আইনি কাঠামো পর্যালোচনা ও সংস্কার, নির্বাচন-প্রক্রিয়া সহজ ও যুগোপযোগী করা, সংসদীয় এলাকার সীমানা পুনর্নির্ধারণসহ মোটাদাগে সাতটি বিষয় সামনে রেখে অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপ করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। বাকি বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়ন, ভোটকেন্দ্র স্থাপন, নতুন দলের নিবন্ধন ও নিবন্ধিত দলের নিরীক্ষা এবং সুষ্ঠু নির্বাচন করতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সক্ষমতা বাড়ানো।
তবে এগুলো ছাপিয়ে সংলাপে প্রধান হয়ে ওঠে নির্বাচনকালীন সরকার, নির্বাচনের সময় সংসদ বহাল রাখা না-রাখা ও সেনা মোতায়েনের মতো বিষয়গুলো। পর্যালোচনায় বেরিয়ে আসে ইসির পথনকশায় যেসব বিষয় গুরুত্ব পেয়েছে, রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে সেগুলো ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়।
নির্বাচন কমিশন সূত্র বলছে, সংলাপে পাওয়া প্রস্তাবগুলো সমন্বয় করে নভেম্বরে খসড়া তৈরি করা হবে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সুপারিশমালা চূড়ান্ত করবে ইসি। সুপারিশগুলো বই আকারে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে। প্রস্তাবগুলোর মধ্যে যেগুলো নিজেদের কর্মপরিধিতে পড়বে, সেগুলো নিজেদের মতো করে বিবেচনা করবে ইসি। আর রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক বিষয়গুলো নিয়ে ইসি কী করতে পারে, তা কমিশন বসে ঠিক করবে। আজ বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় সংলাপ-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরবে ইসি।
জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম বলেন, সংলাপে পাওয়া মতামত, প্রস্তাবগুলো নিয়ে নির্বাচন কমিশন সচিবালয় কাজ করছে। নির্বাচনকালীন সরকার, সংসদ ভেঙে দেওয়ার মতো প্রস্তাবগুলোতে ইসির কিছু করার আছে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে রফিকুল ইসলাম বলেন, একেবারেই যে কিছু করার নেই, তা-ও নয়। বিভিন্ন দল যে দাবিগুলো জানাল, তা দেশবাসী জেনেছে, সরকার জেনেছে। যার যার কাছে পৌঁছানো দরকার, পৌঁছেছে। এটা ইসির সংলাপের একটি ফসল বলে মনে করেন তিনি।
এদিকে সংলাপ পর্ব শেষ হওয়ার পরদিনই গতকাল বুধবার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আগামী নির্বাচনের আগে সংবিধান সংশোধন করার কোনো সুযোগ নেই। গতকাল পৃথক এক অনুষ্ঠানে একই বক্তব্য দিয়েছেন ১৪ দলের সমন্বয়কারী মোহাম্মদ নাসিম।
অন্যদিকে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি সহায়ক সরকারের রূপরেখা প্রস্তুত করেছে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকালই বলেছেন, নির্বাচন কমিশনের ওপর তাদের কোনো আস্থা নেই। এ পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে হবে—সেই রাজনৈতিক বিতর্ক সামনে জোরদার হবে। এখানে ইসির সরাসরি কিছু করার নেই। তবে সংলাপ শেষ হওয়ার পর রাজনৈতিক বিষয়ে ইসির ভূমিকা কী হবে, তা মূল আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে।
অবশ্য বিশিষ্টজনেরা বলছেন, রাজনৈতিক বিষয়ে ইসির করণীয় বেশি কিছু না থাকলেও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ইসির সাহসিকতা ও অনমনীয়তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করবে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নিজেদের স্বার্থেই কথা বলবে। এর মধ্যে বর্তমান পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে কী ধরনের সমস্যা হতে পারে, তা ইসিকে ভাবতে হবে, সেভাবেই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে হবে।
জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক—সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, বল এখন ইসির কোর্টে। আওয়ামী লীগ-বিএনপি নিজেদের স্বার্থেই কথা বলবে। রেফারি হিসেবে ইসির দায়িত্ব সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা। এ জন্য কী কী করতে হবে, তা ইসিকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তাদের এ কথা বলার সুযোগ নেই যে এটা-ওটা তাদের এখতিয়ারের বাইরে। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যা যা অপরিহার্য, তারা সরকারকে বলবে। সরকার সহায়তা না করলে ইসি যদি মনে করে যে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়, তাহলে তারা বলতে পারে যে তারা নির্বাচন করবে না।
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি পূরণ না হওয়ায় বিএনপি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে। আর সংবিধান অনুসারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের অধীনেই নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ। এখনো দুই রাজনৈতিক জোট তাদের নিজ নিজ অবস্থানে অটল আছে। এ অবস্থায় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে গত ৩১ জুলাই থেকে অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপ শুরু করেছিল ইসি। গত মঙ্গলবার নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সংলাপের মধ্য দিয়ে তা শেষ হয়।
ইসির সংলাপে দেওয়া প্রস্তাবগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ৪০টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মধ্যে ২৫টি দল সেনাবাহিনী মোতায়েনের পক্ষে মত দিয়েছে। এর মধ্যে ১০টি দল সেনাবাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। এটি করতে হলে আইনে সংশোধনী আনতে হবে। ১৯টি দল নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দিতে বলেছে। অন্তত ১৫টি দল নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন করার প্রস্তাব দিয়েছে। এটি করতে হলে সংবিধানে সংশোধনী আনতে হবে। এর আগে সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সংলাপেও এসব বিষয় প্রাধান্য পেয়েছিল। বিএনপিসহ বিরোধী শিবিরে থাকা দলগুলো বলছে, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য এই বিষয়গুলোই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
এ বিষয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, রাজনৈতিক বিষয়গুলো নিয়ে ইসির খুব বেশি করণীয় নেই। তাদের করণীয় হলো এ অবস্থায় কী ধরনের পরিবেশ তারা সরকারের কাছে চাইবে, তার পরিকল্পনা করা। নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা হচ্ছে, নির্বাচনকালীন সরকার যেভাবেই থাকুক, তফসিল ঘোষণার পর থেকে ইসিকে সরকারের ‘সুপারভাইজারি রোল’-এ থাকতে হবে। এটা আইন আকারে থাকা উচিত, যাতে সরকারের বাধ্যবাধকতা থাকে।
নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, এই সংলাপ আয়োজন করে ইসি সন্তুষ্ট। বিএনপি ইসির কঠোর সমালোচনা করে এলেও সংলাপে অংশ নিয়েছে। সব দল বিশেষ করে, বিএনপি সংলাপে অংশ নেওয়ার মধ্য দিয়ে কমিশনের আস্থা বেড়েছে বলে কমিশন মনে করছে।
তবে বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক সূত্র জানায়, তারা ইসির সংলাপে অংশ নিয়েছে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে। কিন্তু তারা মনে করে, এই কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। বিএনপির কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার। বিএনপি মনে করে, সরকার নিরপেক্ষ না হলে ইসি যতই শক্তিশালী হোক, তাদের পক্ষে নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব নয়।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল এক অনুষ্ঠানে বলেন, এখন জাতি তাকিয়ে আছে ইসি কী করে? কিন্তু ইসি কিছুই করতে পারবে না। কারণ, সরকারের বাইরে গিয়ে তাদের বিরুদ্ধে কাজ করার শক্তি কমিশনের নেই।
এদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নির্বাচনকালীন সরকার ও সংসদ রাখা না-রাখা নিয়ে ইসিকে কোনো প্রস্তাব দেয়নি। তবে দলটির নেতারা সংলাপে অংশ নিয়ে বলেছেন, সংবিধান অনুযায়ী শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনের বিষয়টি মীমাংসিত। এটা পরিবর্তন বা এ বিষয়ে আলোচনার প্রয়োজন নেই। আর নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন বা সেনাবাহিনীর বিচারিক ক্ষমতা নিয়ে দলটির ভূমিকা বিএনপিসহ কয়েকটি দলের বিপরীতে। এ বিষয়টি নিয়েই আওয়ামী লীগে কিছুটা অস্বস্তি রয়েছে।
আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপের বিষয়টি একটা আনুষ্ঠানিকতা। এই সংলাপের মূল লক্ষ্য নির্বাচন ব্যবস্থাপনা। সাংবিধানিক বিষয়ে ইসির সিদ্ধান্ত দেওয়ার সুযোগ নেই।