ভাষণ আর বাস্তব
গত সেপ্টেম্বর মাসের এক সকাল। মধ্য মিয়ানমারে দেশের নয়া রাজধানী নেপিডোর আন্তর্জাতিক কনভেনশন সেন্টারে তখন সুচ পড়লেও শব্দ শোনা যাবে। ইউরোমানির বিশ্ব বিনিয়োগ ফোরামে যোগ দিতে আসা দুনিয়ার আর্থিক মহলের তাবৎ বিশেষজ্ঞ রয়েছেন শ্রোতার আসনে। মঞ্চে তখন মিয়ানমারের বিদেশ প্রতিমন্ত্রী য়ু মাউং মাউং উইন প্রাণপণে বোঝানোর চেষ্টা করে চলেছেন যে যত মুশকিলই হোক না কেন, সংস্কারের রাস্তা থেকে মিয়ানমার সরবে না।
উল্লেখ্য, ২০০৬ সালে ইয়াঙ্গুন থেকে ৩২০ কিলোমিটার উত্তরে নেপিডোতে রাজধানী সরায় জেনারেল থান সোয়ের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন সামরিক জান্তা। ১৮৫৩ সাল থেকে এই মহানগর মিয়ানমারের রাজধানী ছিল। রাজধানী পাল্টানোর ফলে মিয়ানমারের ইতিহাসের একটা যুগের অবসান হলো বলা যায়।
কনভেনশন হলে এদিকে মন্ত্রী মশাই প্রাণপণে চেষ্টা করে চলেছেন বিশ্বের সামনে ‘কই, কিছু হয়নি তো। সব ঠিকই তো আছে’ চিত্র তুলে ধরতে। এর কারণ খুঁজতে বেশিদূর যাওয়ার অবশ্য দরকার নেই। অভিযোগ উঠেছে, কনভেনশন সেন্টারের থেকে কয়েক শ কিলোমিটার পশ্চিমে রাখাইন প্রদেশে চলছে এক মারণ ধ্বংসযজ্ঞ, যেখানে পরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গা জনজাতিদের ভিটেমাটিছাড়া করে, খুন, ধর্ষণ, লুটের স্টিমরোলার চালিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। ঠিক এই চিত্রটাই মিয়ানমারের সেনাকর্তারা অস্বীকার করতে মরিয়া।
তবে শাক দিয়ে কত দিন আর মাছ ঢাকা যায়? পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে এক বস্ত্রে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়ে পালিয়ে আসছে যে লাখো রোহিঙ্গা জনজাতির মানুষ, তারা তো আর পর্যটক নয়। তারা ছিন্নমূল শরণার্থী। ৪ অক্টোবর পর্যন্ত সরকারি হিসাবে প্রায় ৫ লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। বেসরকারি হিসাবে অবশ্য সংখ্যাটা ছয় লাখ ছাড়িয়ে গেছে। আর ঢাকার পক্ষে যেটা উদ্বেগজনক তা হলো, এই জনস্রোত কিন্তু থামার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। মানুষের ঢল হয়তো কমেছে, কিন্তু বন্ধ হয়নি।
তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, মিয়ানমারের শাসককুল যতই সত্যকে অস্বীকার করার চেষ্টা করুক না কেন, বিশ্বব্যাপী ক্রমেই বাড়তে থাকা সমালোচনার ঝড়ের হাত থেকে বাঁচার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। অং সান সু চিকে সামনে রেখে আদতে সেনাবাহিনীর জেনারেলরা যে কলকাঠি নাড়ছেন, তা বিশ্বের কাছে ক্রমেই পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। পরিস্থিতি ক্রমেই হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে বুঝতে এখন সব বিবদমান পক্ষের মধ্যে শান্তি বৈঠকের কথাও বলা হচ্ছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা অন্য প্রশ্ন তুলছেন। তাঁদের শঙ্কা, মিয়ানমার যত দিন না শত শত বছর ধরে থাকা রোহিঙ্গা মুসলিমদের নিজের দেশের বাসিন্দা বলে স্বীকার করছে, তত দিন সত্যিই কি শান্তি ফেরানো সম্ভব? তাঁদের মতে, এটুকু করা না হলে পুরো শান্তিপ্রক্রিয়াই হবে আগুনকে ছাইচাপা দেওয়ার চেষ্টামাত্র। ধিকিধিকি আগুন জ্বলতেই থাকবে। আর কোনো কারণ পেলেই আগুন তার লেলিহান শিখা দেখাবে। তাই ২০১২ সালের রক্তের দাগ ২০১৭ সালে মুছল তো না-ই, উল্টে আরও ভালো করে লাগল।
তাই বিশেষজ্ঞদের সতর্কবাণী, একটা সহজ সত্য সেনানায়কেরা বিস্মৃত হয়েছেন বলে মনে হচ্ছে আর তা হলো সুস্থ-শান্ত পরিবেশ না থাকলে প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নি (ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট বা এফডিআই) ব্যাহত হবে। মিয়ানমার অর্থনীতির খোলনলচে পাল্টানোর জন্য যে সংস্কারযজ্ঞ শুরু হয়েছে, তা কিন্তু কার্যত বিদেশি লগ্নির ওপরই নির্ভরশীল। আর রাখাইন প্রদেশের উপকূলে বিপুল প্রাকৃতিক গ্যাস আর তেলের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে, তা একাই মিয়ানমারের তো বটেই, আশপাশের দেশগুলোর অর্থনীতির ওপরও বড়সড় প্রভাব ফেলতে সক্ষম।
কিন্তু মানবাধিকার লঙ্ঘনের সীমা পেরোলে বিদেশি লগ্নির ভরসার খুঁটি কিন্তু নড়ে যেতে পারে। ইতিমধ্যেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ঘোষণা করেছে যে মিয়ানমারের সেনানায়কেরা আমন্ত্রিত নন। আর এটা শাস্তির প্রথম ধাপমাত্র। রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা না মেটালে শাস্তির মাত্রা যে বেড়েই চলবে, তা-ও বলে সতর্ক করেছে ইইউ।
পাশাপাশি ওয়াশিংটন গোটা ঘটনার জন্য কার্যত মিয়ানমারের সেনা কর্তাদের কাঠগড়ায় তুলেছে। মার্কিন প্রশাসন সাফ জানিয়েছে, তারা গোটা ব্যাপারটায় নীরব দর্শক হয়ে থাকবে না। এই ধ্বংসলীলার জন্য কে দায়ী, তা খুঁজে বের করা হবে। আর ভবিষ্যতে দেশের জন্য মিয়ানমার সেনাবাহিনী কোন ভূমিকা পালন করবে, তা সেনা কর্তাদেরই ঠিক করতে হবে। মার্কিন কংগ্রেসের ৪৩ জন সদস্য মিয়ানমার সেনাকর্তাদের আমেরিকায় প্রবেশ নিষিদ্ধ করা ও ক্ষেত্রবিশেষে আর্থিক নিষেধাজ্ঞা ফের চাপানোর দাবি তুলেছেন।
আর্থিক সংস্কারের মূল জ্বালানি বিদেশি লগ্নি
মিয়ানমার অর্থনীতির হালহকিকত একটু জানা যাক, যাতে বোঝা যায় কেন বিদেশি লগ্নি সে দেশের হাল ফেরানোর জিয়নকাঠি।
২০১৩ সালের জানুয়ারিতে বিভিন্ন আর্থিক ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য সংসদে ৩০টা বিল পেশ করা হয়। এরপর বিদেশি লগ্নির যেন জোয়ার লাগল। শুধু ২০১২ সালেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে ২ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার (১ বিলিয়ন সমান ১০০ কোটি) বিদেশি লগ্নি এল। ২০১৩-১৪ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসেই ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার বিদেশি লগ্নি আসে। ২০১৫ সালে এটা ২ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার হলেও পরের বছর ফের কমে হয় ২ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিদেশি লগ্নির এই রকমের ওঠা-নামা মিয়ানমারের প্রতি খুব একটা আস্থাশীলতার পরিচয় নয়। মিয়ানমার বিনিয়োগ কমিশনের অবশ্য দাবি, চলতি অর্থবছরে তারা ৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার বিদেশি লগ্নি অনুমোদন করেছে। কিন্তু রাখাইনের সেনা-সন্ত্রাস কিন্তু অনেক হিসাবই উল্টে দিতে পারে। বিশেষ করে ইইউ আরও কোনো শাস্তির কথা ঘোষণা করলে পরিস্থিতি ঘোলাটে হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
আর্থিক সংস্কারের শুরুটা কিন্তু বেশ আশাব্যঞ্জকই ছিল। শুরুতেই ২০১৩ সালে সাড়ে ৫ কোটি মানুষের দেশ বছরে ৮ দশমিক ৫ শতাংশ আর্থিক বৃদ্ধি ছুঁয়ে ফেলে। বিশ্বের অন্যতম দ্রুত বৃদ্ধি সেটা। কিন্তু ২০১৫ সালের ভয়ংকর বন্যা মিয়ানমারের আর্থিক গতিকে ৫ দশমিক ৯ শতাংশে নামিয়ে আনে। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, আগামী তিন বছরে গড়ে ৭ দশমিক ১ শতাংশ বার্ষিক বৃদ্ধির হার হবে। অর্থাৎ গতি শুধু কমেইনি, ধরে রাখাও বেশ কষ্টসাধ্য হচ্ছে। মনে রাখা জরুরি, এই হিসাবও রাখাইন-কাণ্ডের আগে করা।
এ তো গেল সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতি, যেখানে টেলিযোগাযোগ থেকে রাস্তা, হাসপাতাল থেকে পানীয় জল, স্কুল থেকে বিদ্যুৎ—সবক্ষেত্রে ঢেলে সাজাতে মিয়ানমার বিদেশি লগ্নির দিকে তাকিয়ে আছে।
রাখাইন: রক্তস্নাত বেলাভূমি না সোনালি ভবিষ্যৎ?
পরিস্থিতির গুরুত্ব আরও ভালো করে বুঝতে রাখাইন রাজ্যের দিকেই তাকানো যাক। এমনিতেই বিশ্বব্যাংক মিয়ানমারের আর্থিক ভবিষ্যৎ, বিশেষ করে রপ্তানি বাণিজ্য নিয়ে উচ্ছ্বসিত, তা ঠিক বলা যাবে না। তার ওপর রাখাইন হলো দেশের ১৪টি রাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে দরিদ্র। তাই সেখানে যখন কায়ুখফু ও পার্শ্ববর্তী এলাকার সমুদ্রে তেল আর প্রাকৃতিক গ্যাসের ভান্ডারের খোঁজ মিলল, তখন মনে করা হলো, এবার মিয়ানমারের সত্যি একটা হিল্লে হলো। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে কায়ুখফুর অদূরে সমুদ্রে মিয়ানমার অয়েল অ্যান্ড গ্যাস এন্টারপ্রাইজ (মোগা) আর চিনারি অ্যাসেটস লিমিটেড তেল খোঁজা শুরু করে। এরপর কায়ুখফু আর পেছনে ফিরে তাকায়নি।
২০০৭ সালে মূলত কলকাতা ও চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে ইয়াঙ্গুনের বাণিজ্য করার জন্য মাদে দ্বীপে কায়ুখফু বন্দর গড়ে তোলা হয়েছে। ২০১০ সালের নভেম্বরে চীন উন্নয়ন ব্যাংক আর মিয়ানমার বিদেশি লগ্নি ব্যাংকের যৌথ প্রয়াসে কায়ুখফু থেকে চীনের ইউনান রাজ্যের কুনমিং অবধি ২৪০ কোটি ডলার ব্যয়ে ১ হাজার ৬০ কিলোমিটার লম্বা, দিনে ৪ লাখ ব্যারেল তেল নিয়ে যাওয়া যায়—এমন পাইপলাইন তৈরি করে। এ ছাড়া বছরে ১ হাজার ২০০ কোটি ঘনমিটার প্রাকৃতিক গ্যাস তোলার প্রকল্পে দক্ষিণ কোরিয়াসহ কয়েকটি দেশের গোষ্ঠী মোগার সঙ্গে হাত মিলিয়েছে।
এ ছাড়া ১ হাজার ২১৫ কিলোমিটার লম্বা কায়ুখফু-কুনমিং রেলপথও করার কথা। কয়েকটি চীনা সংস্থার সঙ্গে হাত মিলিয়ে কয়েক শ কোটি ডলার ব্যয়ে ২০২৫ সাল নাগাদ হাজার হেক্টর জমির ওপর বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হবে। সব ঠিকঠাক চললে শুধু এই অর্থনৈতিক অঞ্চল থেকেই মিয়ানমার বছরে এক হাজার কোটি ডলার আয় করতে পারবে, লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থানও হতে পারে। সব মিলিয়ে এই অঞ্চল শুধু যে দেশের অর্থনীতির ওপরই বড়সড় প্রভাব ফেলবে তা-ই নয়, এর থেকে পড়শি দেশগুলোও লাভবান হবে। রাখাইন উপকূলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও দেশের পর্যটনশিল্পের একটা বড় পাওনা। দেশে ৩৫ লাখ পর্যটক আনার যে পরিকল্পনা করা হচ্ছে, তার মধ্যে রাখাইনেরও বড় ভূমিকা আছে।
যে অবর্ণনীয় দুর্দশার মধ্যে রোহিঙ্গারা পড়েছে, তা দীর্ঘস্থায়ী সমাধান কিন্তু মিয়ানমারকেই করতে হবে। না হলে অর্থনৈতিক সচ্ছলতার যে স্বপ্ন সাড়ে পাঁচ কোটি মিয়ানমারবাসী দেখছে, তা দিবাস্বপ্নে পরিণত হতে বেশি সময় লাগবে না।