ঢাকা:‘বিতর্কিত’ নির্বাচনের বর্ষপূর্তি ঘিরে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ক্রমেই বাড়ছে। প্রতিদ্বন্দ্বী দুই রাজনৈতিক দলে যেন চলছে রণপ্রস্তুতি, রাজপথ দখলে নেয়ার লড়াই। ঢাকাজুড়ে গণতন্ত্রের বিজয় সমাবেশ করতে সব শক্তি নিয়ে আগামীকাল মাঠে নামছে আওয়ামী লীগ। সমাবেশের অনুমতি না পেলেও পিছু হটবে না বিএনপি। সব বাধা অতিক্রম করে ‘গণতন্ত্র হত্যা’ দিবসে নয়াপল্টনে জনসভা করতে চান খালেদা জিয়া। বিএনপির সাংগঠনিক স্তরগুলোতে ইতোমধ্যে ৫ জানুয়ারিতে করণীয় ‘বার্তা’ পৌঁছে দেয়া হয়েছে। নেতাকর্মীদের প্রস্তুত থাকতে দেয়া হয়েছে কড়া নির্দেশনা।
এরই মধ্যে গুলশান কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করা হয়েছে খালেদা জিয়াকে। রিজভীকেও আটক করা হয়েছে। নয়াপল্টন কাযালয়ে তালা লাগিয়ে দিয়েছে পুলিশ। এই অবস্থায় আজ রোববার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় লন্ডনে ভাষন দিবেন তারেক রহমান।
বৃহৎ দুই রাজনৈতিক শক্তির এমন মুখোমুখি অবস্থানে আশঙ্কা করা হচ্ছে সঙ্ঘাতের। জনমনে তৈরি হয়েছে নতুন শঙ্কা।
সমাবেশ ও প্রতিরোধের প্রস্তুতি আ’লীগে : ৫ জানুয়ারি রাজপথ দখলে রাখতে মরিয়া আওয়ামী লীগ। কোনো অবস্থাতেই রাজপথে বিএনপি-জামায়াত জোটকে দাঁড়াতে দিতে রাজি নয় তারা। এমনকি ওই দিন বিএনপি-জামায়াত জোটের কোনো নেতাকর্মীকে রাজধানীতে ঢুকতে না দেয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে তারা। এ ছাড়া রাজধানীতে অবস্থানরত নেতাকর্মীরা যাতে ঘরের বাইরে বের হতে না পারে সে জন্য দল ও সরকারের পক্ষ থেকে নেয়া হয়েছে ব্যাপক প্রস্তুতি। উত্তরা, মিরপুর, ধানমন্ডিসহ গুরুত্বপূর্ণ ১৬টি স্থান চিহ্নিত করে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর সাথে দফায় দফায় বৈঠক করে দলের হাইকমান্ড থেকে দেয়া হয়েছে বিশেষ নির্দেশনা। এ দিকে দলটির সিনিয়র ও তরুণ নেতাদের সমন্বয়ে রাজধানীর ১৬টি স্পটে জনসভা সফল করতে ১৬টি টিম গঠন করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর অন্যতম সদস্য ড. নূহ উল আলম লেনিন নয়া দিগন্তকে বলেন, সরকার গঠনের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে দলের পক্ষ থেকে বিশেষভাবে কর্মসূচি পালন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ জন্য রাজধানীর ১৬টি স্পটে জনসভা করা হবে।
তিনি বলেন, ৫ জানুয়ারিকে কেন্দ্র করে মানুষের মনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও শঙ্কা থাকাটা অমূলক নয়। তাদের মনে শঙ্কা আছে বলেই আমরা ওই দিন মাঠে থাকব। ড. লেনিন আরো বলেন, বিএনপি পারে না এমন কিছু নেই। তারা ওই দিন দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য রাজধানীতে নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা করবে। বিএনপি কোনো ধরনের নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করলে রাজনৈতিকভাবে তা প্রতিহত করা হবে।
স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট মোল্লা মো: আবু কাওছার নয়া দিগন্তকে বলেন, রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের প্রতিটি এলাকায় ‘গণতন্ত্রের বিজয় দিবস’ পালন করা হবে। রাজধানীর ১৬টি স্পটে এই কর্মসূচি রয়েছে। নেতাকর্মীরা নিজ নিজ এলাকার কর্মসূচিতে অংশ নেবেন। তিনি বলেন, অতীতে কর্মসূচি দিয়ে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা মাঠে থাকেনি। ৫ জানুয়ারিও তাদের মাঠে পাওয়া যাবে না।
জানা গেছে, ৫ জানুয়ারি রাজধানীর ১৬টি স্পটে বেলা আড়াইটা থেকে একযোগে কর্মসূচি পালন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। ১৬টি টিমের মধ্যে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশে থাকবেন আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ, সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, পূরবী সিনেমা হলের সামনে সমাবেশে থাকবেন আওয়ামী লীগের কৃষি ও সমবায়বিষয়ক সম্পাদক ড. আব্দুর রাজ্জাক, কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য এস এম কামাল হোসেন, ইলিয়াসউদ্দিন মোল্লাহ এমপি, শ্যামপুর-জুরাইন রেলগেট এলাকার সমাবেশে থাকবেন আওয়ামী লীগ সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য এনামুল হক শামীম, মমতাজ উদ্দিন মেহেদী, অ্যাডভোকেট সানজিদা খানম এমপি, ডেমরা-যাত্রাবাড়ী মাঠের সমাবেশে থাকবেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক ও শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ, হাবিবুর রহমান মোল্যা এমপি, বাড্ডা-রামপুরা পেট্রলপাম্প এলাকার সমাবেশে থাকবেন ক্যাপ্টেন (অব:) তাজুল ইসলাম এমপি, আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন, এ কে এম রহমত উল্লাহ এমপি, ধানমন্ডি-৩২ নম্বরের সমাবেশে থাকবেন আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ও দায়িত্বপ্রাপ্ত দফতর সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ, মিরপুর-১ গোলচত্বরের সমাবেশে থাকবেন আওয়ামী লীগ উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, আখতারুজ্জামান, আসলামুল হক এমপি, লালবাগ এলাকার সমাবেশে থাকবেন আওয়ামী লীগ উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ, দলের উপদফতর সম্পাদক অ্যাডভোকেট মৃণাল কান্তি দাস, গুলশান এলাকার সমাবেশে থাকবেন আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, সূত্রাপুর এলাকার সমাবেশে থাকবেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য সুজিত রায় নন্দী, তেজগাঁও এলাকার সমাবেশে থাকবেন আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ, আব্দুস ছাত্তার প্রমুখ। সবুজবাগ-খিলগাঁও এলাকার সমাবেশে থাকবেন আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ড. নূহ-উল-আলম লেনিন, আব্দুর রহমান এমপি, উত্তরা এলাকায় থাকবেন আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক কর্নেল (অব:) ফারুক খান, কামরাঙ্গীরচর এলাকায় আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সতীশ চন্দ্র রায়, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, ফজিলাতুন্নেসা ইন্দিরা এমপি, মোহাম্মদপুর এলাকায় আওয়ামী লীগ উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক ও কাফরুল এলাকার সমাবেশে থাকবেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা: দীপু মনি, স্থপতি ইয়াফেস ওসমান, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হক প্রমুখ।
পিছু হটবে না বিএনপি, মাঠে নামবেন খালেদা : জানা গেছে, আগামীকালের দিনটি ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ হিসেবে পালন করবে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দল। টার্গেট করা হয়েছে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করার। এই কর্মসূচিকে অস্তিত্ব বাঁচানোর লড়াই হিসেবে নিয়েছে ২০ দল আজ রোববার। রাত পর্যন্ত অনুমতির জন্য অপেক্ষা করবে তারা। শেষ পর্যন্ত অনুমতি দেয়া না হলে যেকোনো মূল্যে সমাবেশ করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ঢাকার পাশাপাশি সারা দেশে সভা-সমাবেশ ও কালো পতাকা মিছিলের কর্মসূচি পালনের নির্দেশনা রয়েছে।
ঢাকায় কর্মসূচি সফলের প্রক্রিয়া প্রসঙ্গে দলের সিনিয়র এক নেতা নয়া দিগন্তকে জানান, জনসভার অনুমতি না পেলেও নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের উদ্দেশে মার্চ করবে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নয়াপল্টনকে ঘিরে ছক তৈরি করা হয়েছে। ওই দিন কার্যালয়ের আশপাশে ৮ থেকে ১০টি স্পটে জমায়েত হয়ে কার্যালয়ের দিকে এগোবেন নেতাকর্মীরা, যার নেতৃত্বে থাকবেন জোটের শীর্ষ নেতারা। প্রতিটি স্পটে কয়েক হাজার নেতাকর্মী থাকবেন। ঢাকার বিভিন্ন থানা এবং ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সাথে থাকবেন জোট শরিক, কেন্দ্রীয় বিএনপি, ঢাকা মহানগর বিএনপি, ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলসহ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন।
জানা গেছে, ইতোমধ্যে কাকে কোন স্পটে থাকতে হবে তা জানিয়ে দেয়া হয়েছে। সিনিয়র সব নেতাকে রাজপথে থাকার বিষয়ে কড়া নির্দেশনা দিয়েছেন খালেদা জিয়া।
জানা গেছে, কাল সকাল ১০টা থেকে নয়াপল্টনে নেতাকর্মীরা সমবেত হতে থাকবেন। যেখানে পুলিশ বাধা দেবে সেখানে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে। এ জন্য ঢাকা মহানগরের পাশাপাশি বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গসংগঠনগুলোকে চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ছাত্রদলকে পূর্ব ও পশ্চিম, যুবদলকে উত্তর এবং স্বেচ্ছাসেবক দলকে দক্ষিণ দিক থেকে নয়াপল্টনের দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমবেত হতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
সমাবেশের অনুমতির খোঁজখবর নিতে শেষবারের মতো গতকাল শনিবার বিএনপির একটি প্রতিনিধিদল ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কার্যালয় যায়। কিন্তু সেখানে ডিএমপির কোনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সাক্ষাৎ পাননি বিএনপি নেতারা। প্রতিনিধিদলে ছিলেন উপদেষ্টা ও ঢাকা মহানগর বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আব্দুল আউয়াল মিন্টু, প্রচার সম্পাদক জয়নুল আবদিন ফারুক এবং সহদফতর সম্পাদক আব্দুল লতিফ জনি। দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে বিএনপির এই প্রতিনিধিদল ডিএমপি কার্যালয় থেকে বেরিয়ে আসে।
জয়নুল আবদিন ফারুক নয়া দিগন্তকে জানান, তারা ৫ জানুয়ারি সমাবেশের অনুমতির জন্য ডিএমপি কমিশনারের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সাক্ষাৎ তারা পাননি। অনুমতি না দিলেও বিএনপি নয়াপল্টনে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করবে বলে জানান তিনি। আর ওই সমাবেশে প্রধান অতিথি থাকবেন বেগম খালেদা জিয়া।
বিএনপির সিনিয়র এক নেতা নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, ৫ জানুয়ারি ঢাকায় ২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বরের পুনরাবৃত্তি দেখা যাবে না। এই দিনটি হবে বিএনপির। সেভাবেই নেয়া হয়েছে সব ধরনের প্রস্তুতি।
বিএনপি চেয়ারপারসনের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বরের ‘মার্চ ফর ডেমোক্র্যাসি’র মতো আগামীকাল খালেদা জিয়াকে বাড়ির গেটে আটকে দেয়ার চেষ্টা হলে, তা উপেক্ষা করেই বেরিয়ে আসবেন তিনি। দুপুরের পরপর গুলশান থেকে নয়াপল্টনমুখী হবেন তিনি। কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যাওয়া সম্ভব না হলে পথসভার আদলে রাজধানীর যেকোনো স্থানে সমাবেশ করতে পারেন খালেদা জিয়া। আর সেখান থেকেই সরকার পতনের একদফা দাবিতে আন্দোলনের টানা কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।
কর্মসূচিতে বাধা দেয়া হলে ৫ অথবা ৬ জানুয়ারি থেকে কর্মসূচি শুরু হবে। হরতাল দিয়ে কর্মসূচি শুরু হলেও পর্যায়ক্রমে অবরোধও আসবে। ৯ জানুয়ারি বিশ্ব ইজতেমা শুরু হলেও হরতালের কর্মসূচি থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে ইজতেমাকে হরতালের আওতামুক্ত রাখা হবে।
এ দিকে একটি সূত্র জানিয়েছে, আন্দোলনের প্রস্তুতির পাশাপাশি জোটের বাইরে সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে বৈঠক করেছেন কয়েকজন নেতা। বিএনপি জোটের আন্দোলনের যৌক্তিকতা তুলে ধরে নেতারা ওই দলগুলোর সমর্থন চেয়েছেন।