প্রতি ঈদ-পূজায় বাস, ট্রেন, লঞ্চের আগাম টিকিট কাটার তোড়জোড়ের মধ্য দিয়েই বাড়িতে যাওয়ার সাজ সাজ রব শুরু হয়। এবারও ঈদের ছুটি ১, ২, ৩ সেপ্টেম্বর নির্ধারিত হওয়ায় বেশির ভাগ মানুষ বাড়ি যাওয়ার দিনটি বাছাই করেছেন ৩০ বা ৩১ আগস্ট। সেই মোতাবেক এক সপ্তাহ আগেই বাস কিংবা ট্রেনের আগাম টিকিটও সংগ্রহ করেছেন অনেকে। কিন্তু এবার বন্যাজনিত কারণে উত্তরাঞ্চলের অনেক রুটেই গাড়ির সংখ্যা কমিয়ে দেওয়ায় চরম বিপাকে পড়েছেন ঘরমুখো যাত্রীরা। বাড়ি ফেরা মানুষের জন্য ঈদ মৌসুমে পরিবহন মালিকরা বাসের সংখ্যা বাড়িয়ে দেন। কিন্তু এবার দেশের উত্তরাঞ্চলগামী বাসগুলোর ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে ভিন্ন চিত্র। অধিকাংশ সড়কই বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বাস মালিকরা কমিয়ে দিয়েছেন তাদের বাসের ট্রিপের সংখ্যা—এমনটাই জানিয়েছেন পরিবহন সংশ্লিষ্টরা।
এনা পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, ‘এ বছর বন্যার কারণে উত্তরাঞ্চলের অধিকাংশ সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ কারণে মালিকরা বাসের সংখ্যা কমিয়ে দিয়েছেন। তাই ২৯, ৩০ ও ৩১ তারিখের চাহিদা খুব বেশি। প্রতিবছর আমাদের বাসের সংখ্যা ঈদে বাড়ানোর পরিকল্পনা থাকে। এবারও ছিল। কিন্তু সড়ক খারাপ হওয়ায় এবার আর তা বাড়ানো হয়নি। ’ হানিফ পরিবহনের সিনিয়র মহাব্যবস্থাপক আবদুস সামাদ মণ্ডল বলেন, ‘স্বাভাবিক সময়ে ঢাকা থেকে উত্তরাঞ্চলের প্রায় ১৭টি জেলায় যেতে ছয় থেকে আট ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছানো যেত। কিন্তু এখন সময় লেগে যাচ্ছে ১৫ ঘণ্টারও বেশি। আগে একটি বাস দুই থেকে তিন ট্রিপ দিতে পারত। এখন একবারের বেশি ট্রিপ দেওয়া যায় না। ’
বেহাল দশায় সড়ক-মহাসড়ক : ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কে উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৩০ জেলার ৯২টি রুটের যানবাহন চলাচল করে থাকে। আর ঈদের সময় এ মহাসড়কে গাড়ির চাপ থাকে অন্য সময়ের চেয়ে দশ গুণ বেশি। ফলে এ মহাসড়কে দীর্ঘ যানজটের কারণে দুই ঘণ্টার রাস্তা পার হতে সময় লাগে ছয়-সাত ঘণ্টা। এবার রাস্তার বেহাল দশায় এ আশঙ্কা আরও বেশি দেখা দিয়েছে। কারণ টানা বৃষ্টির কারণে মহাসড়কের অনেক জায়গায় ছোট-বড় অসংখ্য গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। ঢাকা থেকে গাজীপুর হয়ে টাঙ্গাইল যমুনা সেতুর পূর্ব পার পর্যন্ত এবং ঢাকা-গাজীপুর-ময়মনসিংহ রাস্তার অবস্থা খুবই করুণ। এসব রুটের অনেক স্থান রীতিমতো যানবাহন চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ব্যস্ত এ মহাসড়কের অনেক স্থানে পিচ-কার্পেটিং উঠে সৃষ্টি হয়েছে বিপজ্জনক খানাখন্দ আর গর্তের। এক ঘণ্টার রাস্তা যেতে চার-পাঁচ ঘণ্টাও লেগে যাচ্ছে। সড়ক ও জনপথ বিভাগ প্রতিদিন রাস্তার গর্তে ইট-সুরকি ফেলে কোনোমতে যানবাহন চলাচল সচল রাখছে। কিন্তু সামান্য বৃষ্টিতেই সব সংস্কার হয়ে ধুয়েমুছে আরও বেহাল দশার সৃষ্টি হচ্ছে।
রাজধানী ঢাকার প্রবেশমুখ আবদুল্লাহপুর থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত গাড়ি যেন এগোয়ই না। অন্যদিকে ভোগড়া বাইপাস থেকে কালিয়াকৈরের চন্দ্রা হয়ে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর পর্যন্ত অন্তত ৪৫ কিলোমিটার সড়কজুড়ে নিত্য যানজট। সামান্য বৃষ্টিতেই টঙ্গী থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত সড়কে নেমে আসে ভয়াবহ পরিস্থিতি। পুরো সড়ক কাদা-পানিতে একাকার হয়ে যায়। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রীরা। বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম পাড় সিরাজগঞ্জের চান্দাইকোনা থেকে গাইবান্ধার অদূরে রহবল পর্যন্ত প্রায় ৮০ কিলোমিটার সড়ক দিয়ে উত্তরের ১০ জেলার ২৬টি রুটের যানবাহন চলাচল করে। এ মহাসড়কের গর্তগুলো হয়ে উঠছে মৃত্যুফাঁদ। কাদা-পানির গর্তে গাড়ির চাকা আটকে প্রতিদিনই ছোট-বড় নানা দুর্ঘটনা ঘটছে, গাড়ি আটকে সৃষ্টি হচ্ছে দীর্ঘ যানজটের। সড়ক বিভাগ বলছে, এ মহাসড়কের প্রায় ২৫ কিলোমিটার সড়ক খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সামান্য বৃষ্টি হলে রাস্তা চরম খারাপ অবস্থায় রূপ নেয়। এ মহাসড়কে চলাচলকারী ঘরমুখো মানুষ চরম শঙ্কিত।
পাবনা-নগরবাড়ী মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে বিটুমিনসহ পাথরগুলো উঠে গেছে। রাস্তার মাঝে মাঝে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। সড়ক বিভাগ ইট-মাটি দিয়ে গর্ত পূরণ করলেও সামান্য বৃষ্টিতেই আগের অবস্থায় ফিরে যায় সড়ক। প্রবল বর্ষণ আর সড়ক ও জনপথ বিভাগের গাফিলতির কারণে সিরাজগঞ্জ জেলা অংশের সড়কগুলোর অবস্থাও বেহাল হয়ে পড়েছে। মহাসড়ক মেরামতে ছয় কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও কাজ না করে তা নয়ছয় করার অভিযোগ উঠেছে। দক্ষিণবঙ্গের ঘরমুখো যাত্রীরা মহাদুুশ্চিন্তায় আছেন ফেরি পারাপার নিয়ে। পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে ১৮টি ফেরির মধ্যে নয়টিই বিকল। অন্যদিকে ভাঙনের মুখে দুই ঘাটের তিনটি পন্টুন ব্যবহার করা যাচ্ছে না। ফেরিতে যানবাহন পারাপার পরিস্থিতি নাজুক আকার ধারণ করেছে। ইতিমধ্যে বিআইডব্লিউটিসি কর্তৃপক্ষ যানবাহন মালিকদের বিকল্প সড়ক ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছে। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি) আরিচা ফেরি সেক্টরের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার শেখ মোহাম্মদ নাসিম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। একদিকে যানবাহনের ভিড়, অন্যদিকে ফেরির অচলাবস্থায় যে কোনো মুহূর্তে ২১ জেলার যানবাহন চলাচলে চরম বিঘ্ন ঘটার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ৭৩ সড়ক-মহাসড়ক : দেশব্যাপী দুই দফা বন্যায় ৯৭টি সড়ক-মহাসড়কে মারাত্মক ক্ষতিসাধন হয়েছে। বানের পানির স্রোতে সড়কের দুই পাশ ধসে গেছে, অতিবৃষ্টিতে রাস্তার মাঝখানেই সৃষ্টি হয়েছে ছোট-বড় অসংখ্য গর্ত। বন্যাকবলিত জেলাগুলোর সড়ক-সেতুগুলোও নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের হিসাবে, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম ও নীলফামারী জেলার সড়ক-মহাসড়ক। জেলাগুলোর সঙ্গে অন্য জেলার আন্তসংযোগ স্থাপনকারী সড়কগুলো প্রায় বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছে। নেত্রকোনা জেলার পাঁচটি সড়কের বিভিন্ন জায়গায় পানি থাকায় যানবাহন চলাচল প্রায় বন্ধ। জামালপুর, ফরিদপুর ও শরীয়তপুরের তিনটি সড়কের কিছু অংশ পানিতে নিমজ্জিত। সুনামগঞ্জে চরম ক্ষতিগ্রস্ত কয়েকটি সড়কে সীমাহীন ঝুঁকি নিয়ে যানবাহন চলছে। সওজ সূত্রে জানা যায়, বন্যাপ্লাবিত ১৪ জেলার ৯৭টি জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক-মহাসড়কের পরিমাণ প্রায় ৬০০ কিলোমিটার। এ ছাড়া ২০০ কিলোমিটার সড়ক-মহাসড়ক এখনো পানিতে তলিয়ে আছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অর্ধশতাধিক সেতু-কালভার্ট। রেললাইন ও রেলসেতুর ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের কাজ এখনো চলছে বলে রেল ভবন সূত্রে জানা গেছে।