আড়াই বছর আগে উগ্রবাদে জড়ান মেজর জাহিদ

Slider গ্রাম বাংলা বাংলার মুখোমুখি সারাদেশ

bc3306313e0c3fe9145a3130528b6af9-282_COMILLA--MAJOR-JAHID-FAMILY-PIC-02

ঢাকা; চলতি বছরের ২৮ এপ্রিল পরিবার ও নিকটাত্মীয়দের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিলেন মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলাম ও তাঁর স্ত্রী জেবুন্নাহার (শীলা)। বলেছিলেন, আর দেখা না-ও হতে পারে। স্বজনদের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার চার মাস পর গত শুক্রবার রাতে ঢাকার মিরপুরের রূপনগরে পুলিশের অভিযানে গুলিতে নিহত হন পদাতিক বাহিনীর সাবেক এই কর্মকর্তা। তাঁর স্ত্রী ও দুই শিশুসন্তানের খোঁজ পাওয়া যায়নি।

জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রমে যুক্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ একটি সূত্র বলছে, তারা তথ্য পেয়েছে, জাহিদুল তাঁর স্ত্রীকেও জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করেন। তাঁরা আইএস মতাদর্শে বিশ্বাসী নব্য জেএমবির অন্য অনেকের মতো ‘হিজরত’ করার কথা বলে গত এপ্রিলে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হন।
ওই সূত্র বলছে, তাদের কাছে তথ্য আছে জাহিদ উগ্রবাদে জড়িয়েছেন অন্তত আড়াই বছর আগে। এরপর গত বছর সেনাবাহিনীর চাকরি ছাড়েন। চাকরি ছাড়ার কারণ হিসেবে তিনি তাঁর পরিচিতজনদের বলেছিলেন, চাকরির কারণে ঠিকভাবে তিনি ধর্ম-কর্ম করতে পারছেন না।
জাহিদের ব্যাপারে জানতে চাইলে আন্তঃবহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) পরিচালক লে. কর্নেল রাশিদুল হাসান গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর আসার পর আমরা খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, ২০১৫ সালের জুলাই মাসে এই নামে একজন মেজর অবসরে যান।’
জাহিদের একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৩ সাল থেকে জাহিদের আচরণে পরিবর্তন আসতে শুরু করে। তখন থেকে তিনি পুরোনো বন্ধুবান্ধব ও চেনা জগৎ থেকে ক্রমে বিচ্ছিন্ন হতে থাকেন। গত বছরের মাঝামাঝি হঠাৎ কেন সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে দেন, সে বিষয়টি পুরোনো বন্ধুরা জানেন না।
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের দায়িত্বশীল একটি সূত্র বলছে, গুলশান হামলার অন্যতম ‘সমন্বয়কারী’ বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক তামিম চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল। ‘ক্যালগ্যারি ক্লাস্টার’ নামের কানাডার বহুল আলোচিত একটি জঙ্গি গ্রুপের সঙ্গেও মেজর (অব.) জাহিদের যোগাযোগ ছিল বলে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গতকাল প্রথম আলোকে বলেছেন।
গত ২৭ আগস্ট নারায়ণগঞ্জে পুলিশের অভিযানে তামিম চৌধুরী নিহত হওয়ার পর কানাডার দৈনিক দ্য গ্লোব অ্যান্ড মেইলে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, তামিম চৌধুরী এই ‘ক্যালগ্যারি ক্লাস্টারে’ যুক্ত ছিলেন। কানাডার ক্যালগ্যারি শহরভিত্তিক ছোট অথচ ভয়ংকর এই গ্রুপকে দেশটির বাইরে বিভিন্ন হামলার ঘটনায় দায়ী করা হয়ে থাকে।
অবশ্য ঢাকায় ইমিগ্রেশন পুলিশের রেকর্ড অনুযায়ী, কানাডীয় নাগরিক তামিম চৌধুরী বাংলাদেশে আসেন ২০১৩ সালের ৫ অক্টোবর। আর জাহিদের শ্বশুর মো. মমিনুল হকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, জাহিদ ২০১৪ সালের জুন মাসে একটি প্রশিক্ষণে ছয় মাসের জন্য কানাডায় যান। এরপর দেশে ফিরে সিলেটের জালালাবাদ সেনানিবাসে যোগদান করেন। তখন তিনি সেনাবাহিনীর রেশন নেওয়া বন্ধ করে দেন। একপর্যায়ে সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে দেন।
মমিনুল হক বলেন, সেনাবাহিনীর চাকরি ছাড়ার পর ঢাকায় বেসরকারি স্কুলের প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা বেতনে চাকরি নেন। এ সময় তিনি দাড়ি রেখে পায়জামা ও পাঞ্জাবি পরা শুরু করেন। জাহিদের মা-বাবা ও বোন জাহিদের এ পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেন।
সাম্প্রতিক জঙ্গিবাদবিরোধী অভিযান সম্পর্কে ওয়াকিবহাল একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, জাহিদের পুরো পরিচয় না পেলেও মুরাদ ওরফে জাহাঙ্গীর (ছদ্মনাম) নামে জেএমবিতে যে একজন সদ্য অবসরপ্রাপ্ত মেজর সক্রিয় আছেন, জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন, এমন তথ্য গত বছরের শেষ দিক থেকে পাওয়া যাচ্ছিল। গত বছর ঢাকায় শিয়াদের ধর্মীয় কেন্দ্র হোসেনি দালানে হামলার পর ধরা পড়া জঙ্গিদের কাছ থেকে এবং গত ৭ জুলাই কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় ঈদের জামাতে হামলার ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া জঙ্গি শফিউল (পরে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত) কথিত মেজর মুরাদ সম্পর্কে তথ্য দিয়েছিল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তারা বলছেন, তাঁরা জানতে পেরেছেন, গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলাকারী জঙ্গিদের মেজর জাহিদ গাইবান্ধার চরে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন।
কী করে জাহিদের অবস্থান শনাক্ত হলো, জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় তামিমের ভাড়া করা বাসায় অভিযান শেষে তল্লাশির সময় ঢাকার রূপনগরের বাসার একটি ভাড়াটে তথ্য ফরম পাওয়া যায়। ওই ফরমে জাহাঙ্গীর আলমের নাম লেখা ছিল। পরে পুলিশ জেনেছে, ২৭ আগস্ট নারায়ণগঞ্জে অভিযানের পর ওই দিন বিকেলের দিকে জাহিদ স্ত্রী, দুই সন্তানসহ রূপনগরের ওই বাসা থেকে বেরিয়ে যান।
পুলিশ ধারণা করছে, গত শুক্রবার জাহিদ রূপনগরের ওই বাসায় এসেছিলেন সাংগঠনিক কাগজপত্র সরিয়ে নিতে। অভিযানের পর পুলিশ ওই ঘরের ভেতর কিছু পোড়া কাগজপত্র পেয়েছে। অবশ্য তিনি মেয়ের স্কুলের ডায়েরিতে নিজের সঠিক নাম লিখেছিলেন। ওই ডায়েরি ওই বাসায় পাওয়া গেছে।
‘মেয়ে ও নাতনিদের সন্ধান চাই’: ‘ও তো চলে গেল। আমার মেয়ে ও নাতনিরা কোথায় আছে? কেমন আছে? ওদের চিন্তায় অস্থির আমরা। আমরা ওদের সন্ধান চাই।’ গতকাল বিকেলে যোগাযোগ করা হলে মেজর জাহিদের শ্বশুর মো. মমিনুল হক ও শাশুড়ি জোহরা আক্তার  এসব কথা বলেন।
মো. মমিনুল হক কুমিল্লার শৈলরানী দেবী পৌর বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক। গতকাল কুমিল্লা নগরের নবাববাড়ি এলাকার ভাড়া বাসায় তাঁদের মেজো ছেলে এ কে এম শাহিদুল হকের বাসা থেকে মুঠোফোনে তাঁর সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, চলতি বছরের ২৮ এপ্রিল রাজধানীর উত্তরায় বড় মেয়ের বাসায় ছোট মেয়ে জেবুন্নাহারের সঙ্গে দেখা হয়। তিনি বলেন, ‘সেটাই ছিল শেষ দেখা। ওই দিন মেয়ে বলেছিল, “তোমাদের সঙ্গে আর দেখা না-ও হতে পারে।” এরপর আর তাঁদের হদিস মেলেনি। আমরা ভেবেছিলাম ওরা বিদেশে আছে।’
মো. মমিনুল হক বলেন, ‘২০১৪ সালের ২০ জুন আমার ছোট ছেলে সোহেলের বিয়ে হয়। বিয়েতে মেয়ের জামাই জাহিদ উপস্থিত ছিলেন। এর দুদিন পর সে কানাডায় চলে যায়। কানাডা থেকে আসার পর তাঁর মধ্যে পরিবর্তন লক্ষ করা যায়।’
মেজর জাহিদের দাদাবাড়ি সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে। তাঁর বাবা অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ পরিদর্শক মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম কর্মসূত্রে দীর্ঘদিন কুমিল্লায় ছিলেন। ওই সূত্রে তিনি কুমিল্লার আদর্শ সদর উপজেলার পাঁচথুবী ইউনিয়নের পশ্চিম চাঁন্দপুরে বাড়ি করে স্থায়ী নিবাস গাড়েন। জাহিদ বড় ছেলে। তিনি কুমিল্লায়ই লেখাপড়া করেন।
গতকাল ওই বাড়ি গিয়ে জানা যায়, গত শুক্রবার সকালে নুরুল ইসলাম চিকিত্সার জন্য ঢাকায় গেছেন। বাড়ির ভাড়াটে পারভীন আক্তার বলেন, মেজর জাহিদ পাঁচ-ছয় মাস আগে একবার কুমিল্লার বাসায় এসেছিলেন। এর বেশি কিছু জানেন না।
জাহিদের শ্বশুরবাড়ির সূত্র জানায়, ২০০৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে জাহিদ (তখন ক্যাপ্টেন ছিলেন) ও জেবুন্নাহারের (শীলা) বিয়ে হয়। তাঁদের দুই কন্যাসন্তান আছে। বড় মেয়ের বয়স সাত বছর আর ছোট মেয়ের বয়স সাত মাস।শাশুড়ি জোহরা আক্তার বলেন, ‘জাহিদ নিয়মিত নামাজ পড়ত। আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছি না ওরা এমন কাজ করবে।’
জেবুন্নাহারের বড় ভাই এ কে এম শাহিদুল হক বলেন, ‘ওরা উধাও হওয়ার আগে আমাদের বলেছিলেন, “কয়েক মাসের জন্য দেশের বাইরে যাচ্ছি, আমাদের জন্য চিন্তা করবেন না।” আমরা আমাদের বোন ও বাচ্চাদের ফেরত চাই।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *