলোর দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার পর প্রথম এক/দেড় বছর দুই মেয়র খাল উদ্ধার ও সংস্কারে ব্যাপক তৎপরতা দেখিয়েছেন। সে কার্যক্রম অনেকটা স্তিমিত হয়ে গেছে। ফলে জলাবদ্ধতা তো হবেই।
facebook sharing button
twitter sharing button
whatsapp sharing button