ঢাকা: প্রায় দুই কোটি মানুষের ঢাকা নগরে ‘ফুসফুস’ হিসেবে বিবেচিত ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। খাবারের হোটেল ও হাঁটার রাস্তা তৈরির জন্য কাটা হচ্ছে উদ্যানের গাছ। সৌন্দর্য বাড়ানোর লক্ষ্যে সরকারের গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রকল্প বাস্তবায়নে ইতোমধ্যে বেশ কিছু গাছ কাটা হয়েছে এবং কাটার জন্য কিছু গাছ চিহ্নিত করা হয়েছে। ‘আন্তর্জাতিক মানের স্মৃতিকেন্দ্র’ গড়ে তোলার মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে ‘কিছু গাছ’ কাটা হয়েছে বলে জানিয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়।
এদিকে উদ্যানে গাছ কাটার প্রতিবাদ এবং আত্মপক্ষ সমর্থনে মন্ত্রণালয়ের বক্তব্যের মধ্যে সৌন্দর্য বাড়ানোর নামে গাছ কাটা বন্ধে সরকারকে আইনি নোটিশ পাঠিয়েছেন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান সংরক্ষণে আদালতের এক আদেশ স্মরণ করিয়ে দিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার পাঠানো নোটিশে বলা হয়েছে, গাছ কেটে রেস্তোরাঁ নির্মাণ বন্ধ না হলে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হবে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব তপন কান্তি ঘোষ, গণপূর্ত বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী মো. শামিম আকতার ও স্থাপত্য অধিদপ্তরের প্রধান স্থপতি মীর মঞ্জুরুর রহমানকে ই-মেইলে নোটিশটি পাঠানো হয়েছে বলে মনজিল মোরসেদ জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, ২০০৯ সালে উদ্যান সংক্রান্ত হাই কোর্টের একটি রায় ছিল। সে রায়ে বলা হয়েছে- সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নিছক একটি এলাকা নয়। এই এলাকাটি ঢাকা শহর পত্তনের সময় থেকে একটি বিশেষ এলাকা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এই এলাকার ঐতিহাসিক ও পরিবেশগত ঐতিহ্য আছে। শুধু তা-ই নয়, দেশের সব গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা আন্দোলনের কেন্দ্র এই এলাকা। ফলে সম্পূর্ণ এলাকাটি একটি বিশেষ এলাকা হিসেবে সংরক্ষণের দাবি রাখে।
আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, গত ১১ বছর হাইকোর্টের ওই রায় বাস্তবায়ন নিয়ে বিভিন্ন সময় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, পূর্ত মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি। যখনই যোগাযোগ করেছি, তখনই বলা হয়েছে- এ সংক্রান্ত প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলছে; কিন্তু আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী আসলে কী হচ্ছে, গত ১১ বছরেও আমরা জানতে পারিনি। এমনকি সংবাদ মাধ্যমেও এ সংক্রান্ত বিস্তারিত কিছু আসেনি। ফলে মনে হচ্ছে আদালতের নির্দেশনা উপেক্ষা করা হচ্ছে বা পাশ কাটানো হচ্ছে।
শিক্ষাবিদ ও ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের এই গাছ কাটা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। এটা অত্যন্ত অন্যায় কাজ। আমাদের এই শহরে এমনিতেই প্রয়োজনীয় সংখ্যক গাছ নেই। এটা সবদিক থেকে কেবল ক্ষতিরই কারণ হবে। গাছ কাটার কারণে শুধু এখানেই ক্ষতি হবে তা নয়, এখান থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে উন্নয়নের নামে অন্য জায়গা থেকেও গাছ কাটা হবে।
স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, রেস্টুরেন্ট আর গ্যাদারিং করার জন্য গাছ কাটার পরিকল্পনা করা হচ্ছে কেন? গাছের নিচে মানুষ বসতে পারে না? গাছগুলোর চারপাশেই তো বসার ব্যবস্থা করা সম্ভব। গাছ কাটা একটি প্রচ- রকমের অন্যায় কাজ। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য হয়তো গাছ কাটতে বলেছে ১০টি, তারা কাটছে ২০০টি। এর বড় প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে গাছগুলো কাটার পর সেগুলো লুকিয়ে রাখার মধ্য দিয়ে। যেখানে গাছগুলো কাটা হয়েছে, তার থেকে অনেক দূরে নিয়ে সেগুলো ঢেকে রাখা হচ্ছে। প্রায় ৫০ বছর সময় লেগেছে এই গাছগুলো আজকের অবস্থানে আসতে। অথচ কয়েকদিনের মধ্যেই তা কেটে ফেলা হলো।
যাদের পরিকল্পনায় এত বড় ক্ষতি হচ্ছে, তাদের কঠোর থেকে কঠোরতম শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা শুধু সামনে যে থাকে তাকে শাস্তি দেই; কিন্তু দেওয়া উচিত তাকে, যার পরামর্শে এমন অন্যায় কাজ শুরু হয়। আমি প্রধানমন্ত্রীকেও বলেছি, আপনাকে যারা মিথ্যা তথ্য দিয়ে এসব কাজ করায়, শুধু তাদের শাস্তির আওতায় আনেন।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, গাছ কাটা কোনোভাবেই ঠিক হয়নি। আর যেনো কাটা না হয়। গাছ রেখেই উন্নয়ন ও সৌন্দর্যবর্ধন সম্ভব। পৃথীবির কোথাও গাছ কেটে এমন কাজ করার নজির নেই। আমরা এর প্রতিবাদ জানাচ্ছি।
গতকাল সরেজমিন দেখা গেছে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের চারপাশে সাতটি রেস্টুরেন্ট করার কাজ চলছে। এ ছাড়া রাস্তা নির্মাণের কাজও চলমান। এ জন্য বেশ কিছু গাছ কাটা হয়েছে। গাছের গোড়াগুলো মাটি দিয়ে ঢেকে ফেলা হয়েছে। এ ছাড়া নির্মাণকাজের পাশেই অনেক গাছে লাল ক্রস দাগ দেওয়া রয়েছে। এগুলো কাটা হতে পারে বলেও জানান নির্মাণশ্রমিকরা। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সম্প্রতি গাছ কাটার মধ্যে প্রবেশ পথের দেয়ালে কেউ লিখে রেখেছেন- ‘গাছ কাটা চলবে না’।
এদিকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা সুফি আব্দুল্লাহিল মারুফের সই করা বিবৃতিতে বলা হয়, গাছ কাটা নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত সংবাদের বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষিত হয়েছে। স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণের (৩য় পর্যায়) মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হচ্ছে জানিয়ে বলা হয়, মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কিছু গাছ কর্তন করা হলেও প্রায় এক হাজার গাছ লাগানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস সংরক্ষণে আধুনিক নগর উপযোগী এবং সবুজের আবহে আন্তর্জাতিকমানের স্মৃতিকেন্দ্র গড়ে দেশি-বিদেশি পর্যটক আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে এই মহাপরিকল্পনা করা হয়েছে। সেখানে পাকিস্তানি শাসনবিরোধী ২৩ বছরের মুক্তিসংগ্রাম এবং নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংবলিত ভাস্কর্য স্থাপন; ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের স্থানে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের মতো কিছু গুরুত্বপূর্ণ নির্মাণকাজ চলছে জানিয়ে একটি তালিকা দেওয়া হয়েছে মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে।
এ ছাড়া পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের স্থানে ভাস্কর্য স্থাপন, ইন্দিরামঞ্চ নির্মাণ, ওয়াটার বডি ও ফাউন্টেইন নির্মাণ, ভূগর্ভস্থ ৫০০ গাড়ির পার্কিং ও শিশুপার্কসহ ?বিভিন্ন নির্মাণকাজ চলছে বলেও উল্লেখ করা হয়।
এদিকে ‘গাছ কেটে উন্নয়ন’ বন্ধ করার দাবি জানিয়েছে ‘পরিবেশ বীক্ষণ’ নামের একটি সংগঠন। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সামনে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গাছ কেটে পরিবেশ ধ্বংসের প্রতিবাদে এক বিক্ষোভ সমাবেশে এই দাবি জানান সংগঠনের নেতারা। ‘গাছ কেটে দালান বানাতে পারবেন; কিন্তু সেই দালান আপনার বেঁচে থাকার অক্সিজেন দেবে না’ বলে হুশিয়ারি দিয়ে ‘পরিবেশ বীক্ষণ’-এর অন্যতম সংগঠক প্রিজম ফকির বলেন, গাছ বাঁচলেই আমি-আপনি বাঁচব। গাছ অক্সিজেন দেবে, দালান না। উন্নয়ন মানে পরিবেশ ধ্বংস করে দালান, রেস্তোরাঁ নির্মাণ করা নয়। প্রকৃতি কাউকে ছেড়ে কথা বলে না, প্রকৃতি ধ্বংস করবেন না। এর আগের দিন উদ্যানে গাছ কেটে রেস্তোরাঁ, হাঁটার পথ নির্মাণের প্রতিবাদ জানিয়ে মানববন্ধন করেছে তরুণ শিল্পী, চলচ্চিত্র নির্মাতাসহ একদল তরুণ। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের টিএসসিসংলগ্ন ফটকে নোঙর বাংলাদশ, স্বাধীনতা উদ্যান সাংস্কৃতিক জোট, গ্রিন প্ল্যানেটের উদ্যোগে এই কর্মসূচি পালন করা হয়। মানববন্ধনে বনফুল নামের একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন পরিবেশ রক্ষায় সচেতনতামূলক গানও গেয়ে শোনায়।
মানববন্ধনে ‘আইনের পাঠশালা’ সংগঠনের সভাপতি আইনজীবী সুব্রত কুমার দাস বলেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের পীঠস্থান। এখানে জাতির পিতা ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ দিয়েছেন; কিন্তু উন্নয়নের নামে এই মহামারীর মধ্যে উদ্যানের ৫০ বছর বয়সী শতাধিক গাছ রাতারাতি কেটে ফেলেছে গণপূর্ত বিভাগ। এখানে খাবারের দোকান বানানোর নামে প্রকৃতি হত্যার একটা ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে করপোরেট সংস্কৃতির বিকাশ ঘটছে, যার মূলে রয়েছে লুটপাটের অশুভ উদ্দেশ্য। অবিলম্বে এই প্রকৃতি হত্যার প্রকল্প বাতিলের দাবি জানাচ্ছি।
সমাবেশে বক্তারা বলেন, সারাদেশে গাছের তথা বনাঞ্চলের পরিমাণ দিন দিন কমছে, যেখানে একটি ভূখণ্ডের ২৫ শতাংশ বনাঞ্চল থাকার কথা, সেখানে তা কমে গিয়েছে। দ্য স্টেট অব গ্লোবাল ফরেস্ট-২০১৮ বলেছে, বাংলাদেশের মোট ভূখণ্ডের সাড়ে ১৩ শতাংশ বনভূমি। অপরদিকে মন্ত্রণালয়ের দাবি, দেশের মোট আয়তনের ১৭ শতাংশ বনভূমি। কারণে-অকারণে আজ বনভূমি উজাড় করা হচ্ছে। ঢাকা শহরে সেই বনভূমির পরিমাণ আরও কম। বসবাসের অযোগ্য শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয়। ঈদের আগে এই প্রকল্প বাতিল করা না হলে এর পর পরিবেশবাদীদের নিয়ে জোরদার আন্দোলনের হুশিয়ারি দেন তারা।
ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতাস্তম্ভ নির্মাণের (৩য় পর্যায়) মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে রেস্তোরাঁ, হাঁটার পথ, গাড়ি রাখার স্থান নির্মাণে শতাধিক গাছ কাটা হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে গণপূর্ত অধিদপ্তর। বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী ১৬১০ সালে মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে সুবেদার ইসলাম খাঁর সময়ে ঢাকা নগরী প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর যে উদ্যান গড়ে ওঠে, তা-ই আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও রমনা পার্ক। ব্রিটিশ শাসনামলে এটি রেসকোর্স ময়দান নামে পরিচিতি পায়, পাকিস্তান আমলেও ছিল তাই। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এর নাম সোহরাওয়ার্দী উদ্যান হয়, আরেক অংশ হয় রমনা পার্ক। প্রায় দুই কোটি মানুষের ঢাকা নগরে ‘ফুসফুস’ হিসেবে বিবেচিত এই দুই উদ্যান।