তৃণমূলের নেতাদের ঢাকায় ডেকে এনে আগামী নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হতে দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ ঝিমিয়ে পড়া রাজনীতিতে আলোচনার খোরাক জুগিয়েছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, উন্নয়ন, বৈদেশিক অনুদান ও ঋণপ্রাপ্তির চমক দেখানোর পর নিজের ওপর সরকারের আস্থা অনেকটাই বেড়েছে। এখন সরকারি দল আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের ঘাটতি দূর করতে চায়। মধ্যবর্তী, আগাম বা জাতীয়—যে নির্বাচনই হোক, সেটি করে গত নির্বাচনের বদনাম মুছে ফেলতে চায়।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক নিজামউদ্দিন আহমেদ বলেন, সফলতার বিবেচনায় সরকারের অবস্থান এখন উচুঁতে। এই প্রেক্ষাপটে প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপির নেতাদের ওপর চাপ বাড়তে পারে, যাতে দলটির নেতৃত্বহীনতা আরও প্রকট হয়। তাঁর ধারণা, আদালতের রায়ে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সাজা পেলে দলটি নেতৃত্বহীন হয়ে আরও বেশি এলোমেলো হয়ে পড়তে পারে।
অধ্যাপক নিজামউদ্দিন মনে করেন, গত নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত যে রাজনৈতিকভাবে কতটা ক্ষতিকর ছিল, তা বিএনপি এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। তাই সরকার যখন, যে অবস্থায় নির্বাচন দিক না কেন, দলটি তাতে অংশ নেবে।
বিশ্লেষণে দেখা যায়, আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন থেকে জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে। দলীয় সভানেত্রীর বক্তব্য, দলের ঘোষণাপত্র, মানুষের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি—সবকিছুতেই আগামী নির্বাচনে দলের কৌশল ও অবস্থানের প্রতিফলন লক্ষ করা গেছে। নেপথ্যে যেসব বিষয় কাজ করুক না কেন, প্রকাশ্যে সাধারণ সম্পাদক পদে ওবায়দুল কাদেরকে আনার মূল কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে তিনি মাঠের নেতা, তৃণমূলে তাঁর যোগাযোগ ভালো।
আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার মূল্যায়ন হচ্ছে গণতান্ত্রিক আবহে জন্ম নেওয়া ও পথচলা এই দলটিকে পরের পাঁচ বছর যাতে সমালোচনার মুখে সরকার চালাতে না হয়, সেই প্রস্তুতি নেওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়। কিন্তু কেন্দ্রের সঙ্গে মাঠের নেতাদের যোগাযোগ বেশ কমে গেছে। বলা যায়, একধরনের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। দলীয় সভানেত্রীর কাছে এমন কথা অনেক দিন ধরেই বলা হচ্ছিল। প্রায় আট বছর ক্ষমতায় থাকায় দলের কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত বিত্তবান ও প্রভাবশালী নেতার সংখ্যা বেড়েছে। অভ্যন্তরীণ কোন্দলেও জর্জরিত তৃণমূলের বেশির ভাগ কমিটি। যদিও সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের নেতৃত্বেই দলের অনেক জেলায় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
ওই সব নেতার কেউ কেউ বলেন, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকেও এমন কথা শোনা যায় যে সরকারকে ক্ষমতায় আনতে ও টিকিয়ে রাখতে তাদের ভূমিকা রয়েছে। তাঁদের মতে, আওয়ামী লীগের মতো ঐতিহ্যবাহী ও বড় দলের নেতা-কর্মীরা এ ধরনের কথা শুনতে প্রস্তুত বা অভ্যস্ত নন। ভোট ও গণতন্ত্র বিষয়ে অন্তত তাঁরা আর খোঁটা শুনতে চান না।
জানতে চাইলে ১৪ দলের সমন্বয়ক ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, যা হওয়ার হয়েছে। এখন দলের নতুন নেতৃত্বের প্রধান কাজ গ্রামেগঞ্জে সংগঠনকে চাঙা করা। মেয়াদের অর্ধেক সময় ইতিমধ্যে পার হয়েছে। তাই নির্বাচনী প্রস্তুতি নেওয়ার মোক্ষম সময় এখনই। এই সম্মেলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ আরও শক্তিশালী হয়েছে বলে মনে করেন শিক্ষামন্ত্রী ও সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নুরুল ইসলাম নাহিদ।
এদিকে বিএনপিকে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে হবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। তবে দলটি বেশ অগোছালো অবস্থায় রয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, বিএনপি সব কমিটি এখনো করতে পারেনি। দলটি বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে পড়েছে, সেখান থেকে উত্তরণের কোনো লক্ষণ নেই। তাই বিপুল জনসমর্থন থাকলেও তাদের সংগঠিত করার মতো শক্তি দলটির নেই। আর এ অবস্থার সুযোগ সরকার নেবে। সরকার যখন দেখে বিরোধী দল দুর্বল, তখনই সেই সময়টিকে মোক্ষম মনে করে নির্বাচন দিয়ে থাকে।
অবশ্য এ অবস্থার জন্য বিএনপির নেতারা দায়ী করছেন সরকারকে। তাঁরা বলছেন, হামলা-মামলা, নির্যাতনে নেতা-কর্মীরা বিপর্যস্ত। রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনে বাধা দেওয়া হচ্ছে। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, ক্ষমতায় কে আসবে তা জনগণ ঠিক করবে। কিন্তু এই সরকার যেকোনো উপায়ে ক্ষমতায় আসতে চায়। এ অবস্থায় বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে কি না, তা দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সিদ্ধান্ত হবে।
নির্বাচনকেন্দ্রিক প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলেও আলোচনা-পর্যালোচনা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনী প্রস্তুতিমূলক নির্দেশনার বিশেষ গুরুত্ব আছে বলেও মনে করছেন কেউ কেউ।
জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান ও সাবেক মন্ত্রী জি এম কাদের বলেন, সরকারি দলের সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি নির্বাচন সামনে রেখে দলের নেতা-কর্মীদের জনগণের আস্থা অর্জন করতে বলেছেন। তাঁর বক্তব্য থেকে জাতীয় পার্টিও আশা করে, দেশে একটি সুষ্ঠু ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।