কোনো রকম ইটের ব্যবহার ছাড়াই বহুতল ভবন গড়ে উঠবে। সেখানে স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করবে নগরবাসী। শীত মৌসুমে ভেতরের পরিবেশ থাকবে উষ্ণ। গ্রীষ্মকালে অনেকটাই শীতল। সাধারণ ভবনের মতোই হবে স্থায়িত্বকাল। ভূমিকম্পেও ভেঙে পড়বে না। ইট-কংক্রিটের জঞ্জালে ভরা এই নগরীতে এমনটা কেউ ভাবতেই পারেন না। কিন্তু সেই স্বপ্নকেই সম্ভব করেছে হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট। আর সেটা খোদ রাজধানীতেই। পাঁচতলা একটি ভবনের কাজ এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। শিগগির সেখানে বসবাসও শুরু হবে। আরেকটি চারতলা ভবন তৈরির কাজও শুরু করার প্রস্তুতি সম্পন্নপ্রায়।
রাজধানীর ১২০/৩, দারুস সালাম রোডে অবস্থিত হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ভেতরেই তৈরি করা হয়েছে ওই পাঁচতলা ভবনটি। দেখতে অবিকল ইট-কংক্রিটের ভবনের মতোই। কিন্তু সেখানে কোনো পোড়া ইটের ব্যবহার নেই। তবে সিমেন্ট, বালু, সোলা ও তারের
ব্যবহার আছে। কেবল কলামগুলোতে ব্যবহার করা হয়েছে স্বল্প পরিমাণ লোহার রড।
কেবল ইটছাড়া ভবনই নয়, র্যাংগস ভবনের ধ্বংসস্তূপ থেকেও একটি দোতলা ভবন তৈরি করে সেখানে প্রতিষ্ঠানটির কর্মচারীরা বসবাস করছেন। পাশাপাশি হাওর, বিল, জলাশয় ও উপকূলীয় এলাকার মানুষের জন্য তৈরি করেছে ভাসমান বাড়ি। এ ছাড়া বাজারজাত করছে আগুনবিহীন ইট। ভরাট হয়ে যাওয়া নদীর মাটি (ড্রেজিং সয়েল) দিয়েও ব্যতিক্রমধর্মী ইট তৈরি করছে এই প্রতিষ্ঠানটি। আর এ সবকিছুই হচ্ছে পরিবেশবান্ধব।
১৯৭৫ সালের ১৩ জানুয়ারি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু হলেও দীর্ঘদিন ছিল অবহেলিত। চলতি দশকেই প্রতিষ্ঠানটি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। একের পর এক তৈরি করে নিত্যনতুন প্রযুক্তি।
হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক আবু সাদেক পিইঞ্জ বলেন, কাঠ দিয়ে বহুতল ভবনের নজির অনেক আছে। সেগুলোতেও কম-বেশি ইটের ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এটা একেবারেই ইটবিহীন। বাংলাদেশে এ ধরনের বহুতল ভবন এটিই প্রথম। তিনি জানান, ইট তৈরি করতে হলে ফসলি জমির মাটির প্রয়োজন হয়। সেগুলো পোড়াতে লাগে কয়লা ও কাঠ। এতে পরিবেশের উষ্ণতা বাড়ে। পাশাপাশি বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা বেড়ে যায়। অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয়। সব মিলিয়ে পরিবেশের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বর্তমানে ইটের জন্য মাটি কাটতে হয় বলে প্রতি বছর ফসলি জমির পরিমাণ ১ শতাংশ কমে যায়। ২০৪১ সালে বাংলাদেশের লোকসংখ্যা হবে ২৩ কোটি। এভাবে ফসলি জমি কমলে পাঁচ কোটি লোকের খাবারে ঘাটতি পড়বে। এ জন্য এখন থেকেই এ ধরনের ভবন তৈরির কথা ভাবতে হবে।
যেভাবে এই ভবন :সরেজমিনে পাঁচতলা ভবনটি দেখে ও নির্মাণের সঙ্গে সম্পৃক্তদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভবনের দু’পাশের ১৬টি কলাম তৈরি করা হয়েছে স্বাভাবিকভাবেই। এ ছাড়া যে ব্লক ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলো তৈরি করা হয়েছে শুকিয়ে যাওয়া নদীর পলি মাটি দিয়ে। এর সঙ্গে মেশানো হয়েছে সিলেটের বালু ও কিছু সিমেন্ট। এখানে সিমেন্টের সঙ্গে অন্য উপকরণের মাত্রা_ সিমেন্ট একটি, বালু ও মাটি দুটি করে। এভাবে তৈরি করা হয়েছে ব্লকগুলো। কিছু ব্লকের ভেতর কিছুটা ফাঁপা। এ ছাড়া দেয়ালে ব্যবহার করা হয়েছে শোলার ব্লক। শোলার ব্লকগুলোর চারপাশে রয়েছে আধা ইঞ্চি পুরু বালু-সিমেন্টের আস্তরণ। দেখতে অনেকটা কাঁচা ইটের মতো। শোলার ইট বাইরের তাপ শোষণ করে না। ফলে গরমকালে ভবনের ভেতরের পরিবেশ থাকে অপেক্ষাকৃত শীতল। একইভাবে শীতকালে ভেতরে অনুভূত হয় উষ্ণতা। ছাদে ব্যবহার করা হয়েছে প্রিকাস্ট ফেলো সিমেন্ট চ্যানেল (সিমেন্ট-বালু-তারের সমন্বয়ে তৈরি এক ধরনের পাত)। এটার পুরুত্ব মাত্র পৌনে দুই ইঞ্চি। এই পাতের সঙ্গে দুই ফুট তিন ইঞ্চি পর পর দেওয়া হয়েছে চার ইঞ্চির রিপ (বিমের মতো)। এতে ছাদের শক্তি অনেক বেড়ে যায়। সিঁড়িও তৈরি করা হয়েছে প্রিকাস্ট ফেলো সিমেন্ট দিয়ে। ভবনটির প্রতিটি তলায় ব্যবহারযোগ্য আয়তন এক হাজার ৪০০ বর্গফুট। দুটি করে ছোট ফ্ল্যাট তৈরি করা যাবে। প্রতিটি ফ্ল্যাটের সঙ্গে রয়েছে একটি করে বারান্দা। এ ধরনের ভবনের কোনো পলেস্তারার প্রয়োজন নেই। ব্যবহৃত উপকরণগুলো রিসার্চ ইনস্টিটিউটেরই প্ল্যান্টে তৈরি করা হয়েছে। ইনস্টিটিউটের ভেতরেই রয়েছে জ্বালানিসাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব ইট তৈরির প্রকল্প। বর্তমানে বাজারে তৈরি আগুনে পোড়া একটি ইটের দাম পড়ে ৭ থেকে ৮ টাকা। অথচ পরিবেশবান্ধব এই ইটের দাম পড়ে ৬ থেকে ৭ টাকা। ইনস্টিটিউট কর্তৃপক্ষ জানান, বর্তমানে সাধারণ ভবনে এক বর্গফুটের নির্মাণ খরচ পড়ে এক হাজার ৮০০ টাকা। অথচ এ ধরনের ডেমোনেস্ট্রেশন বিল্ডিং তৈরি করতে প্রতি বর্গফুটে খরচ হয় মাত্র ১ হাজার ১৫০ টাকা। পাশাপাশি সাধারণ বহুতল ভবনগুলো ভূমিকম্প সহায়ক নয়। অথচ এ ভবনগুলো ভূমিকম্প সহায়ক। এটা রিখটার স্কেলে ১০-১২ মাত্রার ভূমিকম্প হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। কোনো কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তাতে প্রাণহানির কোনো শঙ্কা নেই।
ইটবিহীন পাঁচতলা ভবনের নির্মাণকাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট সিরাজউদ্দৌলা ভূইয়া বলেন, পাঁচতলা ভবনটি তৈরি করতে ব্যয় হয়েছে ৮৩ লাখ টাকা। তৈরিতে সময় লেগেছে মাত্র নয় মাস। অথচ সাধারণ একটি ইটের ভবন তৈরি করতে এত কম সময়ে ও এত কম খরচে করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তিনি জানান, কেউ এ ধরনের ভবন তৈরি করতে চাইলে ইনস্টিটিউট থেকে এক-দু’জন প্রকৌশলী দিয়েও সহযোগিতা করা হবে। সেই প্রকৌশলীর সহযোগিতায় দেশের যে কোনো স্থানে এ ধরনের ভবন তৈরি করতে পারবেন আগ্রহী ব্যক্তিরা।
ধ্বংসাবশেষ দিয়ে ভবন :২০০৮ সালে রাজধানীর বিজয় সরণিতে ভেঙে ফেলা সেই বহুতল ভবনের ধ্বংসাবশেষ দিয়ে একটি দোতলা আধুনিক ভবনও তৈরি করেছে রিসার্চ ইনস্টিটিউট। সংশ্লিষ্টরা জানান, র্যাংগস ভবনের কংক্রিটগুলো সংগ্রহ করে সেগুলো ক্র্যাশার মেশিনে গুঁড়া করা হয়। এর সঙ্গে কিছু সিমেন্ট মিশিয়ে তৈরি করা হয় ইটের আকৃতির ব্লক। সেসব ব্লক ব্যবহার করেই তৈরি করা হয় দোতলা ভবনটি। এটাতেও ব্যবহার করা হয়নি কোনো পোড়ানো ইট। কোনো রডেরও ব্যবহার নেই। রঙেরও ব্যবহার করা হয়নি। সরেজমিন ভবনটিতে গিয়ে দেখা যায়, এরই মধ্যে ভবনটির ব্যবহার শুরু হয়েছে। ইনস্টিটিউটের কর্মচারীদের বেশ কয়েকটি পরিবার বর্তমানে বসবাস করছেন। বসবাস করে তারাও তুষ্ট।
এদিকে ড্রেজিং সয়েল দিয়ে তৈরি ইটের গুণগত মানও পোড়ানো ইটের চেয়ে বেশ ভালো। দামও বেশ কম। কর্তৃপক্ষের পরিকল্পনা রয়েছে চারতলার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও ডেমোনেস্ট্রেশন ভবনটি এভাবে পরিবেশবান্ধব ইট দিয়ে তৈরির। বগুড়াতে আরডিএ ভবন ও সাতটি গ্রামকে এক জায়গায় নিয়ে আসার কাজ চলছে। এসব গ্রামের বাসিন্দাদের জন্য তৈরি হবে পরিবেশবান্ধব বহুতল ভবন।