অতীত থেকে শিক্ষা নিতে চায় বিএনপি

Slider রাজনীতি


গত ১৬ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি। কিন্তু এর পর দীর্ঘ সময় কেন তারা ক্ষমতার স্বাদ নিতে পারেনি, রাজনীতির খেলায় কোথায় গলদ ছিল, তা এখন গভীরভাবে ভাবাচ্ছে দলটির নীতিনির্ধারকদের। ক্ষমতায় না আসতে পারার কারণ হিসেবে ঘুরেফিরে এসেছে ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের শাসনামল। আবার ২০১৪ সালের ভোট বর্জন এবং ২০১৮ সালে ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল কিনা এবং সরকারবিরোধী আন্দোলনের কৌশলে কোনো গলদ ছিল কিনা, তার নানা দিকও বিশ্লেষণ করে দেখছে বিএনপি। এ অবস্থায় অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে এগোতে চায় দলটি।

অতীত অভিজ্ঞতা, বর্তমান পরিস্থিতি এবং ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা মাথায় নিয়েই ২৭ দফা রূপরেখা প্রস্তুত করেছে বিএনপি। এ রূপরেখা সামনে রেখে এ মাসেই এক দফার আন্দোলনে নামছে দলটি। এই আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে চাপে রেখে দাবি আদায়ে মরিয়া হয়ে মাঠে নামার ছক কষেছে দলটি। ১ সেপ্টেম্বর বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আগেই দলটি চলমান আন্দোলনের ফসল ঘরে তুলতে চায়। সামনের দিনগুলোয় যেন আবার কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া না হয় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখছে বিএনপির থিংকট্যাংকরা।

চলমান পরিস্থিতিতে বিএনপির রাজনীতি কেমন হওয়া উচিত জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার আমাদের সময়কে বলেন, ‘মানুষ ভুল করে, ভুল করা অন্যায়। কিন্তু ভুল থেকে শিক্ষাগ্রহণ না করা মহা-অন্যায়। তারা যদি ভুল থেকে শিক্ষাগ্রহণ না করে তাহলে তাদের জন্য যেমন খারাপ হবে এবং পুরো জাতির জন্যই খারাপ হবে। বিএনপির ভবিষ্যৎ রাজনীতি হওয়া উচিত ইতিবাচক ও দুর্নীতিমুক্ত। কোনো রকম গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়- এমন কাজ থেকে বিরত থাকা উচিত।’

গত শনিবার গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে দলের আন্দোলন প্রসঙ্গে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘তারুণ্যের সমাবেশ হচ্ছে, সামনে আমাদের পদযাত্রার কর্মসূচি শুরু হবে। এক দফা আন্দোলন শুরু করব। আমরা হরতাল-অবরোধের মতো কোনো কর্মসূচি সচেতনভাবে চাচ্ছি না। আমাদের ভায়োলেন্সে যাওয়ার প্রশ্নই উঠতে পারে না। সরকার যদি কোনোভাবে ওইসব দিকে ঠেলে দেয়, তাহলে দায় সরকারের। শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলনটা করছি, শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলনে আমরা চূড়ান্ত পর্যায়ে যেতে চাই। আর চলমান সংকট সমাধানের দায়িত্ব সরকারের।’

বিএনপির নীতিনির্ধারণী নেতাদের পর্যবেক্ষণ হলো, কূটনৈতিক ব্যর্থতার কারণে চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ইসলামপন্থি দল হিসেবে পরিচিতি পাওয়া বিএনপি পশ্চিমাদের কাছে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করতে পারেনি। যার কারণে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন ঘিরে তুমুল আন্দোলনেও সফল হয়নি বিএনপি। যদিও ওই নির্বাচনের আগে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূতের মধ্যস্থতায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাদের বৈঠক হয়। কিন্তু দৃশ্যমান কোনো সমাধান না হওয়ায় বিএনপি আন্দোলন অব্যাহত রাখে। যদিও পরে এক অনুষ্ঠানে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, ‘সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার কথা বলে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে যত দ্রুত সম্ভব সবার অংশগ্রহণে জাতীয় নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এখন তা অস্বীকার করলেও দেশে-বিদেশে কেউই ওই নির্বাচন গ্রহণ বা সমর্থন করেনি।’ যদিও দলের মধ্যে এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা বা না করা এবং নির্বাচনের পরে কর্মসূচি প্রত্যাহার করা নিয়ে নানা বিতর্ক আছে।

কেউ কেউ মনে করেন, আওয়ামী লীগের প্রতিশ্রুতির ওপর বিশ^াস করা বিএনপির ভুল ছিল। তাদের মতে, এই আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে মামলাসহ নানা কারণে সাংগঠনিকভাবে আরও দুর্বল হয়ে পড়ে বিএনপি। এ অবস্থায় ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বছরে দুর্নীতির মামলায় সাজা হলে বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে যান। তখন মাঝি ছাড়া নৌকার মতো অবস্থায় পড়ে দলটি।

২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের বিষয়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে কথা হয়েছে এমন একজন নেতা আমাদের সময়কে বলেন, ‘২০১৮ সালে কারাবন্দি অবস্থায় যারা তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যেতেন, তাদের বড় অংশই নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পক্ষে ছিলেন। তারা কে কয়টা আসনে ভোট করবেন, তাই নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলতেন। আবার কেউ কেউ বলার চেষ্টা করতেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করাটা বিএনপির ভুল ছিল। এ কারণে সর্বশেষ ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বিএনপি। এখন তারাও বুঝতে পারছে ২০১৪ সালের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল।’ এ অবস্থায়ও দলের ভেতরের একটি অংশ আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যে কোনো সরকারের অধীনে অংশ নেওয়ার পক্ষে কৌশলে কাজ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

চলমান পরিস্থিতিতে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের নজর কাড়তে দৃশ্যমান বেশকিছু কাজও করছে দলটি। ভারতের সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক স্থাপন করতে দেশটির বিরুদ্ধে কোনো নেতিবাচক বক্তব্য দেওয়া থেকে বিরত রয়েছেন বিএনপি নেতারা। শুধু তাই নয়, সম্প্রতি ঘোষণা দেওয়া ২৭ দফা রূপরেখায় উল্লেখ করা হয়েছে, বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেওয়া হবে। বাংলাদেশ ভূখ-ের মধ্যে কোনো সন্ত্রাসী তৎপরতা বরদাশত করা হবে না এবং কোনো সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা আশ্রয়-প্রশ্রয় পাবে না। সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ ও উগ্রবাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অপব্যবহারের মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদকে রাজনৈতিক ঢাল বা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে এবং সন্ত্রাসবাদের তকমা লাগিয়ে ভিন্নমতের বিরোধী শক্তি এবং রাজনৈতিক বিরোধী দল দমনের অপতৎপরতা বন্ধ করা হলে প্রকৃত সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করা এবং আইনের আওতায় এনে শাস্তি প্রদান করা সম্ভব হবে বলে বিএনপির থিংকট্যাংকরা মনে করেন।

জানতে চাইলে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল আমাদের সময়কে বলেন, ‘পৃথিবীতে গণতন্ত্র সৃষ্টির পর থেকে কোনো দেশের সরকার শতভাগ সফল হয়েছে- এমন দেশের সংখ্যা বিরল। সেই দিক দিয়ে ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি সরকারেরও কিছু না পারার অক্ষমতা থাকা স্বাভাবিক। তবে সতর্ক থাকলে না পারা বিষয়গুলো এড়ানো যেত। যে ভুলগুলো ছিল, তা সংশোধনের মাধ্যমে নির্ভুল করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে প্রতিহিংসার রাজনীতির ধারেকাছে নেই বিএনপি। চলমান শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে ক্ষমতাসীনরা হামলা করলেও বিএনপি পাল্টাহামলা করছে না, নেতারাও প্রতিহিংসামূলক কোনো বক্তব্য দিচ্ছেন না।’ নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে, সেই নির্বাচনে জনগণের ভোটে ক্ষমতায় গেলে অতীত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশ পরিচলনা করবে বলেও জানান বিএনপির এই সিনিয়র নেতা।

দলীয় সূত্রে জানা যায়, খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর থেকে মধ্যপন্থি দলটি অতিমাত্রায় বাঁ দিকে ঝুঁকে পড়েছে। ফলে ডানপন্থি হিসেবে পরিচিত নেতারা এখন চাপে পড়েছেন। বিএনপি তার পূর্বের চিন্তায় পরিবর্তন এনে ২৭ দফা ঘোষণা করে।

বিএনপি নেতারা বলছেন, গণতন্ত্র, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে রাষ্ট্রের মালিকানা জনগণের হাতে ফিরিয়ে দেওয়াই তাদের লক্ষ্য। ক্ষমতায় গেলে বিএনপি ‘সংবিধান সংস্কার কমিশন’ গঠন করে বিতর্কিত সংশোধনী বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও সংবিধানে গণভোট ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করবে। নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করবে। প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের কোনো রাজনীতি করবে না।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের মূল্যায়ন, ২০০১ সালে ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারের সন্ত্রাসী হামলার পর সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয় পশ্চিমা বিশ^। ওই বছরই বাংলাদেশে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ঐক্যজোট ও জাতীয় পার্টি (না. মঞ্জু)- এই চার দল মিলে সরকার গঠন করে। এই সরকারের আমলেই দেশে জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদের উত্থান ঘটে। এর মদদদাতা হিসেবে সরকারের এমপি-মন্ত্রীসহ বিএনপি-জামায়াতের কয়েকজন নেতার সম্পৃক্ততার অভিযোগও গণমাধ্যমে আসে। ওই সময় র‌্যাব গঠন করে জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টাও করে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার। কিন্তু এসব মদদদাতার বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। যার কারণে আন্তর্জাতিক পরিম-লে প্রায় বন্ধুহীন হয়ে পড়ে বিএনপি। এতে কেবল প্রতিবেশী ভারতই বৈরী হয়নি; বিরাগভাজন হয় পশ্চিমা বিশ^ও। এমনকি যে চীনের সঙ্গে বিএনপির নেতৃত্বে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সুসম্পর্কের যে সূচনা ঘটেছিল, সেই চীনও বিএনপির বর্তমান রাজনীতিকে সুনজরে দেখছে না। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা, ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট ৬৩ জেলায় সিরিজ বোমা হামলা, চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধার এবং আরও কয়েকটি গ্রেনেড ও বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনা বিদেশি শক্তিধর দেশগুলো ভালোভাবে নেয়নি। কোনো কোনো দেশের সঙ্গে আস্থার সংকটও তৈরি হয়।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, ওই সব ঘটনা বিএনপিকে সামনে এগোনোর পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এ ছাড়া চারদলীয় জোট সরকারের আমলে সুশাসন, সুনীতি এবং সুসরকারের অভাব, মন্ত্রী-এমপিদের বিরুদ্ধে বড় বড় দুর্নীতির খবর গণমাধ্যমে এলে দলটির জনপ্রিয়তায় আঘাত লাগে। এ ছাড়া চারদলীয় জোট সরকারের কর্মকা-ে একমত না হওয়ায় বিএনপি থেকে বেরিয়ে যান কর্নেল (অব) অলি আহমেদসহ দলের বেশ কয়েক গুরুত্বপূর্ণ নেতা। তার আগে দলের প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব বি. চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। প্রগতিশীল চিন্তার অনেক নেতাকে তখনকার সরকারের আমলে নানা চাপে থাকতে হয়। অন্যদিকে অপেক্ষাকৃত অনেক জুনিয়র এমপি-মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী বা উপমন্ত্রী হলেও অনেক সিনিয়র নেতা খালেদা জিয়ার মন্ত্রিপরিষদে ঠাঁই পাননি। এতে দলের বড় একটি অংশের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। এসব বিষয়ও বিএনপির সাংগঠনিক শক্তিতে ফাঁক তৈরি করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *