সিঙ্গাপুরের ইতিহাসে বিভীষিকাময় রাত

সারাবিশ্ব

mloরোববার সপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় সন্ধ্যার পর থেকেই হাজার হাজার বিদেশি অভিবাসী আর পর্যটকের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠে সিঙ্গাপুরের ভারতীয় ও বাংলাদেশি অধ্যুষিত লিটল ইন্ডিয়া, রেসকোর্স ও তার আশপাশের এলাকা।

পুরো সপ্তাহের কর্মব্যস্ততা শেষে এই দিনটিতে সবাই পরিচিত জন ও বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা, খাওয়া দাওয়া আর কেনাকাটার জন্য এখানে ভিঁড় করেন। রেস্টুরেন্ট আর শপিং মলের পাশাপাশি অনেকেই আবার মদ-বিয়ার নিয়ে রাস্তার পাশে বা খোলা মাঠে বসে পড়েন।

মাঝরাত পর্যন্ত হই-হুল্লোড়, উচ্চস্বরে গান-বাজনা আর আড্ডার পাশাপাশি মাঝেমধ্যে মাতাল হয়ে ছোটখাট অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটালেও আইনের সীমারেখা অতিক্রম করার কথা সিঙ্গাপুরে কেউ ভুলেও চিন্তা করেন না। কারণ, আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে সিঙ্গাপুর খুবই কঠোর।

কিন্তু ২০১৩ সালের ৮ ডিসেম্বর রাতে ঘটে যায় এক অনাকাঙ্খিত ঘটনা।

লিটল ইন্ডিয়ার ব্যস্ততম একটি সড়কে মাতাল অবস্থায় ট্রাফিক সিগন্যাল না দেখেই রাস্তা পার হতে গিয়ে বাসের চাপায় পিষ্ট হয়ে মারা যান শক্তিভেল কুমার (৩৩) নামে একজন ভারতীয় নির্মাণ শ্রমিক।

ঘটনাস্থলে উপস্থিত তার সঙ্গীরা দুর্ঘটনার জন্য বাস ড্রাইভারকে দায়ী করে সঙ্গে সঙ্গে হইহুল্লোড় শুরু করে দেন। তাদের সঙ্গে যোগ দেন লিটল ইন্ডিয়ার কয়েকশ’ ভারতীয় নাগরিক। তাদের অধিকাংশই তখন মদ খেয়ে মাতাল হয়েছিলেন।

প্রথমে তাঁরা দুর্ঘটনার জন্য দায়ী বাসটি ভাংচুর করেন।কিন্তু তবুও তাদের ক্ষোভ যেন মিটছিল না। তাই এবার তারা রাস্তায় থাকা অন্যান্য গাড়িগুলো ভাঙ্গতে শুরু করেন।

এ সময় এলাকার বাসিন্দা, দোকানদারসহ হাজার হাজার মানুষ অবাক দৃষ্টিতে তাদের তাণ্ডব দেখছিলেন। কারণ, টিভি-সিনেমায় এজাতীয় দৃশ্য সচরাচর দেখা গেলেও সিঙ্গাপুরের মত দেশে এভাবে আইন হাতে তুলে নিয়ে কেউ দাঙ্গা ফ্যাসাদ করবে- এটা তাদের ধারণারও বাইরে ছিল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘটনাস্থলে হাজির হয় পুলিশ। কিন্তু তারাও প্রথমে বুঝে উঠতে পারছিল না- কি করবে। কারণ, প্রশিক্ষণের সময় অনুশীলন করলেও বাস্তবে সিঙ্গাপুরে এ ধরনের কোন পরিস্থিতির মুখোমুখি তারা কখনো হয়নি।

প্রথমে তারা মাইকিং করে দাঙ্গায় লিপ্ত ভারতীয়দের শান্ত হওয়ার অনুরোধ জানান। কিন্তু মাতাল ভারতীয়রা এবার পুলিশের উপর হামলা করে বসে। তারা কয়েকটি পুলিশের গাড়িতে ভাংচুর করে আগুন লাগিয়ে দেয়। তাদের হামলায় আহত হয় প্রায় ১১ জন পুলিশ।

এরপরই পুলিশ হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়। কয়েক হাজার পুলিশ ও আধাসামরিক বাহিনীর সদস্য পুরো এলাকা ঘিরে ফেলে শুরু করে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান। ঘটনাস্থল থেকে শতাধিক বিদেশি অভিবাসীকে আটক করা হয় যাদের অধিকাংশই ভারত, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার নাগরিক। যদিও তাদের মধ্যে অনেকে ঘটনাস্থলে শুধু দর্শক হিসেবেই ছিলেন।

রাত আনুমানিক ১টার পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আসে। কিন্তু, পুরো এলাকায় ততক্ষণে আতঙ্ক, পোড়া গন্ধ আর ভাঙচুরের ধ্বংসাবশেষ মিলে এক ভৌতিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।

পরদিন সকালে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এই ঘটনার তদন্ত ও দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। সপ্তাহব্যাপী প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষী ও সার্বিক পরিস্থিতির উপর ব্যাপক তদন্ত শেষে কমিটি কিছু সুপারিশসহ তাদের রিপোর্ট জমা দেয়।

এরপর থেকেই রেসকোর্স আর লিটল ইন্ডিয়ায় বসবাসরত লক্ষাধিক বিদেশি অভিবাসীর জীবন যাত্রা যেন আক্ষরিক অর্থেই নরকে পরিণত হয়।

প্রথমে লিটল ইন্ডিয়া ও তৎসংলগ্ন এলাকার জন্য একটি নতুন ও বিশেষ আইন জারি করা হয়। এই আইনে পুলিশকে যেকোনো সন্দেহজনক ব্যক্তিকে তল্লাশি বা গ্রেফতার করার ক্ষমতা দেয়া হয়।

এছাড়াও লিটল ইন্ডিয়ার নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় ও নির্দিষ্ট সময়ের বাইরে কেউ অ্যালকোহল সেবন করতে পারবেন না এবং এক সঙ্গে দুইজনের অধিক লোক চলাফেরা করতে গেলে তাদেরকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখা হবে বলে সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে দেয়া হয়। পুরো এলাকা সর্বক্ষণ সিসিটিভি ক্যামেরা আর সাদা পোশাকের পুলিশের নজরদারিতে নিয়ে আসা হয়।

মূলতঃ ভারতীয় অভিবাসীদের এই মাতলামির কারণে পুরো সিঙ্গাপুরে ভারতীয়দের পাশাপাশি বাংলাদেশিরাও চরম বিড়ম্বনা, অসহযোগিতা ও বিপর্যয়ের সম্মুখীন হন।

সিঙ্গাপুরের অভিবাসন নীতিতে অলিখিত পরিবর্তন আনা হয়। ভারত ও বাংলাদেশিসহ দক্ষিণ এশিয়ার নাগরিকদের চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কঠোর বাধা ও নিয়ম কানুনের বেড়াজাল সৃষ্টি করা হয়। সরকারি কঠোর পদক্ষেপের পাশাপাশি সিঙ্গাপুরের নাগরিকরাও বিদেশি অভিবাসনের বিরোধিতা করে আন্দোলন শুরু করেন। ফলে গত বছর এই দাঙ্গার পর থেকে অনেক মেধাবী ও পরিশ্রমী ব্যক্তিও সিঙ্গাপুরে তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।

ব্যাপক তদন্ত ও সাক্ষ্যপ্রমাণ শেষে আটক বাংলাদেশি ও অন্যান্য দেশের নাগরিকদেরকে মুক্তি দিয়ে মোট ২৪ জন ভারতীয় নাগরিকের বিরুদ্ধে দাঙ্গা ও পুলিশের উপর হামলার অভিযোগ আনা হয়। পরে তাদের সবাইকে বিভিন্ন মেয়াদে জেল ও জরিমানাসহ বেত্রাঘাতের শাস্তি দেয়া হয়।

সিঙ্গাপুরের বিগত চল্লিশ বছরের ইতিহাসে এ ধরনের ভাংচুরের ঘটনা আর কখনও ঘটেনি। তাই একটি বছর পার হওয়ার পরেও লিটল ইন্ডিয়ার সেই ভয়াল সেই রাতের কথা এখনও সবার আলোচনার বিষয় হয়ে আছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *