আমাদের দুঃসময়ের বন্ধু ভারত। আমরা ভারতের প্র্রতি কৃতজ্ঞ। তবে ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সঙ্গে করা চুক্তিগুলো আমাদের ভালবাসায় লাভ-লোকসানের খাতা খুলে দিল। এই সুদৃঢ় বন্ধন আমাদের কি দিচেছ বা আমরাই কি পাব তার হিসেব-নিকেশ নিয়ে দুই বঙ্গেই ব্যস্ত এখন মানুষ। তবে আর যাই হউক ভালবাসায় লাভ-লোকসানের খাতা খোলা হল এটাই সঠিক। আর এই খাতায় প্রথমেই লেখা হল, আমরা নায্য পানির হিস্যা পাচ্ছি না।
ভালবাসার নতুন বন্ধন যেমন–প্রতিরক্ষা বিষয়ক ৪ সমঝোতাসহ বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে মোট ২২ চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হয়েছে। রাষ্ট্রীয় সফরে ভারতে থাকা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক শেষে গতকাল দ্বিপক্ষীয় এসব চুক্তি ও সমঝোতা সই হয়।
নয়াদিল্লির হায়দরাবাদ হাউজে ওই বৈঠক এবং চুক্তি সইয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। চুক্তি সইয়ের আনুষ্ঠানিকতায় উপস্থিত প্রধানমন্ত্রীদ্বয় দু’দেশের মধ্যে বিরল-রাধিকাপুর রুটে মালামাল পরিবহনকারী রেল চলাচল, খুলনা-কলকাতা রুটে যাত্রীবাহী বাস ও রেল চলাচল এবং ত্রিপুরার পালাটানা বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে বাংলাদেশে অতিরিক্ত ৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রক্রিয়ার উদ্বোধন করেন। পরে তারা (যৌথভাবে) জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মজীবনীর হিন্দি সংস্করণের মোড়ক উন্মোচন করেন। এরপর দুই প্রধানমন্ত্রী যৌথ সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেন। এ সময় ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক ‘সোনালী অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে’ বলে মন্তব্য করেন নরেন্দ্র মোদি। জবাবে সার্বিক সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশ ও দেশের জনগণের পক্ষ থেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর প্রতি ধন্যবাদ জানান শেখ হাসিনা। ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য মতে, মোট ২২ চুক্তি-সমঝোতার মধ্যে ৬ চুক্তি আর বাকি ১৬টি এমওইউ সই হয়েছে। তবে দীর্ঘ সময় ধরে ঝুলে থাকা তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি হয়নি। অবশ্য এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ের একান্ত এবং আনুষ্ঠানিক শীর্ষ বৈঠকে (দ্বিপক্ষীয় আলোচনা) কথা হয়েছে জানিয়ে কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, বাংলাদেশের বহুল প্রতীক্ষিত তিস্তা চুক্তিটি কবে নাগাদ সই করতে পারবে ভারত? সেই ধারণা পাওয়ার চেষ্টা হয়েছে ঢাকার তরফে। বৈঠক শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দুই দেশের বিদ্যমান সরকারের আমলেই এই জট খোলার স্পষ্ট ইঙ্গিত দেন। মোদি বলেন, তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন তাঁর এবং শেখ হাসিনার সরকার তিস্তা চুক্তির বিষয়টি দ্রুত সমাধান করতে পারবে। সেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তিস্তা চুক্তির বিষয়টি ভারত দ্রুত সমাধান করবে বলে দৃঢ় আশা প্রকাশ করেন। এদিকে রাতে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক দিল্লিতে এক সংবাদ সম্মেলনে চুক্তি, সমঝোতাসহ মোট ৩৬টি ডকুমেন্ট সই হয়েছে বলে জানান।
২২টি চুক্তি-সমঝোতার বিস্তারিত: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে শীর্ষ বৈঠকে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যে ২২ চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে তার বিস্তারিত প্রকাশ করেছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। প্রকাশিত সেই তথ্য মতে, ১. ‘বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা রূপরেখা’ সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক। ২. ‘কৌশলগত ও ব্যবহারিক শিক্ষাক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়াতে’ ঢাকার মিরপুরের ডিফেন্স সার্ভিস কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজ ও ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের ওয়েলিংটনে (নিলগিরি) ডিফেন্স সার্ভিস স্টাফ কলেজের মধ্যে সমঝোতা স্মারক। ৩. ‘জাতীয় নিরাপত্তা, উন্নয়ন ও কৌশলগত শিক্ষার ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়াতে’ ঢাকার ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ ও নয়া দিল্লির ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজের মধ্যে সমঝোতা স্মারক। ৪. ‘মহাকাশের শান্তিপূর্ণ ব্যবহারে সহযোগিতার বিষয়ে’ বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সমঝোতা স্মারক ৫. ‘আনবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারে সহযোগিতার’ বিষয়ে দুই দেশের সরকারের মধ্যে চুক্তি। ৬. পরমাণু নিরাপত্তা ও বিকিরণ নিয়ন্ত্রণে কারিগরি তথ্যবিনিময় ও সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশ অ্যাটমিক এনার্জি রেগুলেটরি অথরিটি (বিএইআরএ) ও ভারতের অ্যাটমিক এনার্জি রেগুলেটরি বোর্ডের (এইআরবি) মধ্যে বন্দোবস্তনামা। ৭. বাংলাদেশে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পে সহযোগিতার বিষয়ে বাংলাদেশ অ্যাটমিক এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিএইআরসি) ও ভারতের গ্লোবাল সেন্টার ফর নিউক্লিয়ার এনার্জি পার্টনারশিপের (জিসিএনইপি) মধ্যে চুক্তি। ৮. তথ্যপ্রযুক্তি ও ইলেকট্রনিকসের ক্ষেত্রে সহযোগিতার বিষয়ে বাংলাদেশের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ এবং ভারতের ইলেক্ট্রনিকস ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমঝোতা স্মারক। ৯. সাইবার নিরাপত্তা ক্ষেত্রে বাংলাদেশ গভর্নমেন্ট কম্পিউটার ইনসিডেন্ট রেসপন্স টিম (বিজিডি ই-জিওভি সিআইআরটি) ও ইন্ডিয়ান কম্পিউটার ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিমের (সিইআরটি-ইন) মধ্যে চুক্তি। ১০. বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তজুড়ে বর্ডার হাট স্থাপনের বিষয়ে সমঝোতা স্মারক। ১১. বিচারিক ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতায় দুই দেশের সরকারের মধ্যে সমঝোতা স্মারক। ১২. ভারতে বাংলাদেশের বিচার বিভাগের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ ও সক্ষমতা তৈরির কর্মসূচির বিষয়ে সমঝোতা স্মারক। ১৩. নৌবিদ্যায় সহায়তার বিষয়ে সহযোগিতা সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক। ১৪. ভূবিদ্যা নিয়ে গবেষণা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে পারস্পরিক বৈজ্ঞানিক সহযোগিতার বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে সমঝোতা স্মারক। ১৫. কোস্টাল ও প্রটোকল রুটে যাত্রী ও পর্যটন সেবায় দুই দেশের সরকারের মধ্যে সমঝোতা স্মারক ও স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউরস (এসওপি) বিনিময়। ১৬. ভারত-বাংলাদেশ প্রটোকল রুটে সিরাজগঞ্জ থেকে লালমনিরহাটের দইখাওয়া এবং আশুগঞ্জ থেকে জকিগঞ্জ পর্যন্ত নাব্য চ্যানেলের উন্নয়নে সমঝোতা স্মারক। ১৭. গণমাধ্যমের ক্ষেত্রে সহযোগিতার বিষয়ে সমঝোতা স্মারক। ১৮. অডিও-ভিজ্যুয়াল সহ-প্রযোজনা চুক্তি। ১৯. বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ৫০ কোটি ডলারের প্রতিরক্ষা ঋণ সহায়তা সমঝোতা স্মারক। ২০. মোটরযান যাত্রী চলাচল (খুলনা-কলকাতা রুট) নিয়ন্ত্রণের জন্য বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চুক্তি। ২১. তৃতীয় ঋণ সহায়তার আওতায় বাংলাদেশকে সাড়ে ৪০০ কোটি ডলার ঋণ দেয়ার বিষয়ে সমঝোতা স্মারক। এবং সর্বশেষ (২২) বাংলাদেশে ৩৬টি কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণে অর্থায়নের চুক্তি। ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র গোপাল বাগলের টুইট বার্তা মতে, উল্লিখিত ২২ চুক্তি ও সমঝোতার মধ্যে বিচার বিভাগের সহযোগিতা, সাড়ে চারশ’ কোটি ডলার ঋণ সহায়তা, মহাকাশ গবেষণা এবং যাত্রীবাহী নৌ চলাচলে স্বাক্ষরিত সমঝোতাপত্রগুলো হাসিনা-মোদির অনুষ্ঠানে বিনিময় হয়।
উন্নয়ন প্রকল্পে ৪৫০ কোটি, প্রতিরক্ষা ঋণ ৫০ কোটি ডলার: প্রধানমন্ত্রীর এবারের সফরে মোট ৫০০ কোটি ডলারের ঋণ দেয়ার ঘোষণা করেছে ভারত। এ নিয়ে পৃথক দু’টি সমঝোতাও সই হয়েছে। প্রথমটি হয়েছে ভারতের তৃতীয় ঋণ সহায়তার আওতায় আরও সাড়ে চারশ’ কোটি ডলার ঋণ দেয়া সংক্রান্ত। যা উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় করা হবে। দ্বিতীয়টি সামরিক কেনাকাটা সংক্রান্ত ৫০ কোটি ডলারের ঋণ সহায়তা। শনিবার নয়াদিল্লিতে দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে এই সমঝোতাদ্বয়সহ মোট চারটি চুক্তিপত্র বিনিময় হয়। অনুষ্ঠানে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশকে তৃতীয় ঋণ সহায়তার আওতায় আরও সাড়ে চারশ’ কোটি ডলার ঋণ দেয়ার বিষয়াটি উল্লেখ করেন। সেই সঙ্গে সামরিক কেনাকাটায় ৫০ কোটি ডলার ঋণ দেয়ার ঘোষণাও দেন। এনিয়ে গত ছয় বছরে বাংলাদেশকে দেয়া ভারতের সহজ শর্তে ঋণ সহায়তা ৮০০ কোটি ডলারে উন্নীত হল বলে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে যে ৪৫০ কোটি ডলারের চুক্তি হয়েছে, তা বাংলাদেশের অগ্রাধিকার প্রকল্প গ্রহণ করে তাতে অর্থায়ন করা হবে। এর আগে ২০১৫ সালে নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরে ১৪ প্রকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশের সঙ্গে ২০০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি সই হয়েছিল। ওই প্রকল্পগুলো এখনও বাস্তবায়নাধীন। তারও আগে ২০১০ সালে ১০০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি হয়েছিল। ওই ঋণে ১৫টি উন্নয়ন প্রকল্প প্রহণ করা হয়; যার আটটি প্রকল্প এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। বাকিগুলো চলমান।