নারী জঙ্গিদের হামলার প্রস্তুতি?

Slider সারাদেশ

46034_aaa

ঢাকা;  নারী জঙ্গি নতুন রূপে আবির্ভূত। সুইসাইড ভেস্ট ব্যবহারকে নতুন উদ্বেগের কারণ হিসেবে দেখছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা
রাজধানীর আশকোনায় আত্মঘাতী হওয়ার মধ্য দিয়ে নারী জঙ্গিরা নতুন রূপে আবির্ভূত হয়েছেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বোমাভর্তি আত্মঘাতী বন্ধনী (সুইসাইড ভেস্ট) ও শিশুকে ঢাল হিসেবে ব্যবহারের ঘটনা। এটাকে নতুন উদ্বেগের কারণ হিসেবে দেখছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা। তাঁরা এ ঘটনাকে নারী জঙ্গিদের সরাসরি আক্রমণে পাঠানোর জন্য প্রস্তুতির লক্ষণ বলে মনে করছেন।

পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম গতকাল রোববার সন্ধ্যায় সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেছেন, জঙ্গিরা কোনো ঘটনা ঘটানোর জন্য আশকোনার আস্তানায় বিপুলসংখ্যক বোমা ও বিস্ফোরক সংগ্রহ করেছিল। তিনি বলেন, ‘আমাদের ধারণা, যে মহিলা মারা গেছেন, তাঁকে এবং তাঁর কন্যাকেই হয়তোবা আত্মঘাতী কোনো হামলার জন্য ব্যবহার করে থাকতে পারত। আজকের বড়দিন বা থার্টি ফার্স্ট নাইটকে কেন্দ্র করে হয়তো তারা কোনো পরিকল্পনা করছিল।’
এ দেশে নারীদের জঙ্গি তৎপরতায় যুক্ত হওয়ার প্রবণতা নতুন নয়। দ্বিতীয় প্রজন্মের জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) নেতারা শুরু থেকেই তাঁদের স্ত্রী, কন্যাদের এ পথে জড়িয়েছেন। পরবর্তী সময়ে সংগঠনের সদস্যরাও একই ধারা অনুসরণ করেন। গত দেড় দশকের জঙ্গি তৎপরতা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সংগঠনে নারীরা মূলত স্বামী, ভাই বা বাবার দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েছেন এবং তাঁদের সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন। নারী সঙ্গে থাকলে জঙ্গিদের যাতায়াত ও বাসা ভাড়া করা সহজ হয়। কিন্তু নারী জঙ্গিদের আলাদাভাবে প্রশিক্ষণ বা হামলায় ব্যবহারের তেমন কোনো নজির এর আগে পাওয়া যায়নি।
তবে ২০০৬ সালের ১৩ মার্চ কুমিল্লায় এক জঙ্গি আস্তানায় র্যা বের অভিযানের সময় জেএমবির মোল্লা ওমরের স্ত্রী সাইদা নাঈম সুমাইয়া তাঁর দুই শিশুসন্তানকে নিয়ে আত্মঘাতী হয়েছিলেন। তার আগে ওই অভিযানে জেএমবির ‘বোমা বিশেষজ্ঞ’ মোল্লা ওমরও নিহত হয়েছিলেন।
জেএমবির প্রতিষ্ঠাতা শায়খ আবদুর রহমান ২০০৬ সালে গ্রেপ্তারের পর টাস্কফোর্স ফর ইন্টারোগেশন (টিএফআই) সেলে যে জবানবন্দি দিয়েছেন, তাতে তিনি বলেছেন, জেএমবিতে নারী ইউনিট বলে কিছু নেই। নারীদের কেবল সংগঠনের মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ করা হয়, যাতে পরিবারের পুরুষ সদস্যদের সহযোগী হিসেবে কাজ করে।

অবশ্য পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে অনুসন্ধানে নারী জঙ্গিদের দাওয়াতি কাজে (অন্য নারীদের মধ্যে উগ্র মতাদর্শ প্রচার) ব্যবহারের তথ্য পাওয়া গেছে। জেএমবির আগে এ দেশে সক্রিয় হয় হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশ বা হুজি-বি। এই সংগঠনটিতে নারীদের যুক্ত করার তথ্য পাওয়া যায়নি।

তবে হিযবুত তাহ্রীরের শুরু থেকে নারী শাখা রয়েছে। আনসারুল্লাহ বাংলা টিমেরও (বর্তমান নাম আনসার আল ইসলাম) নারী সমর্থক আছে। এই দুই সংগঠনের নারী সদস্যদের এখন পর্যন্ত সহিংসতায় যুক্ত হওয়ার কোনো খবর পাওয়া যায়নি।

আইএস মতাদর্শী নব্য জেএমবি শুরু থেকেই সাংগঠনিক কার্যক্রম বিস্তারে পুরোনো জেএমবির ধারা অনুসরণ করে আসছে। গুলশানে হলি আর্টিজানে হামলার জন্য দায়ী এই সংগঠনের জঙ্গিরাও স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে নিয়েই অবস্থান করতেন বা অবস্থান পাল্টাতেন। তবে এই সংগঠনের নারীদের আক্রমণাত্মক হওয়ার প্রথম ঘটনা দেখা যায় গত ১০ সেপ্টেম্বর আজিমপুরে। ওই দিন সেখানে জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালাতে গেলে নারী জঙ্গিরা ছুরি ও মরিচের গুঁড়া নিয়ে পুলিশের ওপর আক্রমণ করেন। তখন পুলিশের গুলিতে দুই নারী আহতও হয়েছিলেন।

 

এর সাড়ে তিন মাস পর গত শনিবার আশকোনায় পুলিশের আহ্বানে জঙ্গি আস্তানা থেকে শিশুসন্তানকে নিয়ে আত্মসমর্পণের ভান করে বেরিয়ে আসেন এক নারী। কিছুটা এগিয়েই কোমরে বাঁধা সুইসাইড ভেস্টের বিস্ফোরণ ঘটান তিনি। এই ঘটনায় ওই নারীর শিশুসন্তানও গুরুতর আহত হয়।
এই অভিযানে থাকা পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের অতিরিক্ত কমিশনার ছানোয়ার হোসেন বলেন, ওই নারী জঙ্গি শিশুটিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল পুলিশের কাছে এসে বিস্ফোরণ ঘটানো।

 

জঙ্গিবাদবিষয়ক বিশ্লেষক এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক মো. নুর খান প্রথম আলোকে বলেন, এ ঘটনায় পরিষ্কার হয়ে উঠেছে যে, নারী জঙ্গিরা ক্রমান্বয়ে সহিংস হয়ে উঠেছেন। তাঁরা বিস্ফোরক বিষয়ে ইতিমধ্যে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়েছেন। জঙ্গি সংগঠনগুলো নারীদের সরাসরি আক্রমণে পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে ধারণা করা যায়। এটা নতুন করে ভাবনার উদ্রেক ও উদ্বেগ তৈরি করেছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের নারীরা যদি এ ধরনের আক্রমণে জড়িত হন, পোশাকের কারণেও শনাক্ত করা অনেক ক্ষেত্রে কঠিন হবে।

 

জঙ্গিবাদ দমনে যুক্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন কর্মকর্তা বলেন, জঙ্গিবাদে নারীদের নানাভাবে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে। একটি হলো জঙ্গি পরিবারের সদস্য নারী জঙ্গি হন। স্বামী হঠাৎ জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হলে স্ত্রীও একপর্যায়ে এতে যুক্ত হন। আবার পুরোপুরি যুক্ত হন না, এমনও আছে। আরেকটি হচ্ছে, জঙ্গি পরিবারের কোনো ছেলের সঙ্গে আরেক জঙ্গির মেয়ে, বোন বা নিকটাত্মীয়কে বিয়ে দেওয়ার মাধ্যমেও নারীদের যুক্ত করা হয়।
সম্প্রতি নিহত মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলামের স্ত্রী জেবুন্নাহার ও তানভীর কাদরীর স্ত্রী আবেদাতুন ফাতেমার মতো শিক্ষিত নারীদেরও জঙ্গিবাদে জড়িয়েছেন স্বামীরা, যা দুই নারীর অভিভাবকেরা এর আগে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন। নব্য জেএমবির আরেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা নুরুল ইসলাম ওরফে মারজানের স্ত্রী প্রিয়তিও বিয়ের পর স্বামীর দ্বারা উদ্বুদ্ধ হন। এর বাইরে সম্প্রতি কয়েকজন নারী গ্রেপ্তার হয়েছেন, যাঁদের মধ্যে শিক্ষানবিশ চিকিৎসক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীও রয়েছেন। তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এঁরা স্বামী বা নিকটাত্মীয় দ্বারা নয়, অন্যদের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। এ ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। এ ধরনের নারী জঙ্গিদের বেশির ভাগের বয়স ২০ থেকে ৩০ বছর।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব.) এম মুনিরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘নারীদের সন্ত্রাসবাদে জড়ানোর যে প্রবণতা, সেটা বৃদ্ধি পাচ্ছিল বেশ কিছুদিন থেকেই। এটা আরও বাড়বে। আশকোনার ঘটনার পর আমরা নারী জঙ্গিদের নতুন আঙ্গিকে দেখতে পাচ্ছি।’ তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন সময়ে যেটা বলা হচ্ছে, সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে, সমস্যার সমাধান সন্ত্রাসীদের শুধু মেরে ফেললে হয় না। এটার জন্য বড় ধরনের কৌশলগত অ্যাপ্রোচ থাকা দরকার। সে ধরনের কৌশলগত পদ্ধতি যদি অবলম্বন না করি, তাহলে এই সমস্যার সমাধান করতে পারব না। কিছুদিন বন্ধ থাকবে, আবার বড় ধরনের কিছু হবে, এভাবে চলতে থাকবে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *