বিংশ শতাব্দীর গোড়ার কথা। তখন ছিলনা একাডেমিক শিক্ষার সুব্যবস্থা কিন্তু মানুষের মধ্যে ছিল সততা, ন্যায়বোধ ও মূল্যবোধ। একাডেমিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গি অর্জনের লক্ষ্যে তৎকালীন সুশীল সমাজের গুণী ব্যক্তিদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফসল মালিখালী মাধ্যমিক বিদ্যালয় ।
১৯০৭ সালে এ প্রতিষ্ঠানটির জন্ম। পিরোজপুর জেলার সর্ব উত্তরের জনপদ নাজিরপুর উপজেলার ২নং মালিখালী ইউনিয়ন পরিষদের ২নং ওয়ার্ডের অন্তর্গত মালিখালী গ্রামে মধুমতি, বলেশ্বর ও তালতলা নদীর ত্রিমোহনায় চির সবুজ ছায়াঘন নিবিড় প্রাকৃতিক পরিবেশে মালিখালী মাধ্যমিক বিদ্যালয় অবস্থিত। বহু পূর্ব থেকেই এই অঞ্চল ছিল অর্থনীতি ও শিক্ষায় অনগ্রসর । এ অঞ্চলে বসবাস ছিল হত দরিদ্র কৃষিজীবী, তথসিলী হিন্দু ও মুসলমানদের, চাষাবাদ ও মাছ ধরা ছিল তাদের জীবিকা অর্জনের প্রধান অবলম্বন। যোগাযোগের অবস্থা ছিল অনুন্নত। পায়ে হাঁটার রাস্তাও ছিল না। নৌকা ও পায়ে হাঁটা মেঠো পথই ছিল যোগাযোগের মাধ্যম। বরিশাল থেকে খুলনাগামী স্টিমারের একটি স্টেশন ছিল তালতলা নদীর অপর পারে মাটিভাঙ্গাতে। এই স্টিমার পথেই চলত বাইরের সাথে যোগাযোগ। এই পিছিয়ে পড়া জনগণই এখন থেকে শতবর্ষ পূর্বে প্রতিষ্ঠিত করে ছিলেন মালিখালী মাধ্যমিক বিদ্যালয়। গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানী উপজেলাধীন ওড়াকান্দিধাম এ অঞ্চলের নমঃশূদ্র হিন্দুদের প্রানের ঠাকুর শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের লীলাভূমি।
হরিচাঁদ ঠাকুরের পুত্র শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুর তখন হরিচাঁদ ঠাকুরের প্রবর্তিত মতুয়া সম্প্রদায়ের আরাধ্য প্রাণ পুরুষ। মতুয়া অধ্যূষিত অঞ্চলে শিক্ষার আরো বিস্তারের জন্য গুরুচাঁদ ঠাকুেরর অবদান অবিস্মরণীয় । তিনি তাঁর উচ্চ শিক্ষিত অনুসারীদের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠিয়ে ছিলেন শিক্ষা বিস্তারের জন্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার নিমিত্ত। তারই ফলশ্রুতি আজকের স্বনামধন্য মালিখালী মাধ্যমিক বিদ্যালয়। ওড়াকান্দি পার্শ্ববর্তী গ্রাম সীতারামপুর নিবাসী প্রাতঃস্মরণীয় বাবু কেশবলাল সমাজপতি গুরু চাঁদ ঠাকুরের আদেশে এ অঞ্চলে আসেন এবং মালিখালী তিনি বিদ্যালয় স্থাপনের উপযুক্ত স্থান নির্বাচন করেন। তিনি এ অঞ্চলের বর্ধিষ্ণু ব্যক্তিদের সাথে আলাপ করে তাদের উৎসাহিত করেন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য। তখন মাটিভাঙ্গা পঞ্চায়েতের প্রধান ছিলেন বাবু উঁমাচরণ বিশ্বাস। তিনি তার পরিষদবর্গসহ এগিয়ে আসেন । তাঁদের মধ্যে উল্লেখ যোগ্য ছিলেন মালিখালী নিবাসী শ্রী বনমালী রায় ও হরিচরণ রায়। এছাড়া কলমা জমিদার কোম্পানীর মাটিভাঙ্গা কাচারির পরিচালক বাবু ভ’পতি রঞ্জন রায় চৌধুরী। তখন সকলে মিলে শুরু করেন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা।
১৯০৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জনসভা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ও স্থান নির্বাচন করা হয়। ১৯০৭ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ক্লাশ শুরু করার পদক্ষেপ নেয়া হয়। স্কুলের নামকরণ করা হয় মালিখালী মাইনর স্কুল। ইংরেজি (গ.ঊ) স্কুল। ডিসেম্বর মাসের মধ্যে একটি টিনের চালাঘর তৈরী করা হয়। এ্কই ঘরে প্রধান শিক্ষকের অফিস কক্ষ ও শিক্ষকদের মিলনায়তনসহ পাঁচটি শ্রেণিকক্ষ তৈরী হয়। প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন কেশব লাল সমাজপতি এবং সেক্রেটারী বাবু উঁমাচরণ বিশ্বাস। বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বেশিরভাগ জমি ও অর্থ দান করেন ঁউমাচরণ বিশ্বাস। দানশীল ও শিক্ষানুরাগী বক্তিদের সহযোগিতায় বিদ্যালয়ের উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি ও ছাত্রসংখ্যা বাড়তে শুরু করল। ১৯২১ সালের জনুয়ারি মাস থেকে বিদ্যালয়টি মাইনর থেকে উচ্চ ইংরেজি স্কুলে উন্নীত হয়। প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন বাবু যতীন্দ্র নাথ বিশ্বাস। কলিকাতা কর্তৃক তপশিলী বিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। ১৯২৫ সালে সর্ব প্রথম কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৬ জন। সকলে উত্তীর্ণ হওয়ায় বিদ্যালয়ের গৌরব চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। সুদুর অঞ্চল থেকে ছাত্র আসতে থাকে এ বিদ্যালয়ে পড়াশুনার জন্য । বিত্তবান এলাবাসীর ঘরে ঘরে ছাত্রদের লজিং দেয়া হত। আবাসিক সুবিধার জন্যে বিদ্যালয়ে একটি ছাত্রাবাস তৈরীর পরিকল্পনা করা হয়। কলকাতা নিবাসী দানসিল ব্যক্তি ভ’পেন্দ্র নাথের আর্থিক সহযোগিতায় নির্মাণ করা হয় একটি ছাত্রাবাস। ভ’পেন্দ্রনাথের নামানুসারে ছাত্রাবাসের নামকরণ করা হয় ভ’পেন্দ্র নাথ ছাত্রাবাস।
গতানুগতিক ধারার পরিবর্তে সরকার ১৯৬১ সন থেকে বহুমুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু করেন। পরীক্ষার নাম মেট্রিকুলেশনের পরিবর্তে এসএসসি হয়। শুরু থেকে বিজ্ঞান শাখা খোলা হয় । ১৯৬৩ সনে নতুন ধারার পরীক্ষায় ৩৬ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ৩৪ জন পাস করে । বিজ্ঞান শাখায় ১৩ জন সকলই পাস করে। এ সময়ের দক্ষ প্রধান শিক্ষক শ্রী নীরোদ বিহারী নাগ যিনি ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৫ সন পর্যন্ত ২ বার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের ভিপি ছিলেন। এ বিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক শিক্ষকতার পাশাপাশি স্বাধীনতার পক্ষে বলি করেছেন।
১৯৬৫ সানে কৃতি ছাত্র ভীষ্মদেব বিশ্বাস বিজ্ঞান শাখায় যশোর বোর্ডে মেধা তালিকায় ৮ম স্থান অধিকার করে বিদ্যালয়কে শীর্ষ স্থানে পৌঁছে দেয়। ১৯৬৮ সনে জগদীশ চন্দ্র বিশ্বাস বিজ্ঞান শাখায় যশোর বোর্ডে মেধা তালিকায় ১০ম স্থান অধিকার করে এ গেীরবকে আরও সুসংহত করে। ১৯৭০ সনে বিদ্যালয়ে নতুন পাকা ভবনের কাজ শুরু হয় । ১৯৭১ সনের মুক্তি সংগ্রামের পূর্বে নির্মাণ কাজ আংশিক সম্পন্ন হয়।
মুক্তিসংগ্রামের শুরুতেই স্কুল বন্ধ হয়ে যায় । নির্মাণ কাজও বন্ধ হয়ে যায়। মুক্তি যুদ্ধের সময় বিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক অনেকেই অংশ গ্রহণ করে দেশ প্রেমের দৃষ্টান্ত রেখেছেন। এ বিদ্যালয়ের শিক্ষক সুচিত্র কুমার মন্ডল মুক্তি যুদ্ধে শহীদ হন।
এ বিবদ্যালয়ের কৃতি ছাত্রদের মধ্যে অনেকেই দেশের উচ্চ পদে থেকে দেশের সেবামূলক কাজে নিযুক্ত আছেন। যাদের নাম উল্লেখ করা কঠিন। দেশের বাইরেও অনেকে উচ্চ পদে আসীন থেকে সেবাকার্য চালিয়ে যাচ্ছেন। এর মধ্যে একজনের নাম উল্লেখ্য করা হলো -১৯৭৯ সালের এসএসসি পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ কৃতি ছাত্র ডাঃ দেবাশিস মৃধা ,গ্রামঃ সেকমাটিয়া, নাজিরপুর, পিরোজপুর, বর্তমান আমেরিকার মিসিগানের প্রবাসী , নিউরোলজির অন্যতম ডাক্তার। এ বিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্র ১৯৯৩ সনে স্টার ও বৃত্তি প্রাপ্ত ছাত্র প্রাণ কৃষ্ণ বিশ্বাস এর অনুপ্রেরণায় আমার প্রধান শিক্ষক শ্রী গিরীশ চন্দ্র মন্ডল মহাশয়ের বিদ্যালয় পথ পরিক্রমা থেকে সংকলিত আমার এ লেখা।
২০০৭ সন থেকে এ বিদ্যালয়ের দায়িত্ব পালন করে আসছি। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে এ বিদ্যালয় ২০০০সন থেকে কম্পিউটার শিক্ষা চালু করা হয় । ২০০১ সনের ফলাফলের ভিত্তিতে সারা দেশে ১০০০টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এ বিদ্যালয়টি প্রধান মন্ত্রী কর্তৃক ২টি কম্পিউটার প্রাপ্ত হয় । ২০০৮ সালে বিদ্যালয়ের ভাল ফলাফলের ভিত্তিতে ২ টি ল্যাপটপ প্রাপ্ত হয়। ২০১০ সালে ৫টি কম্পিউটার ও প্রিন্টার সহ একটি সুসজ্জিত কম্পিউটার ল্যাব স্থাপিত হয়। বিদ্যালয়ে প্রজেক্টরের মাধ্যমে দক্ষ শিক্ষকের পরিচালনায় মাল্টিমিডিয়া ক্লাশ পরিচালিত হয়। বিদ্যালয়ে ৫০আসন বিশিষ্ট একটি ছাত্রাবাস আছে। আবাসিক শিক্ষক হিসাবে দুই শিক্ষক হোস্টেলের সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করছেন। সহশিক্ষা কার্যক্রমে এ বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রী অংশগ্রহণ খুবই সন্তোয়জনক। ২০১৩ সন থেকে সৃজনশীল মেধা অন্বেষণ প্রতিযোগিতায় এ বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীর অংশ গ্রহণ ও কৃতিত্ব অর্জন সন্তোষজনক। জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ ২০১৬ এ বিদ্যালয়টি উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্বাচিত হয়েছে। বিদ্যালয়ের পরিচালনা পরিষদের বর্তমান সভাপতি জনাব টিপু সুলতান তাঁর শিক্ষানুরাগী মনোভাব নিয়ে শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নের জন্য সর্বদা সচেষ্ট আছেন।
একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নির্ভর করে সে দেশের সুশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর উপর । রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূলে রয়েছে শিক্ষা । জাতি গঠনে ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে সবচেয়ে বড় ভ’মিকা রয়েছে শিক্ষকের। আর শিক্ষকের হতে হবে আদর্শ শিক্ষায় শিক্ষিত। শিক্ষকেরাই আদর্শ জাতি গঠন করতে পারে। জঙ্গী, সন্ত্রাসী, নির্মূলে শিক্ষকের ভ’মিকা প্রধান। একজন শিক্ষক যদি সৎ আদর্শ্যবান হন ও ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলেন তবে তিনি একটি আদর্শ জাতি গঠন করতে পারেন। শ্রীশ্রী ঠাকুর অনুক’ল চন্দ্রের সত্যানুসরণে বলেছেন যে, ‘‘তুমি যদি সৎ হও, তোমার দেখা দেখি হাজার হাজার লোক সৎ হ’য়ে প’ড়বে। আর যদি অসৎ হও, তোমার দূর্দ্দশার জন্য সমবেদনা প্রকাশের কেউই থাকবে না; কারণ তুমি অসৎ হ’য়ে তোমার চারিদিক অসৎ ক’রে ফেলেছ। তুমি ঠিক-ঠিক জেনো যে, তুমি তোমার , তোমার নিজ পরিবারের, দশের এবং দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য দায়ী”। একজন সৎ লোক সৎ চর্চা করেন সৎ লোককে অনুসরণ করেন অন্যদিকে অসৎ লোক অসৎ চিন্তা করেন অসৎ লোককে অনুসরণ করেন। কালক্রমে অসৎ চিন্তার মাধ্যমে সে ঋৎঁংঃৎধঃরড়হ- এ ভোগে এবং জীবনকে করে তোলে দুর্বিষহ। আসুন আমরা সৎ এ বিশ্বাসী হই এবং জাতি গঠনে ভুমিকা রাখি ।
অসতি কুমার মল্লকি
প্রধান শক্ষিক
মালিখালী মাধ্যমিক বিদ্যালয়