বাংলাদেশ নয়, মিয়ানমারকেই প্রাধান্য দিতে ভারত সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব কানওয়াল সিবাল। তিনি ভারত সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, মিয়ানমারের নিন্দা জানানোর মাধ্যমে ভণ্ডদের দলে যোগ দেবেন না। এক্ষেত্রে ভারতের স্বার্থে মিয়ানমার কিভাবে পূর্ব-পশ্চিম সংযুক্তিতে গুরুত্বপূর্ণ তাও তুলে ধরেছেন। তিনি ভারত-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড হাইওয়ের মাধ্যমে ভিয়েতনাম পর্যন্তু সংযুক্তির ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। বলেছেন, এমন প্রকল্পের জন্য মিয়ানমার হলো ভারতের গেটওয়ে বা প্রবেশদ্বার। এক্ষেত্রে রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে দেখা উচিত নয় বলেও তিনি মত দিয়েছেন। দ্য ইকোনমিক টাইমসে ‘ডোন্ট জয়েন হিপোক্রিটস ইন কনডেমনিং মিয়ানমার’ শীর্ষক এক মন্তব্য প্রতিবেদনে তিনি এসব পরামর্শ দিয়েছেন ভারত সরকারকে। তার এমন অবস্থান নিয়ে ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। ওদিকে তিনি অনলাইন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছেন, ‘বাংলাদেশ যদি ভারতের কাছ থেকে এ ব্যাপারে বেশি কিছু আশা করে, তাহলে ভুল করবে। ঢাকাকে বুঝতে হবে, দিল্লির পক্ষে এর বেশি কিছু করা সম্ভব নয়।’ উল্লেখ্য, কানওয়াল সিবাল ভারতের কূটনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোচিত। তিনি ক্ষমতাসীন বিজেসি সরকারকে মতামত দিয়ে থাকেন। সরকার তার মতামতকে গুরুত্ব দেয়। বিজেপির বিগত বাজপেয়ী সরকারের আমলে তিনি ছিলেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব। এছাড়া রাশিয়া, ফ্রান্স, মিসর ও তুরস্কসহ অনেক দেশে তিনি দীর্ঘদিন ভারতের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেছেন। তার ছোট ভাই কপিল সিবাল কংগ্রেসের একজন সিনিয়র নেতা ও দেশের শীর্ষ আইনজীবীদের একজন। অবসরে যাওয়ার পর ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য হিসেবেও কানওয়াল দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন। দ্য ইকোনোমিক টাইমসে তিনি লিখেছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির (৫-৭ সেপ্টেম্বরের) মিয়ানমার সফর ছিল দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক সুদৃঢ় করার ক্ষেত্রে সময়োপযোগী। রোহিঙ্গা ইস্যুতে অং সান সুচিকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রাজনৈতিক স্বস্তি দিয়েছেন। কিন্তু সুচিকে নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমালোচনা হচ্ছে। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অবরোধ পুনর্বহালের দাবি শোনা যাচ্ছে। মানবতার ইস্যুতে সুনির্দিষ্ট, ভণ্ডদের মতো যারা ‘কোরাস’ ধরছে তাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে আমাদের কৌশলগত অংশীদার মিয়ানমারকে দূরে সরিয়ে দেয়া উচিত হবে না। যারা এমনটা করছেন তারা তাদের নিম্নমানের জন্য করছেন। ওই লেখায় তিনি ইসলামিক দেশগুলোর বিরুদ্ধেও বিষোদগার করেন। তিনি লিখেছেন, যেসব মুসলিম দেশ মিয়ানমারের নিন্দা জানাচ্ছেন, কেন তারা ইয়েমেনে সৌদি আরবের হত্যাকাণ্ডের অথবা তুরস্কে কুর্দিদের বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ড এড়িয়ে যাচ্ছেন। তিব্বতের অধিবাসী ও উইঘুর মুসলিমদের বিরুদ্ধে চীন যে আচরণ করছে তাতে তারা নীরব কেন? ভারতের কাশ্মীর ইস্যুতে ওআইসি নিন্দা জানায়। কিন্তু ভারত ও আফগানিস্তানে পাকিস্তান যে সন্ত্রাসের মদত দিয়ে যাচ্ছে সে বিষয়ে কাদের কণ্ঠ অস্পষ্ট। তিনি ওই নিবন্ধে আরো লিখেছেন, দুর্ভাগ্যজনক হলো ইসলামিক দেশগুলো মানবিক ইস্যুগুলো দেখে থাকে প্রাথমিকভাবে ধর্মের প্রিজমে। হতে পারে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমার ভুলভাবে হস্তক্ষেপ করছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে যে জটিলতা (কমপ্লেক্সিটি) তাকে এড়িয়ে যাওয়া উচিত হবে না সমালোচকদের। কানওয়াল সিবাল লিখেছেন, কৌশলগতভাবে বহুবিধ কারণে মিয়ানমার আমাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো, যা বিদ্রোহপ্রবণ ও অর্থনৈতিকভাবে অনুন্নত সেই রাজ্যগুলো এ দেশটির সঙ্গে সংযুক্ত (সীমান্ত দ্বারা)। বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর মোকাবিলা করার জন্য মিয়ানমারের সহযোগিতা আমাদের প্রয়োজন। এ ছাড়া সংযুক্তি বিষয়ক প্রকল্পে তারা আমাদের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। এই সংযুক্তির মাধ্যমে এই ‘ল্যান্ড-লক’ বা অবরুদ্ধ অঞ্চলকে বঙ্গোপসাগর ও আসিয়ানের সঙ্গে যুক্ত করা যাবে। এই সংযুক্তির ফলে আমাদের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর উন্নয়নে সহায়ক হবে। ফলে তারা ভারতের অন্য এলাকাগুলোতে তাদের অবদান রাখতে পারবে। এর মাধ্যমে তাদের প্রতি যে অবজ্ঞামূলক অনুভূতি আছে তা দূর করা যাবে। তিনি এক্ষেত্রে চীনের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। তিনি মনে করেন, ভারতের এই উচ্চাশার ক্ষেত্রে চীন বাধা। চীন উত্তর-দক্ষিণ সংযুক্তি গড়ে তোলার মাধ্যমে এ অঞ্চলের সঙ্গে চীনের অর্থনীতিকে যুক্ত করতে চাইছে। তার মাধ্যমে তারা এখানে রাজনৈতিক সুবিধা অর্জন করতে চায়। এক্ষেত্রে কানওয়াল সিবাল পূর্ব-পশ্চিম সংযুক্তির ওপর গুরুত্ব দেন। লিখেছেন, ত্রিদেশীয় মহাসড়ক যা ভারত-মিয়ানমার- থাইল্যান্ড হয়ে ভিয়েতনাম পর্যন্ত বিস্তৃত হবে সে প্রসঙ্গটি তুলে ধরেন। এক্ষেত্রে মিয়ানমার হলো ভারতের জন্য গেটওয়ে বা প্রবেশদ্বার। সিবাল লিখেছেন, মিয়ানমারেও চীন শক্ত অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে। এর মাধ্যমে তারা বঙ্গোপসাগরে পৌঁছার সুযোগ করে নিয়েছে। তারা পাইপলাইন ও বন্দর বিষয়ক প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এটা সিল্ক রোড স্ট্রাটেজি বলে পরিচিত। মিয়ানমারে আমাদেরকে চীনের ক্ষমতা খর্ব করতে হবে। রোহিঙ্গা ইস্যু বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ককে প্রভাবিত করতে পারে না। রাজনৈতিক ভাষ্যকাররা বলেন, ভারতের বর্তমানের অবস্থানের কারণে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার তার দেশ থেকে ভারতবিরোধী বিদ্রোহীদের উৎপাটন করে সহযোগিতা করেছে। এ ক্ষেত্রে তাকে প্রতিদান দিতে ব্যর্থ হয়েছে ভারত। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রতিরক্ষা বিষয়ক অংশীদার হলো চীন। তারা সমর্থন করছে দ্য বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্প। তারা চীনের সঙ্গে সম্পর্ক ও ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে আলাদা বাক্সে রাখতে চায়। তা-ই যদি হবে, তাহলে ভারতেরও তো মিয়ানমার নীতি আর বাংলাদেশ নীতি সম্পূর্ণ আলাদা হওয়া উচিত! ভারতে দুই কোটির ওপরে বাংলাদেশি অবৈধ অভিবাসী আছেন। এ ইস্যুটি ভারত সামনে ঠেলে দিতে পারে। ভারতে অবস্থান করছেন ৪০ হাজার রোহিঙ্গা। এ কারণে, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের স্পর্শকাতর সীমান্তের ফাঁকফোকরের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত ভারতের। তিনি বলেছেন, বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে মুসলিমদের ওপর নির্যাতনের ঘটনা যেভাবে সারা দুনিয়ার নানা প্রান্তের মুসলিমকে একাট্টা আর ‘হিংসায় উন্মত্ত’ করে তোলে, সে কারণেই কিন্তু অমুসলিম দেশগুলোতে সংখ্যালঘু মুসলিমদের সেই সমাজের মূল স্রোতে ঢোকা কঠিন হয়ে ওঠে। (ইঙ্গিতটা খুব স্পষ্ট, এই যুক্তি ভারত ও মিয়ানমারের মুসলিমদের জন্যও প্রযোজ্য।) বাংলাদেশ যেন মনে রাখে, সে দেশ থেকে ভারতে আসা দুই কোটিরও বেশি অবৈধ অভিবাসীকে ফেরত পাঠানোর বিষয়টি আপাতত আমরা ধামাচাপা দিয়ে রেখেছি (ডরম্যান্ট)। আর এ দেশে যে চল্লিশ হাজারের মতো রোহিঙ্গা বাংলাদেশ দিয়েই আমাদের দেশে ঢুকতে পেরেছে, সেটা মাথায় রেখে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত জরুরিভিত্তিতে সিল করার দিকেই এখন আগে নজর দেয়া উচিত। যারা বলছেন, ভারত চিরকাল সারা পৃথিবীর নির্যাতিত মানুষকে আশ্রয় দিয়ে এসেছে, এই কনটেক্সটে এরচেয়ে বাজে কথা আর কিছু হতে পারে না। বরং ভাবার বিষয় হলো, যে মুসলিমরা জম্মু ও কাশ্মীরে হিন্দু শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়ার বিরোধিতা করে এসেছে, সেই রাজ্যে গিয়ে কিভাবে হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম বসতি করতে পারলো? এর কারণ হলো, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার মাধ্যমে জম্মুর ডেমোগ্রাফি বদল করার চেষ্টা হয়েছে। অনেক পর্যবেক্ষকই মনে করছেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে এগুলো ভারত সরকারেরও মনের কথা। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সরকার মুখে যে কথাগুলো বলতে পারছে না, কানওয়াল সিবাল সেগুলোই প্রকাশ্যে লিখেছেন। কিন্তু রোহিঙ্গা সংকটের জেরে যে বাংলাদেশকে বিনা অপরাধে বিরাট এক মানবিক বিপর্যয় সামলাতে হচ্ছে, তিনি তাদের ওপর এত খড়্গহস্ত কেন? বাংলা ট্রিবিউনের পক্ষ থেকে এই প্রশ্ন করা হয়েছিল কানওয়াল সিবালের কাছে। মেজাজি এই কূটনীতিক কেটে কেটে বললেন, ‘আমারও বাংলাদেশের জন্য সহানুভূতি আছে। কিন্তু তারা যদি মনে করে রোহিঙ্গাদের জন্য ভারত সরকার মিয়ানমারের সঙ্গে তাদের সব স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে মিয়ানমারের একতরফা নিন্দা করে যাবে, সেটা তো ঠিক হবে না, তাই না?’ টেলিফোন নামিয়ে রাখার আগে তিনি আরো যোগ করেন, ‘গত ২৪শে আগস্ট রাতে মিয়ানমার সেনা ও পুলিশের ওপর চালানো জঙ্গি হামলার পর থেকেই যে এই শরণার্থীদের আসা শুরু, সেটাও তো ভুললে চলবে না!’