যদি কোনো ৮০ বছরের বৃদ্ধও আমাকে বিয়ে করে, করবো।

Slider নারী ও শিশু

56266_f7

 

ঢাকা; আলাদা জগৎ। অন্য দুনিয়া। যে দুনিয়ায় কিশোরী আর কুমারীর মর্যাদা বেশি। আছে বয়স্করাও। সেই দুনিয়ায় রাজাবিহীন রাণীর দাপট। তবে ওই দুনিয়ার স্বাদ নিতে আসে পুরুষ। কিশোর, যুবক থেকে শুরু করে বয়স্করাও। নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বাসিন্দা হন ওই দুনিয়ার। সেই দুনিয়ার দাপুটে রাণী এখন ক্লান্ত। অবসান চান সবকিছু থেকে। রাজ্য ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চান খোলা ময়দানে। মিশে যেতে চান সমাজে। দীর্ঘ ১০ বছর শাসন করেছেন, শোষণ করেছেন যে রাজ্য, সে রাজ্য এখন কেন ত্যাগ করতে চাইছেন তিনি? সে অনেক কথা। এর আগে তার মুখে শোনা যাক রাজ্য শাসনের কথা-    বলেন, ঢাকা ও ঢাকার আশেপাশে বড় ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকছি। উঠাবসাও সমাজের বিত্তবান ও উচ্চ পেশার লোকজনদের সঙ্গে। নেটওয়ার্ক দেশের নানা প্রান্তে। কখনো কখনো দেশের সীমানাও পেরিয়ে গেছে সেই নেটওয়ার্ক। কেউ অর্থের প্রয়োজনে, কেউ শরীরের চাহিদা মেটাতে আবার কেউ প্রতারণার শিকার হয়ে পা রাখেন এই জগতে। আমি এই জগতেরই রাণী। আমাকে ঘিরেই যৌনকর্মীরা দেহব্যবসা করে যাচ্ছে নিরাপদে। আমার এ পরিচয় অজানা সমাজের চেনামুখ ও আত্মীয়-স্বজনের কাছে। তাদের কাছে এখনো আমি সাদাসিধে গৃহবধূই। তারা জানেন, চাকরি করছি কোন এক প্রতিষ্ঠানে। কেউ জানেন, বিদেশে লোক পাঠাই। এ পথে আসা জীবনের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে। সে কাহিনীও শোনাবো আপনাদের। তবে এ রাজ্য ঘৃণার রাজ্য। কলঙ্কিত এক রাজ্য। বলেন, অপরাধ আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। একাধিকবার অন্ধকারের এই গলি থেকে বেরও হতে চেয়েছি। কিন্তু বাস্তবতা সে সুযোগ দেয়নি। এখন হাঁপিয়ে উঠেছি। চিরদিনের জন্য ছেড়ে দিতে চাই এ রাজ্য। বলেন, আমার দুই মেয়ে বড় হয়েছে। একজন ইতিমধ্যে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা শেষ করেছে। আরেক মেয়ে পড়ছে ৮ম শ্রেণিতে। তাদের সমাজে সম্মানের সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। অথচ একদিন তাদের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়েই ঘৃণিত এই জগতের মহারাণী হয়ে উঠেছিলাম। মাত্র ৩৬ বছর বয়সী সুন্দরী এই নারী। বলেন, অন্ধকার এ জগতের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকলেও নিজের সম্ভ্রম কখনো হারাননি। এ জন্য তাকে নানা কৌশল অবলম্বন করতে হয়েছে।  বলেন, স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর অনেকেই আমাকে পেতে চেয়েছে। যখনই তাদের বিয়ের কথা বলেছি, স্থায়ীভাবে অর্থনৈতিক সাপোর্ট দিতে বলেছি, তখনই তারা পিছিয়ে গেছে।
রাজধানীর অদূরে একটি শহরের বিলাসবহুল বাড়িতে কথা হয় বেবীর সঙ্গে। তিনি তুলে ধরেন তার জীবনের ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা। অপরিণত বয়সে বিয়ে, প্রতারিত হওয়া, নির্যাতনের কাহিনী, অন্ধকার জগতে পা বাড়ানো অতপর বিলাসী জীবন, পরিশেষে সেই পথ থেকে বের হওয়ার আকুতি।
অন্ধকার জগতের সেই রাণী বলেন, ৫ বছর বয়সে পোলিওতে আক্রান্ত হয়ে তার একটি পা অকেজো হয়ে যায়। কোনোমতে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলেন। এরমধ্যেও সংসারের সব কাজই করতে পারেন। ওই সময় তার পিতার সঙ্গে পরিচয় হয় এক সরকারি চাকরিজীবীর। মেয়ের একটি পা ত্রুটিপূর্ণ হলেও দেখতে সুন্দরী হওয়ায় তিনি বিয়ের প্রস্তাব দেন। তখন তার বয়স ১৬। আর ওই চাকরিজীবীর বয়স ৩৬। কিন্তু ছেলে চাকরিজীবী হওয়ায় এই বিয়েতে মত দেন তার দরিদ্র পিতা। ১৯৯০ সালের ৭ই এপ্রিল তাদের বিয়ে হয়। কিন্তু মাসের পর মাস কেটে গেলেও তিনি স্বামীর ঘরে যেতে পারেননি। স্বামীই সপ্তাহে ২-৩ দিন তার কাছে আসতো। স্বামীকে চাপ দিতে থাকেন তুলে নেয়ার জন্য। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে যায় স্বামী। কয়েক মাস যেতে না যেতেই মারধর শুরু হয়। লাথি, কিল, ঘুষি, লাঠিপেটা এসব এক সময় নিত্য ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। এক সময় জানতে পারেন তার আরো একটি সংসার রয়েছে। একদিন ঠিকানা সংগ্রহ করে নিজের পরিচয় গোপন রেখে সেই বাড়িতে গিয়ে ওঠেন। দেখেন সেখানে তার আরো এক স্ত্রী, তাদের এক মেয়ে ও এক ছেলে রয়েছে। আগের স্ত্রীর মেয়ে তার থেকে ৪ বছরের ছোট। এরপর থেকে তার ওপর নির্যাতনের মাত্রা বাড়তে থাকে। বিয়ের ৯ মাস পর স্বামী তার প্রতিষ্ঠান থেকে দেশের বাইরে চলে যায়। তিনি তখন গর্ভবতী। এরপর তার প্রথম সন্তান জন্ম নেয়ার ২১ দিন পর বিদেশ থেকে তার নামে ৪ হাজার টাকা পাঠায় তার স্বামী। এরপর থেকে দীর্ঘদিন কোনো যোগাযোগ ছিল না। এরইমধ্যে একদিন জানতে পারেন তার স্বামী দেশে ফিরেছে। যোগাযোগ করার পর সে আবারো আসা-যাওয়া শুরু করে। নিয়মিত থাকতো না। মাঝে মাঝে রাতে আসতো, সকালে চলে যেতো। ২০০২ সালে ছোট মেয়ের জন্ম হয়। তারপর ২০০৪ সালে হঠাৎ করে একদিন এসে তাকে আগের স্ত্রীর বাড়িতে নিয়ে যায়। সেখানে তার স্ত্রী ও সন্তানরা মারধর করতো। তিনি সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করছিলেন। একদিন সুজির সঙ্গে তার সতীন কি যেনো মিশিয়ে খাইয়ে ছিল তাতে মা-মেয়ে ৩২ দিন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ছিলেন। এরপর স্বামী কোনো দায়-দায়িত্ব পালন না করায় একাধিকবার ছাড়াছাড়ির জন্য সালিশও হয়েছে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। তিনি তখন কাগজ কুড়িয়ে ঠোঙা বানিয়ে তা বিক্রি করতেন। এক সময় সেই টাকা জমিয়ে এবং বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে একখণ্ড জমি কিনে তাতে টিনশেড বাড়ি করেন। পরে তার স্বামী জমিসহ ওই বাড়িটিও বিক্রি করে দেয়। তাদের কোয়ার্টারে তোলে। কিন্তু কোনো খরচ দিতো না। এরপর অফিসে সালিশ বসে। তাতে মাসের খরচের জন্য ১৩ শ’ টাকা করে দেয়ার নির্দেশ দেয়। ওই সময় থেকে তার স্বামী আবারো তাদের সঙ্গে থাকা শুরু করে। এদিকে এনজিও থেকে নেয়া ঋণের কিস্তি শোধ করার জন্য চাপ বাড়তে থাকে। ওই সময় পরিচয় হয় রেহানা নামে পরিবার পরিকল্পনায় চাকরি করা এক নারীর সঙ্গে। তিনি তাকে পরামর্শ দেন স্থায়ী জন্মনিয়ন্ত্রণ করার। বলেন, তাতে সে মাসে মাসে কিছু টাকাও পাবে। তার কথামতো এই পদ্ধতি গ্রহণ করতে চান। কিন্তু প্রেসার বেশি হওয়ায় তা নেয়া হয় না। তখন রেহানা তাকে সুযোগ বুঝে বলেন, তার বাসায় একজন মেয়ে এবং ছেলেকে কিছুক্ষণ সময় কাটাতে দিলে কিছু টাকা পাবে। এই কথা শোনার পর তিনি প্রথমদিকে রাজি হননি। কিন্তু যখন কিস্তিওয়ালা এসে তার ঘরের জিনিসপত্র নিয়ে গেছে তখন তিনি তাকে ফোন করে রাজি হওয়ার কথা জানান। তখন ২০০৭ সাল। সেই শুরু। স্বামী বাসায় না থাকলে বাইরে থেকে আসা নারী-পুরুষকে তিনি বাসা ব্যবহার করতে দিতেন। এক সময় স্বামীও জেনে যায়। প্রথমদিকে সেও ক্ষুব্ধ হয়। কিন্তু যখন বলে, কিস্তি শোধ হয়ে গেলে আর ওই কাজ করবেন না, তখন সেও রাজি হয়। ততদিনে এ লাইনটি কিছুটা আয়ত্তে তার। এরইমধ্যে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান জেনে যায়। তখন তার স্বামীকে চাকরিচ্যুত করে কোয়ার্টার থেকে বের করে দেয়। এরপর বাসা নেন সাভার। সেখানে পুরোদমে কাজ শুরু হয়। যৌনকর্মীদের নিরাপদ আশ্রয়ে পরিণত হয় তার বাসা। তার বাসায় আসে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলেমেয়েরা। আসে সরকারি কর্মকর্তারা। আসে বড় বড় ব্যবসায়ী। অনেক সময় জোড়ায় জোড়ায় আসে। কাজ সেরে চলে যায়। অনেক সময় তিনি নিজেও যৌনকর্মী যোগাড় করে দেন। এরপর কিছু টাকা জমানোর পর বাসা পাল্টিয়ে নতুন বাসা নেন। স্বামীকে ব্যবসা করতে দেন। কিন্তু স্বামী সেইসব টাকা পয়সা নিয়ে উধাও হয়ে যায়। নিয়ে যায় জমানো স্বর্ণালঙ্কার। একেবারে নিঃস্ব করে দিয়ে যায়। এরপর আবারো নতুন বাসা নিয়ে কাজ শুরু করেন। কিছুদিন পর আবারো স্বামী ফিরে আসে। তখন তিনি তাকে ডিভোর্স দেন। এরপর বাসা নেন ঢাকার দারুস সালামে। মেয়েরা আসে। খরিদ্দার আসে। ওই রাজ্যে তার বিশাল নেটওয়ার্ক। তার এখানে আসে সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী।  ম্যানেজ করতে হয় এলাকার ছেলে ছোকরাদেরও। তবে এক জায়গায় বেশিদিন বাসা নিয়ে থাকা যায় না। সর্বোচ্চ ৩-৪ মাস। বাসার মালিক জানার আগেই ছেড়ে দিতে হয়। তিনি বলেন, প্রেমিক-প্রেমিকারা তার রুম ভাড়া নেয় এক ঘণ্টা, দুই ঘণ্টা, তিন ঘণ্টা কখনো সারাদিন বা রাতের জন্য। সময় হিসেবে রেট আলাদা। তিনি ভদ্রতার খাতিরে তাদের খেতেও দেন। তবে ঢাকার বাইরে থেকে যারা আসে তাদের বেশির ভাগই সারারাতেই জন্য নেয়। তাতে তাদের হোটেল ভাড়াও বেঁচে যায়। তিনি জানান, এই জগতে তার এক শক্তিশালী নেটওয়ার্ক রয়েছে। অনেকেই তাকে চেনে। দেশের বিভিন্ন শহরের হোটেলেও যৌনকর্মী সরবরাহ করেন। সব মিলে বিলাসী জীবন তার। অনেকে চাকরি দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে মেয়েকে এইখানে নিয়ে আসে। আমি বুঝতে পারলে তাকে কাজে লাগায় না। বরং নিজ খরচে তাকে বাড়ি যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিই। তিনি বলেন, এই পথ থেকে মুক্তি পেতে চাই। যদি কোনো ৮০ বছরের বৃদ্ধও আমাকে বিয়ে করে, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দিতে পারে তাহলে তাকে বিয়ে করবো। মেয়েরা বড় হয়েছে। তাদের বিয়ে দিতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তাদেরকে কখনোই এই জগতের সঙ্গে পরিচিত করিনি। আলাদা বাসা ভাড়া করে সেখানে রেখেছি। বলেন, এর আগে পার্লারের প্রশিক্ষণ নিয়েছি। কিন্তু ওই পর্যন্তই। একটা পার্লার করতে গেলে প্রায় ১০ লাখ টাকা লাগে। কোথায় পাবো এতো টাকা? তার ওপর মেয়েদের লেখাপড়া, আলাদা বাসা ভাড়া। যেসব ধনীরা এখানে আসে তাদেরও বলেছি তারা যদি সাহায্য করে তো এই পথ ছেড়ে দিতে চাই। কিন্তু কেউ-ই রাজি হয়নি। তিনি বলেন, গত ১০ বছর ধরে এই পেশার সঙ্গে জড়িত থাকলেও স্বস্তি পাইনি। সব সময়ই অপরাধবোধ কাজ করে। না আমি আর এ জগতের রাণী হতে চাই না। রাজাবিহীন রাণীর কোনো দাম নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *