শীর্ষ নেতাদের স্থগিত মামলা সচল হচ্ছে

Slider রাজনীতি


দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসছে, বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোর রাজপথের আন্দোলন তত জোরালো হচ্ছে। নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনসহ একগুচ্ছ দাবিতে একের পর এক রাজপথে কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে বিএনপি। প্রায় এক দশক পর গত শনিবার ঢাকায় বড় সমাবেশ করে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার ক্ষেত্র তৈরি করেছে জামায়াতে ইসলামী। আরও সিরিজ কর্মসূচির পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। এসব কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সামনে রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত হয়ে ওঠার আশঙ্কা গোয়েন্দাদের। যে কারণে ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি বিবেচনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোও সতর্ক। এরই অংশ হিসেবে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, পুলিশের ওপর হামলাসহ নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের ঘটনায় দায়ের হওয়া যেসব মামলা উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত রয়েছে, সেগুলো সচলের উদ্যোগ নিয়েছে পুলিশ।

পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, বিএনপি-জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের স্থগিত থাকা পুরনো মামলা সচলের নির্দেশ দিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। এসব মামলায় আসামি বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ ৫ শতাধিক নেতাকর্মী। এ ছাড়া জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষস্থানীয় নেতারা আসামিÑ এমন বেশ কিছু স্থগিত মামলাও সচলের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ২৫টি মামলা সচল করতে সংশ্লিষ্ট বিভাগের তদন্ত তদারক কর্মকর্তা বরাবর চিঠি দিয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটান পুলিশ (ডিএমপি)। এসব মামলার স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের আবেদন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
গত ১৬ মে ডিএমপির উপকমিশনার (ক্রাইম) শচীন চাকমা স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, আপনার বিভাগের আওতাধীন ফৌজদারি মামলার বিচার/তদন্ত কার্যক্রম উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত আছে। পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশনায় আদালতের আদেশে স্থগিত থাকা মামলাগুলো চালু করার জন্য জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বলা হলো।

ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (ক্রাইম) বিপ্লব বিজয় তালুকদার গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, যেসব মামলা আদালতের আদেশে স্থগিত আছে, সেই মামলাগুলোর তদন্ত শুরুর জন্য ডিএমপির পক্ষ থেকে আমরা চিঠি লিখেছি। অ্যাটর্নি জেনারেল বরাবর চিঠি দিয়েছি বেশ কিছু দিন আগে।

রাজনৈতিক মামলা চালুর ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের আবেদন করা হয়েছে ৪০টির বেশি মামলার। বিভিন্ন ধরনের মামলা আছে। অরাজনৈতিক মামলাও আছে। যে মামলা কোর্টের আদেশে তদন্ত স্থগিত আছে, সেসব মামলার তদন্ত চালুর ব্যাপারে এ উদ্যোগ। এ ক্ষেত্রে আমরা রাজনৈতিক কোনো দিক বিবেচনা করছি না।

সচলের উদ্যোগ নেওয়া ডিএমপির ২৫ মামলার তথ্য-উপাত্ত আমাদের সময়ের হাতে এসেছে। এসব নথি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এর ১৫টি মামলা দায়ের হয়েছে ২০১৩ সালে। বাকি ১০ মামলা দায়ের হয় ২০১৫ সালে। সর্বোচ্চ ৬ মামলা রয়েছে পল্টন থানার, মুগদা ও খিলগাঁও থানায় ৪টি ও ৩টি যাত্রাবাড়ী থানায়। এ ছাড়া রমনা, মতিঝিল, ডেমরা ও সবুজবাগ থানায় দুটি করে মামলা রয়েছে। এসব মামলার মধ্যে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে হওয়া ৬টি মামলার স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে তদন্ত করতে চায় পুলিশ।

বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, সরকার পুরনো মিথ্যা-বানোয়াট মামলাগুলো পুনরুজ্জীবিত করছে বিএনপি বা বিরোধী দলকে ঘায়েল করার জন্য। এটি সরকারের একতরফা নির্বাচনের ব্লু প্রিন্টের অংশ। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় পুলিশ বাহিনীর কিছুসংখ্যক অতিউৎসাহী সদস্য রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত। বিরোধী দলকে দমন করার সর্বশেষ অস্ত্র হিসেবে এই মিথ্যা মামলাকে ব্যবহার করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, এসব মামলার বিষয়ে আইনগত পদক্ষেপ যেটি নেওয়ার, সেটি নেব। তবে রাজনৈতিক বিবেচনায় মামলাগুলো করা হয়েছিল, আর রাজনৈতিক কারণেই মামলাগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করা হচ্ছে। তাই এসব মামলার মোকাবিলা আমরা রাজনৈতিকভাবেই করব। রাজপথে এসব মামলার ফয়সালা হবে।

২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানায় বিস্ফোরক আইনে মামলা দায়ের করে পুলিশ। হাইকোর্টের নির্দেশে স্থগিত থাকা এ মামলার আসামিরা হচ্ছেনÑ বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, অ্যাডভোকেট শামসুর রহমান শিমুল বিশ^াস, অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী, বরকত উল্লাহ বুলু, আমানউল্লাহ আমান ও সালাহউদ্দিন আহমেদসহ ৩৮ জন।

স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার চাওয়া ২০১৩ সালে রমনা থানায় হওয়া মামলা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দাঙ্গা, সরকারি কর্মকর্তার কাজে বাধাদানের উদ্দেশ্যে আহত করা, সরকারি কর্মকর্তার ওপর বলপ্রয়োগ ও বিস্ফোরক আইনে মামলা করা হয়। মামলায় আসামি বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মির্জা আব্বাস, গয়েশ^রচন্দ্র রায়, বরকত উল্লাহ বুলু, আমানউল্লাহ আমান, শহিদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালসহ শীর্ষ ১৬ নেতা।

২০১৩ সালের ২৮ জানুয়ারি মতিঝিল থানায় বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে করা মামলা স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের উদ্যোগ নিয়েছে ডিএমপি। মামলায় জামায়াত নেতা ডা. ফখরুদ্দিন মানিক ও শামীম সাঈদীসহ ১১১ আসামি রয়েছে। জানা গেছে, আসামিপক্ষের আইনজীবীরা মামলাটি স্থগিত রাখার জন্য আবেদন করেছেন।

সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আমাদের কানে এসেছে যে ১ হাজার ৩০০ মামলা চিহ্নিত করা হয়েছে। মামলাগুলো নির্বাচনের আগেই শুনানি শেষ করে সাজা দিয়ে দেওয়া হবে। সবই রাজনৈতিক মামলা এবং আসামি হচ্ছেন বিএনপিসহ বিরোধী দলের শীর্ষ নেতারা। বিএনপি নেতাদের যদি মামলায় আটকে ফেলা যায়, সাজা দিয়ে দেওয়া যায়, তা হলে তাদের (আওয়ামী লীগের) কথা মতো সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন করতে পারবে।

বিএনপির শীর্ষ নেতারা বলছেন, এসব মামলায় দ্রুত বিচারকাজ শেষ করে শীর্ষ নেতাদের সাজা দিতে চায় সরকার। এটি বিএনপিকে চাপে রাখার কৌশল। ওয়ান-ইলেভেনের সময় করা মামলায় সম্প্রতি হাইকোর্ট বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর ৯ বছরের, ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমানউল্লাহ আমানের ১৩ বছর ও তার স্ত্রী সাবেরা আমানের তিন বছরের সাজা বহাল রেখে রায় দিয়েছেন। বিচারিক আদালতে দেওয়া সাবেক দুই মন্ত্রীর সাজা উচ্চ আদালত বহাল রাখায় নেতাকর্মীদের মধ্যে এই উদ্বেগ আরও পোক্ত হয়েছে।

বিএনপির দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ওয়ান-ইলেভেন ও পরবর্তী সময়ে সিনিয়র নেতাদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত দুর্নীতির পুরনো মামলাও সচল করছে সরকার। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এ পর্যন্ত ১ লাখ ১২ হাজারের মতো মামলা হয়েছে। এতে আসামি প্রায় ৪০ লাখ। মোট মামলার মধ্যে দুই হাজার ৮৩০টির বেশি হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে।

তবে পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, মামলার তদন্ত, চার্জশিট এবং বিচার একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এখানে রাজনৈতিক কোনো উদ্দেশ্য নেই। স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া সব মামলাই রাজনৈতিক না। দীর্ঘদিন ধরে স্থগিত থাকা মামলার তদন্ত শুরু করে শেষ করা আইনগত প্রক্রিয়া। কাউকে হয়রানি করা পুলিশের উদ্দেশ্য নয়।

বিএনপি ও জামায়াত নেতাদের স্থগিত মামলা সচলের উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম আমাদের সময়কে বলেন, ‘বিচার বিভাগ স্বাধীন। দেশে আইন তার নিজের গতিতে চলে। সেখানে আমাদের কোনো বক্তব্য নেই। বিএনপি অনেক কথাই বলে। মনগড়া বক্তব্য দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করাই তাদের কাজ। ফলে তাদের কোনো বক্তব্যই আমরা অবাক হই না।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *