মুজিবনগরের পথে পথে !

Slider জাতীয় বাধ ভাঙ্গা মত


শতাব্দী আলম: ঐতিহাসিক মুজিব নগর। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের সূতিকাগার। মুজিব নগর পরিদর্শন আমাদের সফর রাজনৈতিক পাঠ বললে ভুল হবে না। টঙ্গী পূর্ব ও পশ্চিম থানা আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ এই সফরের আয়োজন করেছে। বিশেষভাবে বলতেই হবে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র আলহাজ¦ মোঃ জাহাঙ্গীর আলম এই রাজনৈতিক শিক্ষা সফরের পরামর্শ দিয়েছেন।

রোদ ঝলমলে ভোর অন্য দিনের চাইতে একটু বেশী সুন্দর ছিল। টঙ্গী মধুমিতা সড়ক হতে আমাদের সফর শুরু। কথায় বলে বাঙালির ঘড়ি ঠেলাগাড়িতে চলে। আমরাও বাঙালি নামের সুবিচার করতে কসুর করিনি, ৭ টার বাস ৯ টায় রওনা দেয়। তবে নাসির ভাইয়ের ভাড়া করা টুরিষ্ট বাসে চড়ে সবারই বিলম্বের কষ্ট দুর হলো। সত্যিই টুরিষ্ট বাস বলে কথা। যেমন আরামদায়ক তেমনি খোলামেলা।

আমাদের বাস ঢাকা-টাঙ্গাইল বাইপাসে চলতে শুরু করেছে। আমাদের গন্তব্য মেহেরপুর জেলার মুজিবনগর।
মুজিবনগরের ইতিহাস বাংলাদেশী মাত্রই কমবেশী জানা আছে। তারপরও অল্প কথায় আলোকপাত করছি। এখানেই ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠন ও শপথ গ্রহন করে। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে গঠন করা হয়েছিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। তৎকালিন সময়ে স্থানটি বৈদ্যনাথতলা নামে পরিচিত ছিল। মুজিবনগর নামকরণ করে মুজিবনগরকে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী ঘোষণা করে বাংলাদেশ সরকার।

আমরা ১৯ জন। বাসে আনন্দের কলকাকলি। বোর্ড বাজার থেকে বন্ধু নুরু বাসে উঠার পর এই আনন্দ আলোচনায় নতুন মাত্রা যোগ হলো। আসর জমানোর বিশেষ সুনাম কবিয়াল নুরুল ইসলাম নুরু। সকলের বয়স ৩৫ থেকে ৪৫ এর কোঠায়। কে বলবে এরা যুবক। মুহুর্তেই কৈশরের আনন্দে সবাই মাতুয়ারা। গুরু গম্ভির ডাঃ ফারুকও নিজের পছন্দের গান শুনালেন। দেওড়ার কামালকে নিয়ে সবাই রসিকতা করে। সুটেড বুটেড কেতাদুরস্থ সাজ এমন সফরে একটু বেমানানই বৈকি। সমালোচনা থোরাই গায়ে নিলেন। বরং তার ভাষ্য সাহেবী পোশাকে টঙ্গীর মান রক্ষা হয়েছে। সালাউদ্দিন ও আজিজ গাজী দুই ভাই। আবুল ভাই কোষাধক্ষ্য। টুপি দাড়িতে তিনজন বেশ হাসি ঠাট্রায় রসিক। আবুল ভাই দড়িয়াবাড়িতে এসে তিন তিনটি গান শুনালেন। অসাধারন গায়কী। নাটোরের বানিয়াপাড়ায় আমাদের প্রথম যাত্রাবিরতী। মহানগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা কাজী সেলিম ভাইয়ের বেশ তাড়া ছিল বিরতিতে। তৎক্ষণে দুপুর। ফাইভ ষ্টার হোটেলে দুপুরের আহার করি। বাটা মাছের ঝোল, কেচকি মাছের চরচরি, পালং শাক, রুই মাছ, দেশী গরুর মাংশ সাথে টাটকা সালাদ ও লেবু। ভাত কিছুটা কম পরে। আধা সেদ্ধ ভাতই গোগ্রাসে খেয়ে নিলাম। ১৯ জন খেয়ে মাত্র ২৬’শ টাকা বিল। আমাদের চোখ ছানাবড়া। সুন্দর পরিবেশনের জন্য হোটেল মালিককে ধন্যবাদ দিয়েছি। ফের বাস ছুটলো। খাবার পর ভাত ঘুম বা ক্লান্তি কোন কিছুই কারো চোখে নেই। পুরোনো দিনের বাংলা, আর মারেফতি গানে মুখর বাস। ‘‘ও জীবন রে ছাড়িয়া না যাও মোড়ে। এ জীবন ছাড়িয়া গেল আদর করবে কে আমরে রে। অথবা ‘‘৩০ বছর পরেও আমি স্বাধীনতাটাকে খুজছি।’’ এসব কালজয়ী গানে সুর মেলাচ্ছে সবাই। মাসুম বিল্লাহ বিপ্লব, আজমেরী খান টুটুল, নুর নবী আনসারি নবিন, রাসেল, মনিরুল ইসলাম মনির, আফিল উদ্দিন, মোঃ ইয়াসিন সবাই কমবেশী গানে মশগুল সরগোল করেছে।
বিকেল চারটার দিকে আমরা কুষ্টিয়া লালন শাইজীর আখড়ায় পৌছালাম। লালন শাইজীর আখড়ায় এসে আমার অনেক দিনের ইচছা পুরন হলো। প্রধান ফটকের পাশে কিছুক্ষণ নিরবে দাড়িয়ে শাইজীকে শ্রদ্ধা জানিয়েছি। সেখানেই আমাদের গ্রুপ ছবি নিলাম। চারিদিকে একধরনের আধ্যাত্যিক আবহ। মনের মধ্যে এক ধরনের নড়াচড়া। শাইজীর আধ্যাত্যিকার দ্যুতি নগন্য আগুন্তুককেও আবিষ্ট করে। আমরাও সেই প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হইনি। আর যেখানে আমাদের সফর সত্যিকারেরই রাজনৈতিক শিক্ষা সফর। একাডেমিক ভবনে শাইজীর চিত্র ও ব্যবহার্য সামগ্রী দেখলাম। ভাগ্য ভাল তখন কলকাতা থেকে একদল সঙ্গীত প্রেমী এসেছে সাধুসঙ্গে। শুরু হলো লালন গীতির আসর। ফকির বেবুন শুনালেন ‘ধন্য ধন্য বলি তারে’ লালন গীতি। একে একে আরো কয়েকজন। আমরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে ছিলাম।

রাতের নিমন্ত্রণ ছিল মুজিবনগরে দাড়িয়াপুর গ্রামে হেলাল ভাইয়ের বাল্য বন্ধু রাজিবের ওখানে। তার পুরো নাম জাহিদুল হাসান রাজিব। রাজিব ভাইয়ের ভুবনে আমরা অভিভুত। ‘ছবিতলা’ তার ভুবন। দেশেতো বটেই পৃথিবীর কোথাও এমন ছবির মেলা আছে বলে আমার জানা নেই। তিনি এক যুগ যাবৎ বিশে^র নানা প্রান্তের বিখ্যাত মানুষদের ছবি সংগ্রহ করে যাচ্ছেন। ৩টি টিন কাঠের ঘরে স্তরে স্তরে ছবি সাজানো। কি নেই সেখানে বিশে^র বিখ্যাত রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবি, সংগিতজ্ঞ, কবি, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, ধর্মীয় গুরু, রাজা, বাদশা, খেলোয়ার, বঙ্গবন্ধুর বিশেষ দূর্লব ছবি, বিশে^র প্রধানমন্ত্রী, হলিউড- বলিউড, ঢালিউডের নায়ক নায়িকা পরিচিত কেহই তার সংগ্রহ থেকে বাদ পরেনি। হাজার হাজার ছবি। ভাল লেগেছে তার নিজ গ্রামের একেবারে প্রান্তিক মানুষ যারা একসময় ভাল খেলোয়ার ছিলেন, জনপ্রতিনিধি বা সংগঠক তাদের ছবিও রেখেছেন। থানা বা জেলার কর্মকর্তাদের ছবিও আছে। একজন আপাদমস্তক সৃজনশীল মানুষ রাজিব ভাই। তার ছবিতলায় লালন গীতির চর্চা হয়। নটরাজ গ্রুপ থিয়েটার নিয়মিত নাটক মঞ্চস্থ করে। বিশেষভাবে ইটের চাতাল বানিয়ে ব্যাডমিন্টনের কোট বানানো হয়েছে। খেলাধুলাও নিয়মিত হয় বুঝা যায়। একটি সমাজের সুষ্ঠু এবং সৃজনশীল বিকাশে ছবিতলা অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।

রাজিব ভাইয়ের আতিথিয়েতা নিয়ে লিখে শেষ করা যাবে না। রাতের খাবারে ছিল গরম ভাতের সাথে কালাইয়ের বড়া দিয়ে শিং মাছের ঝোল, সবজি মুগের নাভরা আর ঘন ডাল। আয়োজন পরিবেশনার পরতে পরতে আন্তরিকতা। প্রতিটি বিষয়ে তার বিশেষ নজর। খাবার পর এক সংক্ষিপ্ত আলোচনাও হলো। আমিই শুরু করলাম। নাটোর আসবো আর বনলতা সেন হবে না তা কি সম্ভব ! আমি বেশ আবেগ নিয়ে আবৃতি করলাম। হেলাল ভাই আমাদের সকলের পক্ষ থেকে রাজিব ভাই ও অন্যদের ধন্যবাদ দিয়েছেন। রাজিব ভাইয়ের মত আমরা সমাজের জন্য এভাবে সৃজনশীল কাজে আরও বেশী নিজেদের যুক্ত করবো। এমন প্রত্যয় নিয়ে আলোচনার ইতি টানা হলো।

মুজিব নগর সার্কিট হাউজ এবং পর্যটন মোটেলে আমাদের রাত্রি যাপনের ব্যবস্থা হয়েছে। এখানেও রাজিব ভাই। যা হোক পর্যটন মোটেলের সহকারী বাণিজ্যিক কর্মকর্তা গোলাম তাজ সাহেব ঢাকা খিলক্ষেতের মানুষ, খোজ খবর নিলেন। মোটেলে ১২ টা কক্ষ, সুইট কক্ষ ২টা প্রতিটির ভাড়া-২৩০০, ডিলাক্স ৪ টা ভাড়া ১৪০০, নন এসি ৬ টা ভাড়া ৭০০। ছিমছাম পরিপাটি। তবে রেষ্টুরেন্ট বন্ধ, বৈদ্যুতিক লাইনে সমস্যা। গার্ড মোঃ নাসির উদ্দিন রাতেই আমার কক্ষের বৈদ্যুতিক লাইন মেরামত করে দিয়েছেন। তাকে কৃতজ্ঞতা জানাই। শুভরাত্রী।
#

পর্যটন মোটেল
মুজিবনগর
মেহেরপুর
১২;০০টা
২৬/১১/২০১৯

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *