বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের বাবা বরকত উল্লাহ বললেন, চাপা কষ্ট নিয়ে বেঁচে আছি। রাষ্ট্রপক্ষ বলছে, করোনা ভাইরাস এই মামলার বিচার পিছিয়ে দিয়েছে। তা না হলে এ বছরের মাঝামাঝিতেই রায় হয়ে যেত। তারা আশা করছেন, নভেম্বরেই এ মামলায় রায় হয়ে যাবে। গতকাল এভাবে নিজের কষ্টের বর্ণনা দেন বরকত উল্লাহ।
বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার দুই বছর ছিল গতকাল বুধবার। ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে বুয়েটের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের (১৭তম ব্যাচ) ছাত্র আবরারকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করে তারই সহপাঠী শিক্ষার্থীরা। মিডিয়ায় প্রকাশের পর সারাদেশে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। ঘটনার পরদিনই নিহতের বাবা বরকত উল্লাহর ১৯ শিক্ষার্থীকে আসামি করে চকবাজার থানায় করা হত্যা মামলায় দ্রুত তদন্ত শুরু হয়। পরে মামলাটি ডিবিতে হস্তান্তর হয়।
ডিবি পুলিশের পরিদর্শক (নিরস্ত্র) মো. ওয়াহিদুজ্জামান মাত্র ৩৩ দিনে একই বছরের ১৩ নভেম্বর বহুল আলোচিত এ মামলায় এজাহারভুক্ত ১৯ জনসহ ২৫ বুয়েট শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। চার্জশিট দাখিলের সময় ২৫ আসামির মধ্যে ৪ জন আসামি পলাতক ছিলেন। যাদের চার্জশিট দাখিল হওয়ার পর প্রথমে সিএমএম আদালত ওই আসামিদের গ্রেপ্তারে পরোয়ানা এবং পরবর্তী সময়ে সম্পত্তির ক্রোকাদেশ এবং শেষে অনুপস্থিতিতে বিচারের বিষয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রদান করেন। ওই বছরের ১২ জানুয়ারি বুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৭তম ব্যাচের ছাত্র মোর্শেদ অমত্য ইসলাম সিএমএম আদালতে আত্মসমর্পণ করে কারাগারে যান। অপর ৩ আসামি পলাতক থাকা অবস্থায়ই ২০২০ সালের ১৫ জানুয়ারি মামলার নথি সিএমএম আদালত থেকে মহানগর দায়রা জজের বিচারিক আদালতে যায়। সেখানে একই বছরের ৩০ জানুয়ারি চার্জগঠনের শুনানির দিন ঠিক হয়। ওই ধার্য তারিখে জানানো হয়, মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে যাবে। তাই চার্জগঠনের কার্যক্রম স্থগিত রাখা হয়। কিন্তু তারপর প্রজ্ঞাপন জারি হতে বিলম্ব হওয়ায় ওই বছরের ১৮ মার্চ পর্যন্ত মামলা মহানগর দায়রা জজ আদালতে থাকে। প্রজ্ঞাপন হলে মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল ১-এ ওই বছরের ৬ এপ্রিল চার্জগঠনের শুনানির দিন ধার্য করে বদলির আদেশ দেন মহানগর দায়রা জজ আদালত। কিন্তু ৬ এপ্রিলের আগেই করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে দেশের সব আদালতের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এ মামলার কার্যক্রমও বন্ধ হয়ে যায়। একই বছরের আগস্ট মাসে সরকার আদালত খুলে দিলে ওই বছর ১৫ সেপ্টেম্বর ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত ২২ আসামির অব্যাহতির আবেদন নাকচ এবং পলাতক ৩ আসামিসহ ২৫ আসামির বিরুদ্ধে চার্জগঠনের মাধ্যমে বিচার শুরু হয়। ২০২০ সালের ৫ অক্টোবর থেকে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়ে চলতি বছরের ৪ মার্চ শেষ হয়।
ওই সময়ের মধ্যে মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ ৬০ সাক্ষীর মধ্যে ট্রাইব্যুনালে ৪৬ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়। গত ১৪ মার্চ মামলায় আসামিদের আত্মপক্ষ শুনানি হয়। এর পর করোনা ভাইরাসের কারণে আবার আদালত বন্ধ হলে এই মামলার বিচারও বন্ধ হয়ে যায়। চলতি বছরের আগস্টে আবার আদালতের কার্যক্রম শুরু হলে চলতি বছর ২২ ও ২৩ আগস্ট সাফাই সাক্ষ্য হয়ে ৭ সেপ্টেম্বর যুক্তিতর্কের জন্য দিন ধার্য হয়। কিন্তু মামলার চার্জগঠনে শব্দগত ত্রুটি থাকায় আসামিদের বিরুদ্ধে গত ৮ সেপ্টেম্বর পুনরায় চার্জগঠন হয় এবং ১৪ সেপ্টেম্বর পুনরায় আত্মপক্ষ শুনানি হয়। গত ১৫ সেপ্টেম্বর যুক্তিতর্ক শুরু হলেও বিচারক করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ায় তা থেমে যায় এবং ২০ অক্টোবর মামলাটিতে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের দিন ধার্য আছে।
এ সম্পর্কে রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটর আবু আব্দুল্লা ভুইয়া বলেন, করোনা ভাইরাস এই মামলার বিচার পিছিয়ে দিয়েছে। তা না হলে এ বছরের মাঝামাঝিতেই রায় হয়ে যেত। আশা করছি, চলতি বছরের নভেম্বরেই এই মামলায় রায় হয়ে যাবে।
আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ বলেন, ছেলে হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক রায় ও তা কার্যকর দেখব বলে চাপা কষ্ট নিয়ে বেঁচে আছি। করোনার কারণেই বিচার বিলম্ব হয়েছে। আশা করছি আর বিলম্ব হবে না।
মামলার আসামিরা হলেন- বুয়েট ছাত্রলীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক মো. অনিক সরকার, উপ-সমাজসেবাবিষয়ক সম্পাদক ইফতি মোশাররেফ সকাল, ক্রীড়া সম্পাদক মো. মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন, সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান রবিন, মো. মনিরুজ্জামান মনির, খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম তানভীর, শিক্ষার্থী মো. মুজাহিদুর রহমান ও এএসএম নাজমুস সাদাত, বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল, আইনবিষয়ক উপ-সম্পাদক অমিত সাহা, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মুহতামিম ফুয়াদ, কর্মী মুনতাসির আল জেমি, গ্রন্থ ও প্রকাশনাবিষয়ক সম্পাদক ইসাতিয়াক আহম্মেদ মুন্না, শিক্ষার্থী আবরারের রুমমেট মিজানুর রহমান, শিক্ষার্থী শাসছুল আরেফিন রাফাত, বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৬তম ব্যাচের তৃতীয় বর্ষে ছাত্র আকাশ হোসেন, শিক্ষার্থী মো. মাজেদুর রহমান মাজেদ, শামীম বিল্লাহ, হোসেন মোহাম্মদ তোহা, মুয়াজ ওরফে আবু হুরায়রা, বুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৭তম ব্যাচের ছাত্র মোর্শেদ অমত্য ইসলাম এবং এসএম মাহমুদ সেতু, বুয়েটের ইলেকট্রিক অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স বিভাগের ১৭তম ব্যাচের ছাত্র মুহাম্মদ মোর্শেদ-উজ-জামান ম-ল ওরফে জিসান (২২), সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৭তম ব্যাচের ছাত্র এহতেশামুল রাব্বি ওরফে তানিম (২০) ও কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৬তম ব্যাচের ছাত্র মুজতবা রাফিদ (২১)। যাদের মধ্যে প্রথম ৮ জন আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। শেষের ৩ জন পলাতক। প্রথম ২২ জন কারাগারে রয়েছেন।