রাজশাহীতে মাদক ব্যবসায়ীদের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে পুলিশ একটি ‘উদ্যোগ’ শুরু করেছিল এক বছর আগে। কিন্তু সেই উদ্যোগ এখন পুলিশের কারণেই বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। একশ্রেণির অসাধু পুলিশ সদস্য আত্মসমর্পণকারী মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করছেন। অর্থ না পেলে নতুন করে মামলায় ফাঁসিয়ে দিচ্ছেন। ফলে আত্মসমর্পণকারীও নতুন করে এই অবৈধ ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছেন।
মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের অভিযোগে পুলিশের এক কর্মকর্তা ও একজন কনস্টেবলের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। আরও চারজনের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগের তদন্ত চলছে। এ ছাড়া জেলা পুলিশ লাইনসের দুজন সদস্য ফেনসিডিলসহ গ্রেপ্তার হয়েছেন। আর আত্মসমর্পণকারী ১৬ জন মাদক ব্যবসায়ীকে মাদকসহ আবার গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
রাজশাহী মহানগর পুলিশ কমিশনারের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, আগের পুলিশ কমিশনার শফিকুল ইসলাম মাদক ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসনের এই উদ্যোগ শুরু করেছিলেন। গত বছরের ১৮ জুন যোগ দিয়ে গত ৪ আগস্ট পর্যন্ত তিনি রাজশাহীতে ছিলেন। এই সময়ের মধ্যে ৩১৩ জন মাদক ব্যবসায়ী আত্মসমর্পণ করেন। এ উপলক্ষে বিভিন্ন এলাকায় বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। আত্মসমর্পণকারীরা মাদক ব্যবসা ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার অঙ্গীকার করেন। পুলিশের পক্ষ থেকে তাঁদের মধ্যে ১১৭ জনকে সেলাই মেশিনসহ আর্থিক সহযোগিতা দেওয়া হয়।
যেভাবে অর্থ আদায়
পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, গত ৩০ মে বিকেলে রাজপাড়া থানার তৎকালীন এএসআই মাসুদ নগরের বাকির মোড় এলাকার একজন আত্মসমর্পণকারী মাদক ব্যবসায়ীর বাড়িতে যান। তিনি বাড়ি তল্লাশি করে কিছু না পেয়েও তাঁকে আটক করে থানায় নেওয়ার হুমকি দেন। একপর্যায়ে তাঁর কাছ থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা আদায় করেন। তা ছাড়া ওই দিন গভীর রাতে এএসআই মাসুদ সাদাপোশাকে নগরের বাগানপাড়া এলাকার আত্মসমর্পণকারী আরেক মাদক ব্যবসায়ীর বাড়িতে অভিযান চালিয়ে মাদক রাখার অভিযোগ তোলেন। এ সময় তিনি ওই থানার আরও একজন এএসআইকে ডেকে নেন। দুজন মিলে ওই পরিবারের কাছ থেকে দুই লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। পরে ৬৫ হাজার টাকায় রফা হয়। মাসুদ সেখান থেকে পরদিন সন্ধ্যায় ৩০ হাজার টাকা এবং গত ২ জুন বাকি ৩৫ হাজার টাকা আদায় করেন।
মুঠোফোনে জানতে চাইলে এএসআই মাসুদ বলেন, রাজপাড়া থানায় দায়িত্ব পালনের সময় তিনি সবচেয়ে বেশি মামলা দিয়েছেন। এতে প্রতিহিংসাবশত তাঁর বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ করা হয়েছে।
এ ছাড়া কনস্টেবল মনির নগরের গুঁড়িপাড়া এলাকার একটি সেলুনে রাজপাড়া থানার অন্য একজন এএসআইকে সঙ্গে নিয়ে মাদক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে টাকা আদায় করেন বলে অভিযোগ আছে। অজ্ঞাত স্থান থেকে রাজশাহী কার্যালয়ে পাঠানো একটি ভিডিও চিত্রে টাকা লেনদেনের দৃশ্য দেখা গেছে। ভিডিও চিত্রে কনস্টেবল মনিরকে অর্থ লেনদেনে মধ্যস্থতা করতে দেখা যাচ্ছে। এ ঘটনায় গত জুনে তাঁকে পুলিশ লাইনসে প্রত্যাহার করা হয়।
জানতে চাইলে কনস্টেবল মনির বলেন, ‘অন্য একজন পুলিশ সদস্য ওই সেলুনে উপস্থিত ছিলেন। ফোন করে ডেকে নিয়ে আমাকে ফাঁসাতে আমার হাতে টাকা দেওয়া হচ্ছিল। বিষয়টি বুঝতে পেরে আমি ওই টাকা ফেরত দিয়েছি।’
গত ২৫ সেপ্টেম্বর নগরের ছোট বনগ্রাম এলাকার বারো রাস্তার মোড়ের মাদক ব্যবসায়ী কমেলা বেগম ও তাঁর নাতনি সুমাইয়া মহানগর পুলিশ কমিশনারের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। এতে নগরের বোয়ালিয়া থানার এএসআই মোস্তফা, বুলবুল, রইচ ও ফারুকের বিরুদ্ধে তাঁর কাছ থেকে টাকা আদায়ের অভিযোগ করা হয়। অভিযোগে বলা হয়, গত ২২ সেপ্টেম্বর ভোরে ওই পুলিশ কর্মকর্তারা তাঁদের বাড়িতে ঢুকে কমেলার কাছে দুই লাখ টাকা দাবি করেন। টাকা না দিলে তাঁকে ইয়াবার মামলায় ফাঁসানোর হুমকি দেন। একপর্যায়ে ১ লাখ ৪৬ হাজার টাকা আদায় করেন। বোয়ালিয়া থানার সহকারী কমিশনার (এসি) সোহরাওয়ার্দী হোসেন ঘটনাটি তদন্ত করছেন। তিনি বলেছেন, ‘তদন্ত চলছে। ২ অক্টোবর কমেলা ও সুমাইয়ার সঙ্গে আমি বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছি।’
কমেলা বেগম বলেন, বড় ছেলে মারা যাওয়ার পর অন্য তিন সন্তানকে মানুষ করার জন্য মাদক ব্যবসা শুরু করেছিলেন, কিন্তু এখন ছেড়ে দিয়েছেন। তাঁর বাড়িতে কোনো মাদকদ্রব্য না পেয়েও সমিতি থেকে ঋণ করা ১ লাখ ৪৬ হাজার টাকা পুলিশ নিয়ে যায়। পরদিন আরও ৪ হাজার টাকার জন্য পুলিশ কর্মকর্তা মোস্তফা তাঁদের বাড়ি গিয়ে নাস্তানাবুদ করেন। এই পরিস্থিতিতে পুলিশ কমিশনারের কাছে অভিযোগ দেন তিনি।
গত বৃহস্পতিবার সকালে জেলা পুলিশ লাইনসের দুই সদস্য নাজিম উদ্দিন ও জিয়াউর রহমানকে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরা শহরের পার্শ্ববর্তী পবা উপজেলার সোনাইকান্দি এলাকা থেকে ১৫ বোতল ফেনসিডিলসহ আটক করেন। ওই দিনই দুজনকে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে।
নগরের বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, আত্মসমর্পণকারীরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাইলেও পুলিশের কিছু সদস্য এতে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন। তাই আত্মসমর্পণকারীরা কৌশল পাল্টে মাদক ব্যবসা চালাচ্ছেন। গত ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৬ জন আত্মসমর্পণকারীকে মাদকসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে কুখ্যাত মাদক ব্যবসায়ী পঞ্চবটী এলাকার হামিদা, পাপড়ি ও খরবোনা এলাকার তাপস রয়েছেন। পুলিশের কিছু কর্মকর্তা ও সদস্য এসব ব্যবসায়ীর কাছ থেকে অর্থ আদায় করছেন। এ অভিযোগে গত জুনে নগরের রাজপাড়া থানায় দায়িত্বে থাকা অবস্থায় সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মসুদের নামে বিভাগীয় মামলা হয়। মামলাটির তদন্ত চলছে। একই অভিযোগে রাজপাড়া থানার পুলিশ কনস্টেবল মনিরকে একই সময়ে পুলিশ লাইনসে প্রত্যাহার করা হয়।
সরেজমিনে দেখা যায়, নগরের মাদকের ঘাঁটিগুলোতে আগের মতোই খোলামেলা মাদক বিক্রি হচ্ছে। ২ অক্টোবর বেলা দুইটায় পঞ্চবটি এলাকায় দেখা গেছে, মাদক ব্যবসায়ী জিল্লু সরদারের বাড়ির সামনে একটি টিনের চালাঘরের ভেতরে প্রকাশ্যে মাদকদ্রব্য কেনাবেচা চলছে। সেখানে আধা ঘণ্টার মধ্যে প্রায় ১০ জন মাদকসেবীকে মাদক কিনতে দেখা গেল। পরিচয় গোপন করে দাম জানতে চাইলে বিক্রেতা এই প্রতিবেদককে বলেন, ছোট ইয়াবা ১০০ টাকা, বড় বড়ি ৩০০ টাকা আর এক বোতল ফেনসিডিল ৮০০ টাকা। বেলা আড়াইটার দিকে কথোপকথনের একপর্যায়ে ওই যুবকের মুঠোফোন বেজে ওঠে। তিনি ফোনটি ধরে মাদক ব্যবসায়ী জিল্লু সরদারের স্ত্রীকে বলেন, কাকি থানা থেকে ফোন। পরে জিল্লুর স্ত্রী মুঠোফোনে কথা বলতে বলতে টিনের চালাঘরের ভেতরে চলে যান। এ স্থানটি নগরের বোয়ালিয়া থানা ও বোসপাড়া পুলিশ ফাঁড়ি থেকে আধা কিলোমিটারের মধ্যে।
তা ছাড়া একদল ভ্রাম্যমাণ মাদক ব্যবসায়ী সম্পর্কেও তথ্য পাওয়া গেছে। মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে এই চক্র যেকোনো জায়গায় মাদক পৌঁছে দেয়।
রাজশাহী মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. মাহাবুবর রহমান বলেন, কমেলা বেগম মাদক ব্যবসায়ী। তবে তাঁর কাছ থেকে টাকা নেওয়ার অভিযোগটি তদন্ত করা হচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আত্মসমর্পণের প্রক্রিয়াকে তাঁরা আরও এগিয়ে নিতে চান। তবে আত্মসমর্পণের পরও যাঁরা আবার ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছেন, তাঁদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। তাঁদের বিরুদ্ধে আরও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর পুলিশের দুজন সদস্যের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। আরও কেউ জড়িত থাকলে তাঁদের প্রথমে সাময়িক বরখাস্ত করা হবে। পরে অভিযোগ প্রমাণিত হলে বিভাগীয় শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মতবিনিময় সভা
মাদক ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে প্রত্যাবর্তনকারীদের নিয়ে গতকাল শনিবার নগরের শাহ মখদুম থানা চত্বরে মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়। এতে নগরের মতিহার ও শাহমখদুম থানার ১১২ জন আত্মসমর্পণকারী মাদক ব্যবসায়ীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তবে তাঁদের ৩৮ জন আসেননি।
বেলা ১১টা থেকে ২টা পর্যন্ত চলে এই সভা। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার সরদার তমিজ উদ্দিন। সভাপতিত্ব করেন উপকমিশনার (পূর্ব) এ কে এম নাহিদুল ইসলাম।
সভায় বক্তারা বলেন, মাদক ব্যবসায়ী ও মাদকসেবীদের স্বাভাবিক জীবনে পুনর্বাসিত করার জন্য সারা দেশের পুলিশের এক দিনের বেতন নিয়ে একটি তহবিল গঠন করা হয়েছে। কোনো মাদক ব্যবসায়ী বা মাদকসেবী স্বেচ্ছায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসে ‘নতুন জীবন’ সংগঠনের সদস্য হলে তাঁদের পেছনে এই অর্থ ব্যয় করা হবে। তবে হুঁশিয়ার করা হয়, আত্মসমর্পণের পর কেউ আবার অন্ধকার জীবনে ফিরে গেলে আরও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
শাহ মখদুম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জিল্লুর রহমান বলেন, অনুপস্থিত ৩৮ জন কাজে ব্যস্ত আছেন। সভায় এলে তাঁরা এক দিনের কাজের পারিশ্রমিক থেকে বঞ্চিত হন। তাই তাঁরা অনুষ্ঠানে আসতে চাননি।