পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যার তদন্ত নতুন মোড় নিচ্ছে। পুলিশ এখন বলছে, চাঞ্চল্যকর এই খুনের সঙ্গে কোনো উগ্রপন্থির যোগসূত্র পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যক্তিগত বিরোধের জের ধরেই মিতুকে খুন করা হতে পারে। হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে এরই মধ্যে ছয়জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। উদ্ধার করা হয়েছে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত অস্ত্র। পুলিশ এসব নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এখনই কোনো বক্তব্য দিতে রাজি নয়। তবে খুনের পরপরই পুলিশ বলে আসছিল, মিতু হত্যার সঙ্গে জঙ্গিরা জড়িত। এর পর দেশব্যাপী জঙ্গিবিরোধী অভিযান চালায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তদন্তের এই পর্যায়ে মিতু হত্যার ঘটনায় সন্দেহের বাইরে নন তার স্বামী বাবুল আক্তারও। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আটক সন্দেহভাজনদের কেউ কেউ বাবুলকে জড়িয়ে তথ্য দিয়েছেন। আটকদের মধ্যে বাবুলের ঘনিষ্ঠ দুই সোর্স রয়েছে। তাদের তথ্যের ভিত্তিতে শুক্রবার মধ্যরাত থেকে শনিবার বিকেল পর্যন্ত ১৫ ঘণ্টা মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে বাবুলকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। বাবুল আক্তারের পরিবারের দাবি, মিতু হত্যার ঘটনায় এখন তার স্বামী ষড়যন্ত্রের শিকার হচ্ছেন। একটি মহল চক্রান্ত শুরু করেছে। গত শুক্রবার গভীর রাতে খিলগাঁওয়ে শ্বশুরের বাসা থেকে বাবুলকে মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে গতকাল শনিবার বিকেল ৪টার দিকে পুলিশ পাহারায় খিলগাঁওয়ের বাসায় ফেরেন বাবুল
এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, বাবুল পুলিশের কর্মকর্তা। তিনি সবাইকে চেনেন, সবাইকে জানেন। যেসব অপরাধীকে আমরা শনাক্ত করেছি, ধরেছি এবং তাদের জবানবন্দি পেয়েছি, তাদের ব্যাপারে নিশ্চিত হতেই বাবুলকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
পুলিশ মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক সমকালকে বলেন, যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বা মামলার বাদীকে তদন্তকারী কর্মকর্তা জিজ্ঞাসাবাদ করে থাকেন। এ কারণে মিতু হত্যাকা ের ঘটনায় তার স্বামী বাবুল আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। চট্টগ্রাম থেকে আসা তদন্তকারী কর্মকর্তারা শনিবার তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন।
পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার গতকাল বিকেলে সাংবাদিকদের বলেন, মামলার তদন্তের বিষয়ে ‘আলোচনা করতে’ তাকে ডিবি কার্যালয়ে ডেকে নেওয়া হয়েছিল। সাংবাদিকদের উদ্দেশে তার প্রশ্ন ছিল, ‘কে বলল আমাকে গ্রেফতার করা হয়েছে? যারা তদন্ত করছেন, তারা বিভিন্ন বিষয়ে আমার সঙ্গে আলোচনা করেছেন।’
বাবুল আক্তারের শ্বশুর মোশাররফ হোসেন সমকালকে বলেন, ‘আইজিপি ডেকেছেন’- এ কথা বলে শুক্রবার গভীর রাতে বাবুলকে নিয়ে যায় পুলিশ। এটা ষড়যন্ত্র হতে পারে। তিনি অভিযোগ করেন, জঙ্গি ও অপরাধ দমনে বাবুলের সফলতার কারণে চট্টগ্রামে পুলিশের অনেক কর্মকর্তা তার ওপর নাখোশ ছিলেন। তারাই ষড়যন্ত্র করে বাবুলকে স্ত্রীর হত্যার দায়ে ফাঁসানোর চেষ্টা করছেন।
গভীর রাতে যেভাবে ডিবি কার্যালয়ে বাবুল: শুক্রবার রাত সোয়া ১টার দিকে খিলগাঁওয়ের মেরাদিয়ার ভুঁইয়াপাড়ার ২২০/এ নম্বর বাসায় যান পুলিশের মতিঝিল বিভাগের ডিসি আনোয়ার হোসেন ও খিলগাঁওয়ের ওসি কাজী মাইনুল ইসলাম। সাদা পোশাকে তারা গিয়ে ‘আইজিপি ডেকেছেন’- এ কথা জানিয়ে বাবুলকে ডেকে এনে গাড়িতে তোলেন। এর পর তাকে সরাসরি নেওয়া হয় মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে। বাবুলের শ্বশুর মোশাররফ হোসেন সমকালকে বলেন, শুক্রবার সন্ধ্যায় পুলিশ কনভেনশন সেন্টারে ২৪তম বিসিএসের মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া পুলিশ কর্মকর্তাদের ইফতার মাহফিলের অনুষ্ঠানে আইজিপির সঙ্গে বাবুলের দেখা হয়েছিল। অনুষ্ঠান থেকে ফেরার পর আবারও আইজিপির কথা বলে তাকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় রমনা কমপ্লেক্সের একটি বাসায় বাবুলের দুই সন্তানকে রাখা হয়। রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত দুই নাতি-নাতনিকে নিয়ে সেখানে ছিলাম। পরে বাবুল আসার পর রাত পৌনে ১টার দিকে খিলগাঁওয়ের বাসায় ফিরি। এ সময় খিলগাঁও থানার ওসি আমাদের সঙ্গে ছিলেন। বাসায় ফেরার পর ওসি ফোনে কথা বলতে বাসার বাইরে যান। সোয়া ১টার দিকে মতিঝিলের ডিসিকে নিয়ে বাসায় প্রবেশ করেন ওসি। ‘বাবুলকে আইজিপি ডেকেছেন’- এ কথা বলে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়।
মতিঝিলের ডিসি আনোয়ার হোসেন এ ব্যাপারে সমকালকে বলেন, ‘আমি যথাযথ কর্তৃপক্ষের নির্দেশ পালন করেছি মাত্র।’
বাবুলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে: এসপি বাবুল আক্তারকে গভীর রাতে বাসা থেকে আইজিপির কথা বলে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি ষড়যন্ত্র বলে মনে করছেন তার শ্বশুর ও সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেন। গতকাল শনিবার দুপুরে খিলগাঁওয়ের মেরাদিয়া ভঁূইয়াপাড়ার নিজ বাসায় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ কথা বলেন। গতকাল দুপুরে মেরাদিয়ায় বাবুলের শ্বশুরের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, ওই বাসার সামনে সাত-আটজন পুলিশ সদস্য। বাবুলের শ্বশুর বলেন, এটা খুবই দুঃখজনক ঘটনা। তাকে এভাবে পুলিশ নিয়ে যাবে, এটা আশা করিনি। বাবুল তার স্ত্রীকে হারিয়েছেন। আমরা মেয়েকে হারিয়েছি। আমি যেমন ক্ষতিগ্রস্ত, বাবুলও তেমনি ক্ষতিগ্রস্ত। আশা করব, তাকে যেন হয়রানি না করা হয়। তাকে পুলিশ নিয়ে যাওয়ার আধা ঘণ্টার পর থেকেই তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছিল না। আইজিপির কথা বলে তাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, এ বিষয়েও পুলিশ কিছু জানায়নি। বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ নিয়েও কোনো কিছু জানা যায়নি। গত বৃহস্পতিবারও বাবুলকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। তখন তার সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা গেলেও এবার আর তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।
বাবুলের শ্বশুর আরও বলেন, মিতু হত্যায় বাবুলকে জড়িয়ে কোনো কোনো অনলাইনে সংবাদ প্রকাশ করে একটি মহল ষড়যন্ত্র করছে। এ বিষয়ে মিতুর বোন শায়লা মোশাররফ বলেন, যারা সম্মানহানি করছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বাবুল আক্তারের বাবা আবদুল ওয়াদুদ সমকালকে জানান, মিতু হত্যায় কয়েকজন সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে বাবুলের দুই সোর্স রয়েছে। তাদের দেওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করার জন্য বাবুল আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। বাবুল একজন দক্ষ পুলিশ কর্মকর্তা।
তদন্তে যৌথ টিম: মিতু হত্যার তদন্তে পুলিশ সদর দপ্তর একটি সমন্বিত দল গঠন করে। এই দলে রয়েছেন পুলিশ সদর দপ্তর, কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের চৌকস সদস্যরা। ঢাকা থেকে তদন্ত সহায়ক দলের সদস্যরা গত সাত দিন চট্টগ্রামে অবস্থান করে মিতু হত্যায় জড়িত সন্দেহে ছয়জনকে আটক করেন। সূত্র জানায়, আটকদের কয়েকজন জানিয়েছেন, মিতু হত্যার সঙ্গে বাবুুলের সম্পৃক্ততা রয়েছে। তার পরিকল্পনায় তাকে হত্যা করা হয়। তবে বাবুলকে ফাঁসাতে সন্দেহভাজনরা এসব তথ্য দিয়েছেন কি-না, তা যাচাই-বাছাই করছে পুলিশ। গত বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার ইকবাল বাহার ঢাকায় আসেন। শুক্রবার রাতে ডিবি কার্যালয়ে বাবুলকে ডেকে নিয়ে তদন্ত দলের সদস্যরা বেশ কিছু বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। মিতু হত্যার ঘটনায় চট্টগ্রামের একজন ব্যবসায়ীকে নজরদারিতে রাখছে পুলিশ। ঘটনায় জড়িতদের কয়েকজন পার্বত্য এলাকায় পালিয়ে ছিলেন। সেখানে অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করা হয়েছে। কেন জঙ্গি কায়দায় হামলায় চালিয়ে মিতুকে হত্যা করা হয়েছে, সে ব্যাপারে তাদের ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। এ ছাড়া এরই মধ্যে তদন্তে পাওয়া গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পুলিশের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে অবগত করা হয়। আটক সন্দেহভাজন ছয় আসামির কাছ থেকে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে।
পুলিশের একটি সূত্র জানায়, বাবুল আক্তার জঙ্গিবিরোধী অপারেশনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছিলেন। তার স্ত্রীকে জঙ্গি কায়দায় খুন করা হয়। ঘটনার পর প্রথমে জঙ্গিদের সন্দেহ করা হচ্ছিল। বাবুল আক্তারের স্ত্রীকে হত্যার পর কথিত ‘দায়’ স্বীকার করেও কোনো উগ্রপন্থি বার্তা দেয়নি। এর পর তথ্য পাওয়া যায়, বাবুল আক্তারের দুই সোর্স আবু মুছা ও এহতেশামুল হক ভোলাসহ সাতজন এ হত্যাকাণ্ডে ভাড়াটে হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। হত্যা মিশনে সাতজনের কার কী ভূমিকা ছিল, তা নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ। তবে হত্যার নেপথ্য নায়ক ছিল একজন, যার দেওয়া ছক অনুযায়ী মিতুকে জঙ্গি কায়দায় হত্যা করা হয়েছে বলে মনে করছে পুলিশ।
অনেক প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর নেই, নজরদারিতে বাবুল: গভীর রাতে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে কেন আলোচিত এই পুলিশ কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো, তা নিয়ে গতকাল পর্যন্ত স্পষ্ট কোনো বক্তব্য দেয়নি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। মিতু হত্যায় গ্রেফতার সন্দেহভাজন আসামি শনাক্তের জন্য ডেকে নেওয়া হলে ডিসি পদমর্যাদার একজন পুলিশ কর্মকর্তার মোবাইল ফোন বন্ধ থাকার বিষয়টি নজিরবিহীন। গ্রেফতার থেকে শুরু করে জিজ্ঞাসাবাদ ও বাসায় ফেরত পাঠানো পর্যন্ত ছিল অনেক নাটকীয়তা ও লুকোচুরি। এমনকি বাবুল আক্তারের ওপর রাখা হয়েছে পুলিশের নজরদারিও। এ ছাড়া বাসা থেকে ডেকে নেওয়ার পর বাবুলের স্বজনরা খিলগাঁও থানা ও ডিবি অফিসে যোগাযোগ করেও কোনো সদুত্তর পাননি।
গত ৫ জুন চট্টগ্রামের জিইসি মোড়ে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে গিয়ে দুর্বৃত্তদের হাতে খুন হন মাহমুদা খানম মিতু। তাকে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয়। বাবুল আক্তার জঙ্গিবিরোধী ভূমিকা রাখায় তার স্ত্রী হত্যাকাণ্ডের পর গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোলপাড় শুরু হয়।