লাগাম টেনে ধরার প্রয়োজনীয়তা তৈরি হয়েছে

Slider জাতীয়

হোসেন জিল্লুর রহমান। বিশ্বের সবচেয়ে বড় এনজিও ব্র্যাকের চেয়ারপারসন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ সময়ে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর দারিদ্র্যবিমোচন নিয়ে লড়াই করছেন দীর্ঘদিন ধরেই। সমাজের নানা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে তিনি ভাবেন, মত দেন। সম্প্রতি মানবজমিনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সাম্প্রতিক নানা ইস্যুতে কথা বলেছেন খোলামেলা।

চলমান দুর্নীতিবিরোধী অভিযান বা শুদ্ধি অভিযান প্রসঙ্গে হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, এখানে ক্ষমতা বলয়ের মধ্যে কিছু টানাপড়েন তৈরি হয়েছে হয়তো। এই অভিযান সম্পর্কে খুব বেশি ব্যাখ্যা দেয়া কঠিন। এ বিষয়ে নীতিনির্ধারক মহল আরো পরিষ্কার করে বলতে পারবেন।
কিন্তু এটা থেকে একটি বিষয় বোঝা যাচ্ছে যে, লাগাম টেনে ধরার একটি প্রয়োজনীয়তা তৈরি হয়েছে হয়তো। সেটা কেন তৈরি হলো এগুলো ব্যাখ্যার বিষয়। এটা আরেকটু বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে। অভিযানের গন্তব্য কোথায়- সেটা এই মুহূর্তে বলাটা মুশকিল। কিন্তু এই অভিযানের ফলে সমাজের যে বিভিন্ন প্রশ্নের যথার্থতা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে- ওটাই বড় করে এখন এই মুহূর্তে বলা যায়। এটা এমন ধরনের অভিযান হচ্ছে যেখানে আসলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকেই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। সেটা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হোক, ক্ষমতাসীন দল হোক বা অঙ্গ সংগঠন, প্রাইভেট সেক্টরের লোকজন হোক কেউ বাদ যাচ্ছে না। এমনকি আমাদের ঠিকাদারি কাজগুলো কীভাবে দেয়া হয় এটা তো ইতিমধ্যে পরিষ্কার। ই-টেন্ডারিংয়ের কথা আমরা অনেকবার শুনেছি। যেটা দু’একজনই পাচ্ছে। ঠিকাদারি কাজগুলোর সিদ্ধান্ত কীভাবে গ্রহণ করা হচ্ছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কোন খবরের কারণে খবরের শিরোনাম হচ্ছে।

বিশ্বব্যাপী আমরা কেন র‌্যাঙ্কিংয়ে ঢুকতে পারছি না। এটার জন্য কিন্তু আলোচনায় আসছে না। অবকাঠামো তৈরির দুর্নীতি আলোচনায় আসছে। এই কারণে একটি বড় ধাক্কা দিচ্ছে আমাদেরকে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ভুল কারণগুলোতেই খবরের শিরোনাম হচ্ছে। এবং বিশেষ করে বেপরোয়া বলতে অঙ্গ সংগঠন ইত্যাদি এদের মূল উদ্দেশ্যে কী সেগুলো আমাদের বোঝা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে নানা ধরনের নেতিবাচক বিষয় দেখা গেছে।

প্রখ্যাত এই অর্থনীতিবিদ বলেন, আমার মনে হচ্ছে যে, একটি উদ্বেগের বিষয় ছিল জনমনে। উন্নয়ন ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এবং তার পরিসংখ্যানও আছে। পাশাপাশি মানুষের মনে নানা ধরনের প্রশ্ন এবং উদ্বেগ ছিল তার যথার্থতা অনেকটা এই অভিযান প্রতিষ্ঠা করেছে। দুর্নীতির একটি বিষয় ছিল। বৈধ আয়ের বিষয় ছিল। বিভিন্ন দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের গাফিলতি এবং যোগসাজশে নানা ধরনের অনিয়মের বিষয় ছিল। আপাতদৃষ্টিতে এগুলোও বড় বিষয় নয়। দুর্নীতি বহু দেশে হয়। সবচেয়ে বড় যে চিন্তা বা উদ্বেগের বিষয় মানুষের মনে সেটা হচ্ছে অভিযানের গন্তব্য নিয়ে নয়, উন্নয়নের গন্তব্য কোথায় এটা নিয়ে। উন্নয়নের গন্তব্য যদি হয় অত্যন্ত বেপরোয়া ও নিয়ম ভঙ্গকারী তাহলে ক্ষমতাকে অপব্যবহারকারী গোষ্ঠী আরো নিরন্তর ভাবে এবং রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী হবে এবং হচ্ছে। সেটা নিয়েই মনে হয় মানুষের মনে আরো বেশি দুশ্চিন্তা ছিল। কত হাজার টাকা দুর্নীতি হয়েছে সেটা বড় বিষয় নয়। মানুষের মনে এখন সবচেয়ে বড় যে চিন্তা এবং উদ্বেগ সেটা হচ্ছে উন্নয়নের গন্তব্যটা কোথায়। আমরা মধ্যম আয়ের স্বপ্ন দেখছি। এবং সেটা একটি যথার্থ স্বপ্ন। আমরা দরিদ্র একটি দেশ ছিলাম।

সেখান থেকে একটি সমৃদ্ধ স্বপ্ন দেখার সাহস, শক্তি এবং যোগ্যতা দেখাচ্ছি এটা অত্যন্ত অভিনন্দনযোগ্য। কিন্তু কোন উপাদান দিয়ে এই স্বপ্নটা সাজানো হচ্ছে- সেটাই এখন সবচেয়ে বড় বিষয় হয়ে সামনে চলে আসছে। এই মধ্যম আয়টা কি শুধুমাত্র সেই ক্ষমতার অপব্যবহারকারী, বেপরোয়া ও অনিয়মের সূত্র ধরে অতি ধনীর পথ তৈরির জায়গাগুলোই কি মূলত মধ্যম আয়ের জায়গা। নাকি এখানে আমাদের জীবনমানের ডিগনিটি, শিক্ষার মান, স্বাস্থ্যের মান, বিশেষ করে নিয়মতান্ত্রিকভাবে সবকিছু হওয়া। ক্ষমতার অপব্যবহার না হওয়া। উন্নয়নের গন্তব্য বলতে বৈষম্যটা মূল গন্তব্য হতে পারে না। শুধু বৈষম্য নয়। বৈষম্য কোন পন্থায় হচ্ছে। এমন যদি হতো একজন ব্যক্তি প্রচণ্ড কষ্ট করে বেশি টাকা অর্জন করছে। আরেক জন অলসভাবে বেশি টাকা অর্জন করছেন। সেটাও বৈষম্য। এটা হচ্ছে অনৈতিকভাবে, নিয়ম ভঙ্গ করে, অন্যকে বিপদে ফেলে যোগসাজশের মাধ্যমে করা হচ্ছে। এভাবে বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। তার মানে আজকের বাংলাদেশে বৈষম্য শুধু বিষয় নয়। বৈষম্য কোন পথে হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে সেটা নিয়ে প্রশ্ন। অনেক দেশে নানা পর্যায়ে বৈষম্য আছে। যেকোনো দেশে অতি বৈষম্য একটি দুশ্চিন্তার কারণ। কিন্তু আজকে মূল বিষয় হচ্ছে বৈষম্যের চেয়েও অনৈতিক পথে বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। এখানে নজর দেয়া দরকার।

হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, চলমান অভিযান এক অর্থে বেপরোয়া অনৈতিক খাতগুলোর ওপর আঘাত। এটা একদিকে আমি ভালো এবং সঠিক মনে করছি। কিন্তু শুদ্ধি অভিযানটা মাঝপথে থেমে গেলে এক ধরনের ধারণা আমরা নেবো। এটা যদি আংশিক হয় তাহলেও এক ধরনের ধারণা নিতে হবে। এটা কি এক গোষ্ঠীর লড়াইয়ের অংশ কিনা-এটা আমাদের এখনো দেখার বাকি আছে যে, অভিযানটা সার্বিকভাবে কীভাবে পরিচালিত হচ্ছে। এখনো তো এটা চলছে। চলমান একটি প্রক্রিয়া। সেই অর্থে আমার মনে হয় আমাদের অপেক্ষা করাটাই শ্রেয় হবে। বরং যে প্রশ্নগুলো সমাজের মধ্যে তোলপাড় করছিল। এবং এ কথাগুলো হয়তো জনসম্মুখে বলাবলি হচ্ছিল বা হচ্ছিল না। সেগুলোর যথার্থতা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে এই অভিযানের মধ্যদিয়ে।

অভিযানে টাকা পাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটাকে খুব একটা মুখরোচক খবর হিসেবে দেখাটা উচিত হবে না। হয়তো এটা খুব নগ্নভাবে চোখে পড়েছে। কিন্তু ব্যাংক থেকে টাকা লুণ্ঠন হলো ওটা তো নগ্নভাবে চোখে পড়েনি। কিন্তু ওটা তো হয়ে গেল। নানাভাবে ব্যাংকিং সেক্টরে যে সমস্যাগুলো সেখানে বড় ধরনের অর্থ পাচার হচ্ছে। এখন যে টাকার ছড়াছড়ি সেক্ষেত্রে এটাও সত্য যে, আমাদের ব্যাংকগুলো সার্বিকভাবে একটি চরম স্ববিরোধী পরিসংখ্যানে ভরে আছে। একদিকে ব্যাংক পরিচালনায় উচ্চ মুনাফা দেখতে পাচ্ছি। অন্যদিকে আমাদের প্রবৃদ্ধি এত কিন্তু খেলাপি ঋণও বেশি। ব্যাংকে তারল্য সংকট আছে ইত্যাদি অনেক কিছু আছে। এটা অত্যন্ত জরুরি যে, আমরা একটি যোগসূত্র তৈরি করি। এই যে বস্তাভর্তি টাকা এটার সঙ্গে ব্যাংকের বিষয়গুলো দেখতে হবে। শেয়ার বাজার অথবা ঠিকাদারি কার্যগুলো কীভাবে দেয়া হচ্ছে। এই সবগুলোকে একত্রে দেখতে হবে। শুধুমাত্র একটি অংশ ধরে সেটাকেই হাইলাইট করলাম তখন পুরো বিষয়টা আংশিক হয়ে যাবে।

তিনি বলেন, ভিআইপি কালচারকে এখন নেতিবাচকভাবে ভাবা হচ্ছে। যেখানে ভিআইপিকে সম্মানজনকভাবেও ভাবা যায়। এখানে নেতিবাচকভাবে ভাবতে বাধ্য হয়েছে সাধারণ মানুষ। যারা নিয়ম ভাঙছে, রাস্তার উল্টোদিকে চলছে, আইনের তোয়াক্কা করছে না। তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনৈতিক সহায়তা হয়তো পাচ্ছে। এবং সুযোগ নিচ্ছে। ক্ষমতার দম্ভ দেখাচ্ছে। সেটা হতে পারে ঘরের মধ্যে, রাস্তায়, প্রতিষ্ঠানে সর্বত্রই ক্ষমতার দম্ভের যে আস্ফালন দেখাচ্ছে। হোসেন জিল্লুর বলেন, প্রবাদ বাক্য আছে, ‘লেখাপড়া করে যে, গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে’। এই প্রবাদ বাক্যে যেটা বলা হয়েছে শিক্ষার মাধ্যমে সামাজিক গতিময়তা তৈরি হওয়া। আমি হতদরিদ্র। কিন্তু শিক্ষার মাধ্যমে উপরে উঠতে পারি। কিন্তু আজকে মানসম্মত শিক্ষার সুযোগটা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছাচ্ছে না।

এখানেও একটি প্রশ্ন রয়েছে, আমাদের নীতি নির্ধারকদের নজরগুলো কোথায় আসলে। বৃহৎ অবকাঠামোর দিকে নজর আছে সেটা পরিষ্কারভাবে আমরা বুঝতে পারছি। কিন্তু মানসম্মত শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শহর এবং প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার যে একটি সমান গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য সেখানে যদি নজরটা না থাকে তাহলে সবাই সমান সুফল পাবে না। উন্নয়নের যে গন্তব্য সেখানে কারা স্থান দখল করে থাকবে সেটাও দেখার বিষয়। আরেকটি হচ্ছে কোন বিষয়গুলো বেশি নজর পাচ্ছে বা পাচ্ছে না এখানেও একটি বড় প্রশ্ন আছে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই উপদেষ্টা বলেন, ক্ষমতায় যখন একটি বেপরোয়া ভাব আসে যে, আমি জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে তখন কিন্তু যে উপসর্গগুলো তৈরি হয় তার অন্যতম একটি বিষয় হচ্ছে ভায়োলেন্স (সহিংসতা)। বিশেষ করে দুর্বল জায়গা। নারী-শিশু তাদের প্রতি সহিংসতা একটা কারণে বেড়ে গেছে। যেটা বেপরোয়া ক্ষমতার একটি কারণ। আমরা সড়কে শৃঙ্খলা আনতে পারছি না। নারী এবং শিশুদের নির্যাতন ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়া। এটার মাধ্যমে বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে যে ক্ষমতা-বেপরোয়াভাব জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে। এবং তথাকথিত ভিআইপি সংস্কৃতির অত্যন্ত নেতিবাচক ধারণার মধ্যে আমরা বসবাস করছি। সেখান থেকে এই অভিযানটা একটি ধাক্কা দিয়েছে। তবে এটা কোথায় যাবে, কি হবে সেটা দেখার বিষয় আছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *