মিয়ানমার বাহিনীর হত্যা-অগ্নিসংযোগ শুরুর পর থেকে একদিনে সর্বোচ্চ ৩৭ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী গতকাল বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এ নিয়ে সাম্প্রতিক সংঘর্ষে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়াল প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজারে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) মিয়ানমারের প্রতি সহিংসতা বন্ধ এবং অবিলম্বে সহিংসতাকবলিত রাখাইন প্রদেশে সাহায্যকর্মীদের প্রবেশের সুযোগ দেয়ার দাবি জানিয়েছে।
জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা জানিয়েছে, গত ১১ দিনে ১ লাখ ২৩ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ইউএনএইচসিআর মুখপাত্র ভিভিয়ান তান গতকাল জানান, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে স্থায়ী ও অস্থায়ী শিবিরগুলোয় গণনার পর শরণার্থীর এ সংখ্যা বেরিয়ে এসেছে।
এক সংবাদ সম্মেলনে ভিভিয়ান তান বলেন, শরণার্থীর এ সংখ্যা খুব উদ্বেগজনক। কারণ পুরনো শিবিরগুলো এরই মধ্যে ধারণক্ষমতার সর্বোচ্চ সীমা ছাড়িয়ে গেছে। পুরনো শরণার্থীরা নবাগতদের নিজেদের সঙ্গে থাকতে দিচ্ছে। এর বাইরে আরো হাজার হাজার মানুষ স্থানীয় গ্রামগুলোয় ও ধানক্ষেতে আশ্রয় নিয়েছে।
নতুন আসা শরণার্থীদের ব্যাপারে ইউএনএইচসিআর মুখপাত্র বলেন, এসব মানুষ কয়েক দিন ধরে হেঁটে বাংলাদেশে এসেছে। অনেকে অভুক্ত রয়েছে। আরো অনেকে শ্বাসকষ্ট, সংক্রমণ ও অপুষ্টিতে ভুগছে। অবসন্ন, আতঙ্কিত মানুষের মধ্যে রয়েছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী ও শিশু।
শরণার্থীদের সাহায্য দিতে বাংলাদেশের প্রয়াসের প্রতি ইইউ সমর্থন জানিয়েছে। মিয়ানমারের প্রতি নিপীড়ন বন্ধের আহ্বান জানিয়ে ইইউ কমিশনার ক্রিস্টস স্টাইলিয়ানাইডস গতকাল বলেন, ‘ভীষণ দুর্ভোগের’ কারণেই রোহিঙ্গারা বিরাট সংখ্যায় দেশ ছাড়ছে। এসব শরণার্থীকে আশ্রয় দিতে বাংলাদেশের প্রয়াসকে ইইউ সমর্থন করে। দেশে ফিরতে পারার আগ পর্যন্ত এদের আশ্রয় দেয়া ‘জরুরি’। ইইউ এ ব্যাপারে সাহায্য দিয়ে যাবে।
বর্তমানে ২৫-৩০ হাজার রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশু নো ম্যানস ল্যান্ডে অবস্থান করছে বলে জানিয়েছে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের মুখপাত্র ও কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খালেদ মাহমুদ।
সীমান্তের একটি পয়েন্ট দিয়ে ফেরত পাঠালেও নিরুপায় রোহিঙ্গারা আরেকটি পয়েন্ট হয়ে আরো বেশি সংখ্যায় বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। বণিক বার্তার অনুসন্ধানে জানা যায়, একবার মিয়ানমার ছাড়ার পর রোহিঙ্গাদের কেউই আর দেশটিতে ফেরত যায় না। বিজিবি ও অন্যান্য বাহিনীর তত্পরতা সত্ত্বেও নানা কৌশলে তারা আবারো বাংলাদেশে চলে আসে।
উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অনিবন্ধিত আশ্রয়গ্রহীতাদের একজন গুরা মিয়া (৭০)। তিনি জানান, নাইক্ষ্যংছড়ি তুমব্রু সীমান্তের জলপাইতলী নো ম্যানস ল্যান্ডে দুদিন অবস্থান করার পর কুতুপালং ক্যাম্পে ঢুকেছেন তিনি। তার সঙ্গে দুই পরিবারের ১৮ সদস্য রয়েছেন। ৩ সেপ্টেম্বর রাতেই তারা কুতুপালং ক্যাম্পে এসেছেন বিনা বাধায়। একইভাবে উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মেহেরুন্নেছা (৫৫), মোহাম্মদ আলম (২৮), জানে আলম (৩৫), আয়েশা বেগম (২৫), নুরুল ইসলামসহ অনেকেই নো ম্যানস ল্যান্ডে অবস্থান নেয়ার পর ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছেন।
রোহিঙ্গারা মনে করে, মিয়ানমারে ফেরত গিয়ে মৃত্যু হওয়ার চেয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসে মৃত্যুবরণ করা অনেক ভালো। এ কারণে অনেকটা অনিশ্চিত গন্তব্য জেনেও দলে দলে রোহিঙ্গারা সীমান্ত পেরিয়ে অনুপ্রবেশ করে আশ্রয় নিচ্ছে ক্যাম্পগুলোয়। ক্যাম্পে জায়গা সংকুলান না হওয়ায় রাস্তা, দোকানপাট, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিচ্ছে তারা। একটি সূত্র জানিয়েছে, সীমান্ত এলাকার স্থানীয় অধিবাসীরাও সহানুভূতিবশত রোহিঙ্গাদের নিজেদের আত্মীয় হিসেবে পরিচয় ও আশ্রয় দিচ্ছে।
জাতিসংঘের অভিবাসন-বিষয়ক সংস্থার ডিরেক্টর (অপারেশন্স অ্যান্ড ইমার্জেন্সিজ) মোহাম্মেদ আবদিকার রাখাইন প্রদেশে পরিস্থিতির উন্নতি না হলে মিয়ানমার থেকে আরো শরণার্থী বাংলাদেশে আসতে পারে বলে গতকাল এক টুইট বার্তায় জানিয়েছেন। ভূমধ্যসাগরে ঝুঁকিপূর্ণ সমুদ্রযাত্রার সময় শরণার্থীদের উদ্ধারকারী সংগঠন মাইগ্র্যান্ট অফশোর এইড স্টেশন (এমওএএস) রোহিঙ্গাদের সাহায্যের লক্ষ্যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নিজেদের কার্যক্রম স্থানান্তরের ঘোষণা দিয়েছে। মাল্টাভিত্তিক সংগঠনটি এজন্য মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তে উদ্ধারকারী জাহাজ মোতায়েন করবে বলে জানিয়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ডিরেক্টর ফর ক্রাইসিস রেসপন্স তিরানা হাসান বলেছেন, রাখাইন রাজ্য মানবিক বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সরকারের বর্বরতার প্রতিবাদে ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা, রাশিয়ার মস্কো, চেচনিয়া প্রজাতন্ত্রের গ্রোজনিসহ বিশ্বের কয়েকটি শহরে গতকাল বিক্ষোভ হয়েছে।