পারছেন না তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। পুলিশ বলছে, এসব হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটন করা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে আসামিদের। এমনকি কেউ কেউ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছে। কিন্তু তারপরও আদালতে চার্জশিট দিতে বিলম্ব হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, যে কোনো মামলার চার্জশিট দিতে নানারকম তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করতে হয়। এসব সম্পন্ন না হওয়া চার্জশিট দিতে বিলম্ব হচ্ছে। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জঙ্গি হামলা সংক্রান্ত মামলাগুলোর বেশিরভাগেরই মূল আসামি গ্রেপ্তার বা হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত অস্ত্র উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। এক-দু’জন সন্দেহভাজন গ্রেপ্তারের পরই রহস্য উদ্ঘাটনের দাবি করা হচ্ছে। এছাড়া কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিরপরাধ লোকজনকে গ্রেপ্তারের স্বীকারোক্তি আদায়ের অভিযোগও উঠেছে। পরে খোদ তদন্ত সংশ্লিষ্টরাও প্রকৃত কিলারদের ধরার পর নিজেদের ভুল বুঝতে পারছেন। এ অবস্থায় নিরপরাধ ব্যক্তিদের বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেয়া হবে সেটি সমাধান না হওয়ায় চার্জশিট দিতে পারছেন না।
সম্প্রতি পুলিশ সদর দপ্তরের এক সংবাদ সম্মেলনে আইজিপি জঙ্গি হামলার ৩৭টি মামলার বিবরণ তুলে ধরেন। এসব মামলার মধ্যে আদালতে মাত্র ৭টি মামলার চার্জশিট জমা দেয়ার কথা উল্লেখ করা হয়। যার মধ্যে একটি মামলার বিচারকাজও সম্পন্ন হয়েছে। বাকি মামলাগুলোর মধ্যে একাধিক ঘটনায় কোনো আসামি গ্রেপ্তার না হলেও রহস্য উদ্ঘাটনের দাবি করেছেন খোদ পুলিশের আইজিপি। তিনি সে সময় বলেন, ঘটনার বর্ণনা, ধরন ও অন্যান্য বিষয় বিশ্লেষণ করে কারা এর সঙ্গে জড়িত তা নিশ্চিত হওয়াতেই রহস্য উদ্ঘাটিত বলে দাবি করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পুলিশ সদর দপ্তরের দেয়া তথ্যের বাইরেও জঙ্গি সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। সেসব মামলারও চার্জশিট তো দূরের কথা, তদন্তে কোনো অগ্রগতির কথা জানাতে পারেনি তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। ২০১৩ সালের ২১শে ডিসেম্বর গোপীবাগে লুৎফর রহমান নামে এক কথিত পীর ও তার ৫ সহযোগীকে গলা কেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। প্রায় তিন বছর পেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হলেও ওই মামলা চার্জশিট দিতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। একই অবস্থা ওই বছরের ৮ই আগস্ট খুলনার খালিশপুরে কথিত পীর তৈয়েবুর রহমান ও তার কিশোর ছেলে নাজমুম মনির হত্যাকাণ্ডের ঘটনারও। ২০১৪ সালের ২৭শে আগস্ট রাজাবাজারে সংঘটিত মাওলানা নূরুল ইসলাম ফারুকী হত্যাকাণ্ডের ঘটনারও কোনো কিনারা হয়নি।
পুলিশ সদর দপ্তরের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ৩৭টি জঙ্গি সংক্রান্ত চাঞ্চল্যকর ঘটনার যে বিবরণী দেয়া হয়েছে তাতে অন্তত ৩টি ঘটনা রয়েছে, যেগুলোর কোনো আসামি গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। তবু পুলিশের পক্ষ থেকে ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনের দাবি করা হয়েছে। এগুলো হলো গত বছরের ৩১শে আগস্ট ব্লগার-প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যা মামলা, একই দিন লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর কর্ণধার আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুল হত্যাচেষ্টা মামলা এবং ৪ঠা নভেম্বর আশুলিয়ায় সংঘটিত কনস্টেবল মুকুল হত্যা মামলা। এছাড়া অন্তত ১২টি ঘটনায় সন্দেহভাজনদের গ্রেপ্তার করা হলেও আদালতে কেউ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়নি। এসব ঘটনায় হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত অস্ত্রও উদ্ধার হয়নি। তারপরও পুলিশের পক্ষ থেকে রহস্য উদ্ঘাটনের দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু দিনের পর দিন পেরিয়ে গেলেও আদালতে চার্জশিট জমা দিতে পারেনি। জানা গেছে, রাজধানী ঢাকায় আরো বেশ কয়েকটি ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনের দাবি করা হলেও কেউ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি বা হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত অস্ত্র উদ্ধার হয়নি। এগুলোর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ব্লগার-লেখক অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ৮ জন সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
কিন্তু কেউ ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে আদালতে স্বীকারোক্তি দেয়নি। একই অবস্থা ব্লগার নিলাদ্রী চট্টোপাধ্যায় ওরফে নিলয় নীল হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়। ৭ জন সন্দেহভাজন গ্রেপ্তার হলেও কেউ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়নি। এছাড়া গুলশানে ইতালিয়ান নাগরিক তাভেল্লা সিজার হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪ জন নিজেদের জড়িয়ে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। কিন্তু পুলিশের পক্ষ থেকে এ মামলায়ও আদালতে চার্জশিট দেয়া হচ্ছে না। গাবতলীতে এএসআই ইব্রাহীম হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গ্রেপ্তারকৃত ৬ জন আসামির মধ্যে ২ জন স্বীকারোক্তি দিয়েছে। বাড্ডায় কতিথ পীর খিজির খান হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গ্রেপ্তারকৃত ৫ জনের মধ্যে ২ জন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। কিন্তু দুটি ঘটনারই প্রায় ৭ মাস পেরিয়ে গেলেও আদালতে চার্জশিট জমা দিতে পারেনি পুলিশ। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (মিডিয়া) মারুফ হোসেন সরদার বলেন, ডিএমপি এলাকায় সংঘটিত চাঞ্চল্যকর কিছু ঘটনার আদালতে চার্জশিট দেয়া হয়েছে। কিছু মামলার তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষ হলেই এসব মামলায় আদালতে চার্জশিট দেয়া হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, কোনো মামলায় আদালতে চার্জশিট দিতে হলে শুধু সন্দেহভাজনদের গ্রেপ্তার করলেই হবে না বা মামলার রহস্য উদ্ঘাটন করলেই হবে না। মামলার সপক্ষে বস্তুগত সাক্ষ্য-প্রমাণ হাজির করতে হবে। ধরন বা হামলার বর্ণনা শুনে রহস্য উদ্ঘাটন বলা একটি ধারণা মাত্র। যতক্ষণ না পর্যন্ত আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিবে বা আসামিদের বিপক্ষে বস্তুগত সাক্ষ্য-প্রমাণ হাজির করা যাবে, ততক্ষণ আসলে রহস্য উদ্ঘাটন বলাও যাবে না।
সূত্র জানায়, ঢাকার বাইরে পাবনার ঈশ্বরদীতে খ্রিষ্টান যাজক লুক সরকারকে হত্যাচেষ্টা, ফরিদপুরে আলোক সেন নামে একজনকে হত্যাচেষ্টা, বগুড়া শিয়া মসজিদে হামলার ঘটনা, রাজশাহীর বাগমারায় আহমদিয়া মুসলিম জামায়াতের মসজিদে হামলাসহ সম্প্রতি ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনারই তদন্ত শেষ হয়নি। পুলিশ বলছে, এসব ঘটনার কোনোটিতে জেএমবি কোনোটিতে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম জড়িত বলে তারা নিশ্চিত হয়েছে। এ কারণে রহস্য উদ্ঘাটন দাবি করা হয়েছে। আসামিদের গ্রেপ্তার ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের পরই আদালতে চার্জশিট দেয়া হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছরের ৩রা অক্টোবর রংপুরের কাউনিয়া থানাধীন আলুটিলা গ্রামে খুন হন জাপানি নাগরিক কুনিও হোসি। এ ঘটনায় স্থানীয় বিএনপি নেতা রাশেদ-উন-নবী খান বিপ্লব, জাপানি নাগরিকের ব্যবসায়ী পার্টনার হুমায়ূন কবীর হীরাসহ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তিন দফায় ২৫ দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের পর ২৮শে অক্টোবর হুমায়ূন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন বলে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান। তবে গত ১৫ই ডিসেম্বর রংপুর রেঞ্জের তৎকালীন ডিআইজি হুমায়ূন কবীর সংবাদ সম্মেলন করে সাংবাদিকদের জানান, কুনিও হোসি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জেএমবি সদস্যরা জড়িত। ১৪ই ডিসেম্বর ইসাহাক আলী নামে এক জেএমবি সদস্য আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। স্বীকারোক্তিতে ইসাহাক উল্লেখ করেছেন, তার সরবরাহ করা পিস্তল দিয়ে জেএমবির আঞ্চলিক কমান্ডার মাসুদ রানা কুনিও হোসিকে গুলি করে হত্যা করে। ঘটনার সময় খয়বর নামে অপর এক জেএমবি সদস্যও উপস্থিত ছিল।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দুই দফায় দুজন পৃথক স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়ায় বিপাকে রয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। একারণে মামলার চার্জশিট দিতে বিলম্ব হচ্ছে। প্রথম দফায় স্বীকারোক্তি দেয়া কুনিও হোসির ব্যবসায়িক পার্টনার হুমায়ূনের স্বজনদের অভিযোগ, রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করে তার কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছিল। সংশ্লিষ্টরা জানান, রংপুরের বাহাই সম্প্রদায়ের নেতা রুহুল আমিন হত্যা, খাদেম রহমত উল্লাহ হত্যা, সৈয়দপুরের মাজারের খাদেম হত্যা, দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলার ঐতিহাসিক কান্তজিউ রাসমেলায় বোমা হামলার ঘটনা, কাহারোল ইসকন মন্দিরে বোমা হামলা মামলা, দিনাজপুরের দিপ্তী ফিলিং স্টেশনে ডাকাতি, গাইবান্ধায় হিন্দু ব্যবসায়ী শ্রী তরুণ দত্ত হত্যা, পঞ্চগড়ে মঠপ্রধান হত্যা, কুড়িগ্রামে ধর্মান্তরিত খ্রিষ্টান হোসেন আলী হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলির রহস্য উদ্ঘাটনের দাবি করা হলেও একটিরও চার্জশিট দিতে পারেনি তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। জানতে চাইলে পুলিশের রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, উত্তরাঞ্চলে যেসব ঘটনা ঘটেছে সেসব ঘটনার প্রায় বেশিরভাগেরই রহস্য উদ্ঘাটিত হয়েছে। মামলার তদন্তও প্রায় শেষ পর্যায়ে।
যে কোনো সময় এসব মামলায় আদালতে চার্জশিট দেয়া হবে। রংপুরের কুনিও হোসির হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আগে ও পরে দুই রকম স্বীকারোক্তি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই মামলাটির তদন্তে কিছুটা ঘাটতি রয়েছে। আগে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিরা জেএমবিকে অর্থ দিয়ে এই ঘটনা ঘটিয়েছে কিনা তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।