রক্ষণশীল সৌদি আরবে ইউটিউবে ভিডিও দেখা ও পোস্ট করা নারীর সংখ্যা ধাঁ ধাঁ করে বেড়ে চলেছে। অনেক নারীই এখন ইউটিউবে জীবনযাপন, মেকআপ ও রান্না-বিষয়ক নানান ভিডিও পোস্ট করছেন। আর এসব ভিডিও ধুমছে দেখছেন মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার কিছু অঞ্চলের মানুষ। এসব কর্মকাণ্ডের পেছনে উৎসাহ ও সহযোগিতা করে যাচ্ছেন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান।
২৫ বছর বয়সী আল-জহুরা সাজের ইউটিউবে জীবনধারা ও মেকআপ-বিষয়ক ভ্লগার। ইউটিউবে সাজের কিছু ভিডিও ক্লিপিং আছে। এসব ভিডিও দেখার জন্য প্রায় পাঁচ লাখ নিয়মিত গ্রাহক রয়েছেন। তাঁরা তেলসমৃদ্ধ দেশ সৌদি আরবেরই। ইউটিউবের তথ্য বিশ্লেষণ করা প্রতিষ্ঠান টিবিউলার ল্যাবসের তথ্যমতে, ইউটিউবে ভিডিও দেখার ক্ষেত্রে বিশ্বে এখন শীর্ষ কাতারে সৌদিরা।
সৌদি আরবে হলে সিনেমা ও মঞ্চে নাটক দেখা অবৈধ এবং বিভিন্ন কনসার্টের আয়োজন হয় সীমিত আকারে। বিনোদনের জন্য যুবক সম্প্রদায় ঢুঁ মারে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। বিশেষ করে নারীরা এ ক্ষেত্রে এগিয়ে। তাঁরা ইউটিউবে নিজেদের মতামত প্রকাশ করছেন। এসব ভিডিও দেশটিতে বেশ জনপ্রিয়তাও পাচ্ছে। গুগল বলছে, এসব ভিডিও দেখার হার গত বছরে বেড়েছে ৭৫ শতাংশ। আরবি ভাষার এসব ভিডিও কনটেন্ট সৌদি আরবের পাশাপাশি পুরো মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকা অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের থিংক ট্যাংক চ্যাথাম হাউসের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা-বিষয়ক সহযোগী পিটার সালিসবারি সিএনএনকে বলেন, সৌদি আরব এখন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। বিশেষ করে অভিজাত শ্রেণি, যারা সামাজিক বিভিন্ন বাধা অন্যদের জন্য দিয়ে রেখেছে। ইউটিউব তাদের জন্য যথোপযুক্ত জায়গা, নিজেদের প্রকাশের জন্য।
ইউটিউবে সৌদি নারীরা
বেশির ভাগ নারী ভ্লগার সিএনএনকে বলেন, ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে প্রথমের দিকে তাঁরা কিছুটা ইতস্তত বোধ করতেন। এ জন্য অনেকে ক্যামেরার সামনে নিজেদের মুখ ঢেকে রাখেন।
দেশটির অন্যতম প্রভাবশালী একজন ভ্লগার হেসা আল আওয়াদ। সিএনএনকে তিনি বলেন, ‘প্রথম দিকে আমি ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে ভয় পেতাম…সামাজিক যোগাযোগের মঞ্চে দাঁড়িয়ে কোনো সৌদি নারীর পক্ষে কিছু বলা ছিল বিরল ঘটনা। সময়ের আবর্তনে ভয়টা চলে গেছে। ধন্যবাদ, এ ব্যাপারে পরিবার আমাকে সাহায্য করায়।’
ইউটিউবে মেকআপ-বিষয়ক ভিডিওগুলোতে ২৪ বছর বয়সী হেসা আল আওয়াদের উপস্থিতি নেকাব পরেই। ভিডিওতে তিনি মুখ না দেখালেও কনটেন্টের কারণে বেড়েই চলেছে তাঁর গ্রাহকসংখ্যা।
রান্না-বিষয়ক ভ্লগার ২৪ বছর বয়সী আমাল এলমজিরিয়াহির জন্ম আফ্রিকার মরক্কোয়। এখন সৌদি আরবে থাকেন। তাঁর রান্নার ভিডিওগুলো ব্যাপক জনপ্রিয়। তিনিও ইউটিউবে মুখ না দেখিয়ে হেঁশেলে রান্নার যাবতীয় কলাকৌশল দেখান।
জাপানি পপ সংস্কৃতির ব্যাপক ভক্ত হেসা আল আওয়াদ দাম্মামভিত্তিক সৌন্দর্যচর্চার অন্যতম একজন জনপ্রিয় ব্যক্তি। তিনি সিএনএনকে বলেন, ‘আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে আমার ভয়েস রেকর্ডিংয়ের সময় শুধু আমি হাত দেখাব। আমি খোদার কাছে কৃতজ্ঞ যে আমার মুখ না দেখেও মানুষ আমার ভিডিও দেখছে।’
বাদশাহ সালমান…
অন্যদিকে, কৌতুক করা হাতুন খাদির ইউটিউবে গ্রাহক ৩ লাখ ১৩ হাজার। ব্যাপক জনপ্রিয় এই নারী সিএনএনকে বলেন, ‘আমি শুধু সুযোগটা গ্রহণ করেছি মাত্র, (কারণ) এখানে নারীদের উপস্থিতি কম।’ তাঁর কাছে এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ যে, তাঁর ভিডিওর বিষয়বস্তু কেউ কখনো ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখাননি। তিনি বলেন, ‘আমি এখানে কাউকে কখনো অপমান করে কিছু বলি না এবং আমি ধর্ম, রাজনীতির মতো সংবেদনশীল বিষয় সম্পর্কেও কিছু বলি না। আমরা শুধু সামাজিক বিষয়গুলো নিয়েই কথা বলি।’
জীবনযাপন ও কৌতুক-বিষয়ক ভ্লগার নওজুদ আল সামারি ইউটিউবে তাঁর সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে রেখেছেন। আর তা দেওয়ায় ২১ বছর বয়সী এই নারীকে ব্যাপক সমালোচনার মুখেও পড়তে হয়েছে। ‘আমি আমার চারপাশের অনেকের আক্রমণের শিকার হয়েছিলাম।’ বলছিলেন তিনি।
কিন্তু এটাও ঠিক যে তাঁর পোস্টের জন্য ব্যাপক সমর্থনও আছে। গত এক বছরে ৮ লাখ ৯০ হাজারের বেশি গ্রাহক ইউটিউবে নওজুদ আল সামারির ভিডিওগুলো দেখেছেন।
নওজুদ আল সামারি বলেন, ‘ইউটিউব আমাকে নিজেকে প্রকাশ করার শক্তি ও সুযোগ দিয়েছে। এটা শুধু আমার নিজেকে প্রকাশের জন্য নয়, সমাজের অন্য নারীদের জন্য প্রয়োজন এবং তাঁরা যা প্রয়োজন মনে করেন।’
টিবিউলার ল্যাবসের হিসাবে সবচেয়ে প্রভাবশালী সৌদি পাঁচজন নারীর মধ্য আছেন আল-জহুরা সাজের ও নওজুদ আল সামারি।
সৌদির সমাজ ‘গতিশীল’
তেলনির্ভর অর্থনীতির দেশটি ‘ভিশন ২০৩০’ নামের একটি রূপকল্প নিয়েছে। এর আওতায় বৈচিত্র্যপূর্ণ সাংস্কৃতিক সংস্কারের মধ্য দিয়ে সমানুপাতিক হারে ইউটিউবে সৌদি নারীদের এগিয়ে আসা শুরু হয়। সৌদির জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশির বয়স ২৫ বছরের নিচে। সৌদি আরবের প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান দেশটির আমূল এই পরিবর্তনের অন্যতম কারিগর এবং সামনের দিক থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সৌদির কাউন্সিল ফর ইকোনমিক অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যাফেয়ার্সের চেয়ারম্যান হিসেবে মোহাম্মদ বিন সালমান এসব কাজ করে যাচ্ছেন।
সালমান বলেন, তিনি স্বপ্ন দেখেন ‘সংবিধান ও ইসলামের সঙ্গে সহনশীল অবস্থান রেখে আধুনিক পদ্ধতির জীবন এগিয়ে চলবে সৌদি আরবে।’
‘ভিশন ২০৩০’-এর অধীনে ২০২০ সালের মধ্যে সৌদি আরবে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জন্য ৪৫০টির বেশি নিবন্ধিত অপেশাদার ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হবে। এরই মধ্য এ বছরের শুরুর দিকে দেশটিতে বড় ধরনের একটি কনসার্টের অনুমতি দেওয়া হয়, যা গত সাত বছরের মধ্যে প্রথম। এ ছাড়া কর্মক্ষেত্রে নারী কর্মীর সংখ্যা ২২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশে নিতে চায় দেশটি।
চ্যাথাম হাউসের পিটার সালিসবারি সিএনএনকে বলেন, ‘আমরা সৌদি আরবকে অবিশ্বাস্যরকম রক্ষণশীল এবং অবিশ্বাস্য রকম অনমনীয় একটি দেশ হিসেবে দেখে এসেছি। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে, সৌদি আরব গতিশীল সমাজের দিকে ধেয়ে যাচ্ছে।’ তিনি বলেন, যে সমাজ দীর্ঘদিন নিজেদের দরজা বন্ধ করে আটকে রেখেছিল, পরিশেষে তারা জনসমক্ষে আসছে। ধন্যবাদ ইউটিউব এবং টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমকে। দেশটিতে দীর্ঘ সময়ের জন্য পরিবর্তন আসা শুরু হয়েছে।
সূত্র : সিএনএন..