গ্রাম বাংলা ডেস্ক: আবদুল লতিফ সিদ্দিকী কি নিজেই পরিকল্পিতভাবে সরকারকে গুডবাই জানালেন? কে কাকে গুডবাই জানালো বা জানাতে চলেছে? তিনি ইতিহাসে কিভাবে চিত্রিত হবেন? তিনি ধর্মদ্রোহী? নাকি স্বপক্ষত্যাগী? প্রধানমন্ত্রী তাঁর বিলম্বিত ও সতর্ক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, সরকার বেকায়দায় নয়, তিনি নিজে বেকায়দায় পড়েছেন।
লতিফ সিদ্দিকীর মন্তব্যের কোন অংশটি আওয়ামী লীগ সভানেত্রী কিভাবে নিয়েছেন তা পরিষ্কার হয়নি। কারণটা এখনও তিনি তা উহ্য রেখেছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তিনি ‘‘যা’’ বলেছেন তার দায় সরকার নেবে না। সুতরাং রাষ্ট্রপতি দেশে এলে হয়তো দেখা যাবে মন্ত্রিসভা বিভাগ থেকে কেবিনেট সেক্রেটারি একটি এক বাক্যের প্রজ্ঞাপন জারি করেছেন। তাতে কোন কারণ উল্লেখ ছাড়া লেখা থাকবে, তাঁকে অপসারণ করা হয়েছে। অবশ্য এর আগে এমন নজির রয়েছে যে, অপসারণ বা পদত্যাগের পরে পতাকা নামিয়ে বাড়ি চলে যাওয়ার পরে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী দপ্তরবিহীন হয়ে থেকেছেন। জনাব সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন স্থানে মামলা হয়েছে। তাঁর মাথার দাম হাঁকা হয়েছে। কিন্তু সরকারি বা দলীয়ভাবে তাঁকে এখনও অভিযুক্ত করা হয়নি। কিংবা এমনকি তাঁর বিরুদ্ধে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে একটি মামুলি কারণ দর্শাও নোটিশ পর্যন্ত জারি করা হয়নি।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী তাঁর দলের প্রেসিডিয়াম সদস্যের বক্তব্যের কোন অংশ কি কারণে অগ্রহণযোগ্য তা চিহ্নিত না করার বিষয়টি অসাবধানতাবশত নয়। বরং এটা সুচিন্তিত হতে পারে। এর মাধ্যমে প্রকারান্তরে তিনি নিশ্চিত করেছেন যে, বিষয়টি মিডিয়ায় যে ভাবে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হিসেবে প্রচার পেয়েছে ঘটনাটি কেবলই তা নয়। বিষয়টি কেবলই হজ সম্পর্কে তাঁর কোন আপত্তিকর বক্তব্যের উদ্ধত বহিঃপ্রকাশ সংক্রান্ত বিষয় নয়। বরং অনেকের সন্দেহ যে, হজের বিষয়টি যা তিনি নিজেই ১৯৯৮ সালে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে পালন করে এসেছেন সেটা একটা ক্যামোফ্লেজ হতে পারে। এর আড়ালে তিনি আসলে সরকারের উপরমহলের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত বনিবনা না হওয়া সংক্রান্ত কোন বিরোধের প্রকাশ ঘটিয়ে থাকতে পারেন। কেউ কেউ বলছেন, সেখানে তিনি আর্থিক দিকেও ইঙ্গিত করেছেন। তিনি ব্যক্তিগত ভাবে বিক্ষুব্ধ হয়ে টাঙ্গাইল সমিতিতে গোটা নাটক সাজিয়েছেন কিনা সেটা এখনও স্পষ্ট নয়। আপাতত ৫ই জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন- পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য সিদ্দিকীর কেলেঙ্কারিই সবচেয়ে গুরুতর বলে মনে করা হচ্ছে।
অনেকের মতে কারণ যা-ই দেখানো হোক, কিংবা বাস্তবে যা-ই ঘটুক না কেন, লতিফ সিদ্দিকী বাংলাদেশের ইতিহাসে শেখ হাসিনা সরকারের ‘প্রথম স্বপক্ষত্যাগী’ হিসেবে কখনও চিহ্নিত হলে বিস্ময়ের কিছু থাকবে না। সৌদি দৈনিক আরব নিউজ ইতিমধ্যে সংশয় প্রকাশ করেছে যে, ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করার বিষয়টি মুখ্য নয়, তাঁকে অপসারণের সিদ্ধান্তের পেছনে প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিরুদ্ধে বিরূপ মন্তব্য করার বিষয়টি মুখ্য হতে পারে। ঢাকায় একজন টিভি বিশ্লেষক বলেন, যে প্রশ্নের উত্তরে লতিফ সিদ্দিকী ‘জয় কে’ শীর্ষক মন্তব্য করেছেন সেখানে জয়ের বিষয়ে বিরূপ বা প্রশংসাসূচক কোন মন্তব্য করার কোন সুযোগই ছিল না। তিনি সম্পূর্ণ আরোপিতভাবে জয় প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন।
এটা আরও পরিষ্কার হয়ে যাবে লতিফ সিদ্দিকী নিজে ভবিষ্যতে কি প্রতিক্রিয়া দেখান এবং আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে তাঁর ব্যাপারে আগামীতে কি পদক্ষেপ নেয় সেটার ওপর। তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আগামী ১২ই অক্টোবর দলের বৈঠক ডাকা হয়েছে। সেখানে শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণ দর্শাতে হবে।
তবে এটা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ যে, তিনি সস্ত্রীক প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হয়েছিলেন। মেয়েকেও সঙ্গে নিয়েছিলেন। আর লতিফ সিদ্দিকী নিজে কখনও স্রোতের প্রতিকূলে পথ চলা একজন ভিন্নমতাবলম্বী হিসেবে পরিচিত ছিলেন না। রাজনীতি বা চিন্তাভাবনায় তিনি কোন ধরনের আদর্শ অনুসারী বলে তাঁর কখনও কোন সুনাম ছিল না ও নেই। দিন যতই যাচ্ছে ততই এটা স্পষ্ট হচ্ছে যে, লতিফ সিদ্দিকী মুখ ফসকে হঠাৎ কোন বোকার মতো কাজ করে বসেননি! এর অকাট্য প্রমাণ ঝড় ওঠার পরে বরং তিনি বিবিসিকে বলেছেন- তিনি তাঁর বক্তব্যে অটল রয়েছেন। এবং সে জন্য তিনি অনুতপ্ত নন। এমনকি তিনি ব্যতিক্রমী শর্ত জুড়ে দেন যে, প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে ফোন পেলে তবে তিনি তাঁর বক্তব্য প্রত্যাহারের কথা ভাববেন।
লতিফ সিদ্দিকী বরং এমন একজন নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন, যিনি ধারাবাহিকভাবে ফাউল খেলে এসেছেন। তাঁর দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার সম্পর্কে গত কয়েকদিনে যে সব প্রতিবেদন সরকারঘেঁষা মিডিয়া প্রকাশ করে চলেছে, সেগুলোর একটিও এমন ধরনের নয় যে, যা সরকার প্রধান এবং আওয়ামী লীগ প্রধানের ধারণার বাইরে ছিল। পত্রিকা পড়ে প্রধানমন্ত্রীর হয়তো কিছুই নতুন করে জানার নেই। সেগুলোর একটিও এমন নয় যে, এসব কারণে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী তাঁর ওপরে ক্রমেই বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন। বরং এসবের প্রত্যেকটি বিষয় আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর এতটাই ভাল জানা ছিল যে, সেগুলো লতিফ সিদ্দিকীর অসাধারণ যোগ্যতা হিসেবে চিহ্নিত ছিল। সে কারণে দলের অনেককে অবাক করে তাঁর ঠাঁই হয়েছিল আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়ামে। বিশ্লেষকরা বলেন, এর প্রমাণ হলো তাঁকে সবচেয়ে বেশি কাঁচা টাকা উপার্জনকারী এবং প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের সবচেয়ে প্রিয় তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের পূর্ণ মন্ত্রী করা হয়েছিল। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়া হলো জনাব জয়ের স্বপ্ন। আর সেই স্বপ্নের মন্ত্রণালয়ের চাবিকাঠি তুলে দেয়া হয়েছিল লতিফ সিদ্দিকীর হাতে। অনেকে দুয়ে দুয়ে চার মিলাচ্ছেন। সন্দেহ করছেন, এখানে কি এমন অভাবনীয় কিছু ঘটে থাকতে পারে, যাতে লতিফ সিদ্দিকী প্রচণ্ড হতাশ হয়ে পড়েছিলেন।
নিউ ইয়র্কের টাঙ্গাইল সমিতি কোন উল্লেখযোগ্য সংগঠন নয়। সেখানে তাঁর বক্তৃতা শুনতে এবং তা কভার করতে সাংবাদিকদের কোন উপচে ভরা ছিল না। সেখানে উপস্থিত ছিলেন যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের একজন প্রবীণ নেতা। তিনি বিবরণ দেন এভাবে: ‘ঘটনা প্রায় নাটকীয়ভাবে ঘটে। তিনি আকস্মিকভাবে উপস্থাপকের হাত থেকে মাউথ স্পিকার প্রায় কেড়ে নিলেন। আর কোনও ধরনের প্রসঙ্গ ছাড়াই তিনি ধর্ম এবং অন্যান্য প্রসঙ্গ নিয়ে আপত্তিকর ও বিতর্কিত বক্তব্য দেয়া শুরু করেন। এমনকি সজীব ওয়াজেদ জয় সম্পর্কে তাঁর ঝাঁঝালো মন্তব্যও এসেছে অপ্রাসঙ্গিকভাবে। যেন তিনি ওই কথাগুলো যে করেই হোক বলার জন্যই এসেছিলেন।’
ওই সভাসংশ্লিষ্ট আরেকটি দায়িত্বশীল সূত্র বলেছে, কোন সাংবাদিক তাঁর বক্তব্য ভিডিও করেননি। আইপডে ভিডিও করা হয়েছিল। ধারণা করা হয় সেটা মন্ত্রীর নির্দেশেই মিডিয়ার নাগালে পৌঁছে দেয়া হয়। এ সব কারণেই কোটি টাকা দামের প্রশ্ন, শেখ হাসিনা এবং লতিফ সিদ্দিকী- আসলে কে কাকে গুডবাই জানাচ্ছেন? এবারের কোরবানিতে লতিফ সিদ্দিকী কি কোরবানি দিলেন? বাতাসে নানা প্রশ্ন ভাসছে।