বুয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো কোনো শিক্ষার্থী অর্থের বিনিময়ে সেই প্রশ্নের সমাধান করে দেন বলে অভিযোগ আছে। পরীক্ষার্থীদের এই কাজে সহযোগিতা করছেন অভিভাবকেরা।
গতকাল শনিবার এইচএসসির উচ্চতর গণিত দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষা শুরুর আগ মুহূর্তে বুয়েটের কয়েকটি স্থানে এমন দৃশ্য দেখা গেছে। পরীক্ষা শুরু হয় সকাল ১০টায়। কয়েকটি ‘উপদলে’ ভাগ হয়ে অন্তত ৫০ জন পরীক্ষার্থী প্রশ্নের সমাধান করে বিভিন্ন পরীক্ষার কেন্দ্রে যায়। সকাল সাড়ে ৮টা থেকে পৌনে ১০টা পর্যন্ত ক্যাম্পাসের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এই চিত্র পাওয়া গেছে।
সকাল সাড়ে আটটার দিকে বুয়েটের শহীদ মিনারে ছয়-সাতজন পরীক্ষার্থীর জটলা ছিল। বিভিন্ন কলেজের পোশাক পরা এসব পরীক্ষার্থীর হাতে ছিল বইখাতা। প্রথম দেখায় মনে হতে পারে, পরীক্ষার আগে আগে এসব পরীক্ষার্থী শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু খটকা লাগে তাদের একজনের বইয়ের ভাঁজে থাকা স্মার্টফোনটি দেখে। তারা ফোনটি দেখে বইয়ের সঙ্গে কিছু একটা মেলাচ্ছে। এ সময় ছবি তুলতে চাইলে ওই পরীক্ষার্থীরা দ্রুত চলে যায়।
বুয়েটের কয়েকটি স্থানে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র সমাধানের ঘটনা সরেজমিনে দেখার সময় বুয়েটের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীও স্বপ্রণোদিত হয়ে এগিয়ে আসেন। তাঁরাও বিভিন্ন পরীক্ষার্থী ও অভিভাবককে বোঝান, এভাবে প্রশ্নপত্র সমাধান করে পরীক্ষা দেওয়া ঠিক হচ্ছে না।
বুয়েটের কাজী নজরুল ইসলাম হলের ক্যাফেটেরিয়ায় গিয়ে দেখা যায়, একটি টেবিলে বসে এক পরীক্ষার্থীকে প্রশ্নের সমাধান করে দিচ্ছেন একজন ছাত্র। ওই ছাত্রের হাতে থাকা মুঠোফোনে দেখা যায়, এইচএসসির গণিতের দ্বিতীয় পত্রের ‘খ’ সেটের প্রশ্নপত্র। এটি হোয়াটসঅ্যাপে সুপ্রভা নামের একজনের কাছ থেকে ৫৬ মিনিট (তখন সময় সকাল ৯টা ২৯ মিনিট) আগে এসেছে।
.জানতে চাইলে ওই ছাত্র নিজেকে বুয়েটের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের ছাত্র হিসেবে পরিচয় দেন। প্রথমে বলেন, তিনি নজরুল হলে থাকেন। পরে বলেন, তিনি মিরপুর থেকে এসেছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘এমন তো না যে আমি একাই এর সমাধান করছি। প্রশ্ন তো সবাই পাচ্ছে। আর আমি তো প্রশ্ন ফাঁস করছি না। শুধু সমাধান করে দিচ্ছি।’
গতকাল ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের অধীন উচ্চতর গণিত দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষা হয় ‘খ’ প্রশ্নপত্র সেটে। আর ওই পরীক্ষার্থীরা যেসব প্রশ্নের সমাধান করতে এসেছিল, সেটিও ‘খ’ সেটের সঙ্গে মিলে যায়।
পাবলিক পরীক্ষার নিয়মানুযায়ী পরীক্ষা শুরুর আধা ঘণ্টা আগে পরীক্ষাকেন্দ্রে সিলগালা প্রশ্নপত্রের প্যাকেট খোলার নিয়ম। অভিযোগ রয়েছে, কিছু কিছু কেন্দ্রে নির্ধারিত সময়ের আগেই প্যাকেট খুলে ফেলা হয়। এরপর মুঠোফোনে প্রশ্নপত্রের ছবি তুলে ই-মেইল বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তা বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছেন একশ্রেণির শিক্ষক। এ জন্য সরকার পরীক্ষাকেন্দ্রে স্মার্টফোন নিষিদ্ধ করলেও তা থামছে না। দু-তিন বছর ধরেই এ ঘটনা ঘটছে।
চলতি এইচএসসি পরীক্ষা চলাকালে গত ১২ এপ্রিল পরীক্ষার আগ মুহূর্তে রাজধানীর লালমাটিয়া মহিলা কলেজ পরীক্ষাকেন্দ্র-সংলগ্ন একটি রেস্তোরাঁয় বসে মুঠোফোন দেখে প্রশ্নের সমাধান করার দায়ে একজন শিক্ষক ও এক ছাত্রকে ভ্রাম্যমাণ আদালত কারাদণ্ড দেন।
গতকাল বুয়েটের এ ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তপন কুমার সরকার বলেন, এ ধরনের কোনো অভিযোগ তাঁরা পাননি।
গতকাল সকাল পৌনে নয়টার দিকে বুয়েটের তিতুমীর হলের অতিথিকক্ষে গিয়ে এই প্রতিবেদক দেখেন, কক্ষের বাইরে দুজন অভিভাবক বসা। ভেতরে একটি কলেজের পোশাক পরা পাঁচজন পরীক্ষার্থী বসে আছে। সামনে বইখাতা। হলে কেন এসেছ জানতে চাইলে তারা কেউ কোনো উত্তর দেয়নি। ক্যামেরা তাক করতেই তারা বইখাতা রেখে দ্রুত চলে যায়।
বুয়েটের কাজী নজরুল ইসলাম হলের ক্যাফেটেরিয়ায় যাওয়ার পথে রাস্তার দুই পাশে সারি সারি প্রাইভেট কার চোখে পড়ে। প্রতিটি গাড়িতে বিভিন্ন কলেজের পোশাক পরা কেউ না কেউ ছিল। শিক্ষকদের আবাসিক এলাকার মসজিদের সামনে একটি গাড়িতে গিয়ে এই প্রতিবেদক জানতে চান, সেখানে তারা কী করছে। তখন গাড়ি থেকে নেমে দুজন পরীক্ষার্থী চলে যায়। গাড়ির ভেতর প্রশ্নপত্র সমাধানকারীদের একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী বলে পরিচয় দেন। তিনি বলেন, তিনি যাদের প্রশ্ন সমাধান করে দিচ্ছিলেন, তাদের তিনি (সমাধানকারী) বাসায় গিয়ে পড়ান। সকালে তাঁকে ছাত্রের মা ফোন করে এখানে আসতে বলেছেন। তাঁর কাছেও ‘খ’ সেটের প্রশ্নপত্র পাওয়া যায়।
এ সময় একজন নারী অভিভাবক এই প্রতিবেদকের দিকে তেড়ে আসেন। তিনি বলেন, ‘তুমি এটা করতে পারো না। এভাবে জানতে চাইতে পারো না।’ পরে মুঠোফোনে কথা বলতে বলতে তিনি চলে যান।
পরে এই প্রতিবেদক বুয়েটের এম এ রশিদ হলের অতিথিকক্ষে যান। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, এক ছাত্রীর সঙ্গে থাকা ট্যাব থেকে প্রশ্নপত্র দেখে খাতায় সমাধান করে দিচ্ছিলেন বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের এক ছাত্র। সেখানে ওই ছাত্রীর সঙ্গে দুজন নারী ও একজন পুরুষ অভিভাবক ছিলেন। তাঁরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। পুরুষ লোকটি বলেন, ‘তোমাকে এই দায়িত্ব কে দিয়েছে?’ ছাত্রীর মা বলতে থাকেন, ‘তোমরা মন্ত্রীকে গিয়ে বলো। তোমরা এভাবে কথা বলতে পারো না।’
ঘড়িতে তখন সকাল পৌনে ১০টা। পরীক্ষার্থীরা বুয়েট এলাকা ত্যাগ করছে।
বুয়েটের কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেন, ‘প্রশ্ন যে পরীক্ষার আগে ফাঁস হয়, এ ঘটনার চেয়ে বড় প্রমাণ আর হতে পারে না।’ কেন প্রশাসন বা পুলিশকে জানাননি? তাঁরা বলেন, ‘এর আগের বছর প্রশ্ন পেয়ে আমরা দুবার বোর্ডে মেইল করেছিলাম। প্রত্যুত্তরে একবার আমাদের জানানো হয়, এটা সঠিক প্রশ্ন নয়। অন্যবার উত্তর এসেছে, গুজব ছড়াবেন না। গুজব ছড়ালে আপনাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে সোপর্দ করা হবে।’
রাতে যোগাযোগ করা হলে বুয়েটের ছাত্রকল্যাণ পরিদপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক সত্য প্রসাদ মজুমদার মুঠোফোনে বলেন, ‘বুয়েটে বাইরের যেকোনো লোকের প্রবেশ নিষেধ। আর তারা প্রবেশ করে যদি কোনো অনৈতিক কাজ করে তবে আমরা তাদের পুলিশে দিই। এ ধরনের কোনো ঘটনা কেউ জানালে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেব। বুয়েটের কোনো শিক্ষার্থী এতে জড়িত থাকলে ডিসিপ্লিনারি শাস্তি রয়েছে। বহিরাগত কেউ কোনো অপরাধ করলে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নেব।’