সাংসদের এভাবে হঠাৎ একা হয়ে যাওয়া, সব গৃহকর্মীর ব্যস্ত থাকা, ঘটনার বর্ণনায় গরমিল—এসব নানা প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ‘ঘরের কেউ’ জড়িত কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সাংসদের সম্বন্ধী বেদারুল আহসান বেতারের ভূমিকা খতিয়ে দেখার দাবি করেছেন মনজুরুলের বড় বোন আফরোজা বারী। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে শুরু করে স্থানীয় আওয়ামী লীগের লোকেরা যেভাবে জামায়াতকেই ঘটনার জন্য দায়ী করছেন, তাতে স্বাধীনভাবে তদন্তকাজ করা তাঁদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ছে।
সাংসদের বাসার গৃহকর্মী ও লোকজনেরা জানান, গত ১৪ ডিসেম্বর সাংসদ তাঁর স্ত্রী খুরশীদ জাহান স্মৃতিকে নিয়ে বামনডাঙ্গায় গ্রামের বাড়িতে আসেন। ১ জানুয়ারি ঢাকায় ফেরার কথা ছিল, ব্যাগও গোছানো হয়েছিল। কিন্তু আগের দিন ৩১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের বামনডাঙ্গায় নিজ বাড়িতে গুলি করে হত্যা করা হয় মনজুরুলকে।
বাসার সাতজন গৃহকর্মী সে সময় নানা কাজে ব্যস্ত ছিলেন। পুরোনো লোক সৌমেন্দ্রকে মুরগি কিনতে পাঠিয়েছিলেন সাংসদের স্ত্রী। আরেকজন সাজেদুল ভেতরে গিয়েছিলেন সাংসদের জন্য পান ধুতে। ইমাম হোসেন গরু গোয়ালে ঢোকাচ্ছিলেন। আর ইউসুফ আলী মুরগি ঘরে ঢোকাতে গিয়েছিলেন। তিন নারী গৃহকর্মী বিলকিস, রোকসানা ও জাবেদা রান্নাঘরে কাজ করছিলেন। সৌমেন্দ্র বলেন, ‘এমপি স্যার খাবেন, এ জন্য ম্যাডাম দেশি মুরগি আনতে বলছে রান্নার বেটিগুলাক। ওরা আমাক কইলে আমি গেলাম মুরগি খুঁজতে।’ আর গাড়িচালক ফোরকান আকনও দাঁড়িয়ে ছিলেন রান্নাঘরের পাশেই। তিনি বলেন, সন্ধ্যায় যখন তিনি গাড়ি মুছছিলেন তখন একটি মোটরসাইকেলে তিনজন লোক আসে। দুজন ড্রয়িংরুমে ঢুকে আর একজন দাঁড়িয়ে বারবারই গাড়িটি এবং তাঁর দিকে তাকাচ্ছিলেন। এরপর ফোরকান বাসার ভেতরে ঢোকার মিনিট খানেকের মধ্যেই গুলির শব্দ পান। তিনি গাড়ি নিয়ে ধাওয়া করারও চেষ্টা করেন। কিন্তু বাসা থেকে ফোন পেয়ে সাংসদকে হাসপাতালে নিতে আবারও ফিরে আসেন।
এসব তথ্যকে একসুতোয় গেঁথে নানা ধরনের সন্দেহ করছেন সাংসদের বোন আফরোজা। সাত ভাইবোনের সবার বড় আফরোজা বলেন, ভাইবোনদের মধ্যে মনজুরুল ষষ্ঠ। কোলেপিঠে করে সন্তানের মতো মানুষ করেছিলেন তিনি। কিন্তু বড় হয়ে অনেক দূরত্ব তৈরি হয়। এটি তাঁদের পৈতৃক ভিটা হলেও তাঁরা কেউই এখানে খুব বেশি আসতেন না, এমনকি ঢাকার বাড়িতেও যেতেন না। সাংসদের স্ত্রীর বাড়ির আত্মীয়-স্বজনেরাই সব সময় আশপাশে থাকতেন।
তাহলে সেদিন সাংসদ হঠাৎ একা হয়ে পড়লেন কেন? আফরোজা বলেন, ‘আমরাও তো জানতাম সে সব সময় দলেবলে চলে। বাসায় আসার পরে গ্রামবাসীকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা ওকে দেখলা না। গ্রামবাসী বলল, ওই বাড়ির ধারেকাছেও ভিড়তে দেওয়া হয় না।’
বেদারুলের বিষয়ে আফরোজা বলেন, ‘ওর সঙ্গে তো কথাই বলা যাচ্ছে না। খালি কাঁদে। আমি ধমক দিলাম, এই তুমি কাঁদো কেন? ও বলে, আপা দুটো লোক আসলো। আমি এমপিকে বললাম। এমপি আসতে দিতে বলল। ওরা ভেতরে ঢুকছে। বেদারুল আরেকবার বলে, জানালা দিয়ে অন্য লোক গুলি করেছে। ওর কথার কোনো ঠিক নেই। কিন্তু এটা সত্য যে, খুনিরা এক দরজা দিয়ে ঢুকেছে, আরেক দরজা দিয়ে পাশের ঘরে গেছে বেদারুল ও স্মৃতি।’
বাড়ির ভেতরের লোককে সন্দেহ করেন কি না— জানতে চাইলে আফরোজা বলেন, ‘হ্যাঁ, ঘটনার সূত্র বের করতে হলে তো সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। সন্দেহ করা তো স্বাভাবিক। “জামায়াত”, “জামায়াত” করলে তো হবে না। যদি জামায়াত হয় তাহলে তাই, আওয়ামী লীগ হলে তা-ও খুঁজে বের করতে হবে। এ ছাড়া অন্য কেউ হতে পারে কি না, তা-ও খুঁজে দেখতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘প্রথমে স্মৃতির বড় ভাইকে মামলার বাদী করার কথা বলা হয়েছিল। তখন আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমরা বোনেরা বাদী হব না, হলে স্মৃতি হবে।’
আফরোজার সঙ্গে কথা বলার সময় স্মৃতির বড় বোন শান্তি সেখানে ছিলেন। তিনি আফরোজাকে বলেন, বেদারুল মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তখন খেপে গিয়ে আফরোজা বলেন, ‘আমাদের তো ভাই গেছে, আমাদের হার্ট। আর ওর তো ভগ্নিপতি। সে অসুস্থ হওয়ার কী আছে। আমরা এখানে আছি। ও আসছে না। অন্য সময় তো তোমরাই থাকো। এখন কোথায় গেল সব?’
ঘটনার নানা অস্পষ্টতা নিয়ে কথা হয় সাংসদের স্ত্রী খুরশীদ জাহান স্মৃতির সঙ্গে। তিনি বলেন, সব সময়ই বাড়িতে লোক থাকত। তবে অপরিচিত লোক সব সময় আসত না।
তাহলে সেদিন কেন হঠাৎ বাড়িটি খালি হয়ে গেল—জানতে চাইলে খুরশীদ জাহান বলেন, ‘আসলে এটা একটা কাকতালীয় ঘটনা। তিন দিন থেকে ছাত্রলীগের ছেলেরা একটা মামলার কারণে ধাওয়ার মধ্যে ছিল। ওরা আসত না। দিনে যত লোকই আসুক, সন্ধ্যা বেলাটা আমরা বামনডাঙ্গায় অফিসে যাই। এ কারণে সন্ধ্যায় লোক কম থাকত।’ তাহলে এ হামলার সঙ্গে বাসার কোনো লোক যুক্ত থেকে ভেতর থেকে খবর দিয়েছে, এ রকম ভাবেন কি না—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার এ রকম মনে হয় না।’ তাহলে এ সময়টা সাংসদ একা থাকেন বা থাকবেন—এ তথ্য হত্যাকারীরা জানল কীভাবে? তিনি বলেন, ‘সেটা আমিও ভাবছি। সেটা ভাববার বিষয়, তদন্তের বিষয়।’
জামায়াতকে সন্দেহ করে খুরশীদ জাহান বলেন, এখানে জামায়াতের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হয়। ২০১৩ সালে যে তাণ্ডব হয়েছে, তা সবাই জানে। প্রতিনিয়ত হুমকি আসত। হেফজ নামে এক শিবির নেতার নাম উল্লেখ করে তিনি বলেন, ও মনজুরুলকে যেখানে পাবে সেখানেই খুন করার ঘোষণা দিয়েছে। তবে ২০১৬ সালে আর কোনো হুমকি আসেনি। তিনিও (সাংসদ) একটু গা ছেড়ে দিয়েছিলেন। আমি ওর সঙ্গে থাকলে তো অপরিচিত লোক ঘরে ঢুকতেই দিতাম না। আর পুলিশের নিরাপত্তা শুধু রাতে নেওয়া হতো। এ মাসেই বাসা আর কোল্ডস্টোরেজে সিসি ক্যামেরা লাগানোর কথা ছিল।’
সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে সাংসদের স্ত্রী বলেন, সারা দিন একসঙ্গেই ছিলেন। সন্ধ্যার দিকে মোবাইলে চার্জ দিতে পাশের ঘরে যাবেন, এ সময়ই তাঁর বড় ভাই বেদারুল আসেন। ভাইকে নিয়েই তিনি পাশের ঘরে যাওয়ার পরপরই গুলির শব্দ শোনেন। দৌড়ে বের হয়ে উঠানে গিয়ে দেখেন সাংসদ বুকে হাত দিয়ে চিৎকার করে বলছেন, ‘ওরা আমাকে গুলি করছে, ধর ধর।’ কথা শুনে তিনি ও তাঁর ভাই দৌড়ে বাইরের দিকে আসেন। এসে দেখেন গাবগাছের নিচে একটি মোটরসাইকেলে তিনজন উঠছে। খুব ভালো করে খেয়াল করতে পারেননি। এ সময় একজন তাঁদের দিকে গুলিও চালায়, উল্টে পড়েন স্মৃতি। পরে আহত সাংসদকে হাসপাতালে নেওয়ার উদ্যোগ নেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ঘটনাগুলো ঘটে যায়।
বেদারুল আহসান বলেন, ‘বোন একটা কাজ দিছিল। সন্ধ্যায় বোনের বাড়ি যাওয়ার পরেই বোন বলল ওরা বের হবে, অফিসে যাবে, হাতে সময় নাই। সাংসদ পাড়ার ছেলেদের বল দিয়ে বিদায় দিল। বোনের ফোনে চার্জ নাই। বোন বলল পাশের রুমে যাই চার্জ দিতে, কাগজগুলো তাড়াতাড়ি দে। বোন অলরেডি ঘরে ঢুকছে। আর আমি পশ্চিম দরজায় যখন কাত হয়ে ঘুরব। তখন তিনটা ছেলে এসে সাংসদকে বলল, “ভাই আপনার সঙ্গে কথা বলব।” সাংসদ বসতে বললেন, আমি পাশের রুমে বোনকে কাগজ বুঝে দিচ্ছি, এর মধ্যেই গুলির শব্দ। ভগ্নিপতি চিল্লাচ্ছে।’
হামলাকারীদের আগে কখনো দেখেছেন কি না— জানতে চাইলে বেদারুল বলেন, ‘আমরা তো সব সময় যাতায়াত করি না ভাই। ছোট বোন, ছোট ভগ্নিপতি, আমাদের সে রকম দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হয়। আর উনি বিভিন্ন লোকজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলেন, তিনি উদার মনের মানুষ।’ তাদের মুখ ঢাকা ছিল কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, মাফলার পরা ছিল, তবে মুখ ঢাকা ছিল না।
সেখানে তখন সাংসদের কাছ থেকে খেলাধুলার সামগ্রী নিতে এসেছিল গ্রামের ১৫টি শিশু-কিশোর। তাদের একজন সপ্তম শ্রেণির এক ছাত্র বলে, চারটার দিকে দুটো মোটরসাইকেল নিয়ে পাঁচজন আসে। ফোনে কথা বলছিল তারা। সাড়ে চারটার দিকে তাদের একজন ছেলেদের বাড়ি চলে যেতে বলে। ছেলেরা না শুনলে ওরা রেললাইনের ওপর থাকা আরও তিনজনকে ডেকে নিয়ে আসে। তবে তারা কোনো নাম ধরে ডাকেনি। ‘এই, এই’ বলে ডাকছিল। মাগরিবের আজান দেওয়ার পরও ১৫ মিনিট তারা সাংসদের বাড়ির সামনে খেলছিল। যাওয়ার আগে তারা সাংসদের কাছে দুটি ভলিবল চায়। সাংসদ তাদের বল দিয়ে কীভাবে খেলতে হয়, তা-ও দেখিয়ে দেন। এরপর তিনি বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেলে ছেলেরাও ভলিবল নেটের দাবি নিয়ে ভেতরে যায়। ছেলেটি বলে, ‘এ সময় একটা মুন্সী লোক, দাড়ি আছে, আমাকে ঠেলে বাইরে নিয়ে যায়। আমরা তখন বাড়ির পথ ধরি। রাস্তাতেই গুলির শব্দ শুনি।’
সাংসদের সম্বন্ধী বেদারুল মাফলারের কথা বললেও ছেলেরা জানায়, এদের কারোরই মুখ ঢাকা ছিল না, একজনের হাতে একটি মাংকি টুপি ছিল মাত্র। তাদের কথাবার্তাও গাইবান্ধার মানুষের মতো নয়। তারা অন্য এলাকার টানে কথা বলছিল।
তদন্তে এসব বিষয় খতিয়ে দেখা হচ্ছে উল্লেখ করে জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবদুল্লাহ আল ফারুক বলেন, ‘আপনারা যা শুনছেন সবই খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তার রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকে সবই তদন্তে থাকছে। তবে অতীতে জামায়াত এখানে অনেক ঘটনা ঘটিয়েছে। তাই মূল সন্দেহ তাদের দিকেই।’
তদন্তে যুক্ত পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের এক কর্মকর্তা পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বেদারুলের বর্ণনা ও আনুষঙ্গিক বিষয় তাঁদের সন্দেহের মধ্যে রয়েছে। কিন্তু যেহেতু সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে জামায়াতকে দায়ী করা হচ্ছে, তাই তাঁরা তদন্তে বাড়তি চাপ বোধ করছেন। হুট করে বেদারুলকে বা সাংসদের স্ত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চান না তাঁরা।