গত ২৪ এপ্রিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দ্রব্যমূল্য পর্যালোচনা কমিটির বৈঠকে ব্যবসায়ীরা রমজানে পণ্য সরবরাহ ঠিক রেখে দাম না বাড়ানোর অঙ্গীকার করেন। ওই বৈঠকে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছিলেন, রমজান মাসকে কেন্দ্র করে নিত্যপণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পণ্যবাজার স্থিতিশীল রাখার জন্য ব্যবসায়ীদের প্রতি অনুরোধ জানান তিনি। তবে বেশ কয়েকটি পণ্যের দাম এরই মধ্যে বেড়েছে। এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। আবার ঢালাওভাবে সব পণ্যের দাম বাড়েনি। বহু পণ্যের দাম স্থিতিশীল রয়েছে। গত পরশু পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রকাশিত তথ্যে দেখা গেছে, সার্বিকভাবে এপ্রিলে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে।
কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, গত দু-তিন বছর সরকার রমজানে বাজার স্থিতিশীল রাখতে কঠোর অবস্থানে ছিল। এ কারণে ব্যবসায়ীরা কৌশল পরিবর্তন করেছেন। তারা
আগেই সব পণ্যের দাম বাড়িয়ে রমজানে স্থিতিশীল রাখার পরিকল্পনা করেছেন। এ ক্ষেত্রে টিসিবিকে আরও কৌশলী ভূমিকা নিতে হবে। আগেভাগেই বাজারে পণ্য ছেড়ে বাজার দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। সরকারের উচিত আগেভাগেই বাজার মনিটরিং জোরদার করা।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন বলেন, সম্প্রতি কিছু পণ্যের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে শিগগিরই বৈঠক করা হবে। রমজানে কোনো পণ্যের দাম অস্বাভাবিক বাড়লে টিসিবির মাধ্যমে সরবরাহ করে বাজার স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা করা হবে। তিনি বলেন, দেশে সব পণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। পণ্যের দাম নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।
রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে সরেজমিনে দেখা যায়, মৌসুমের নতুন মসুর ডালের পর্যাপ্ত সরবরাহ রয়েছে। এর পরও নানা অজুহাতে অস্বাভাবিক দাম বেড়েছে। বর্তমানে প্রতি কেজি দেশি ও নেপালি ক্যাঙ্গারু মসুর ডালের দাম ১৫০ থেকে ১৫৫ টাকা। এক মাস আগে ছিল ১৩০ থেকে ১৩৫ টাকা। তবে টিসিবির মসুর ডালের কেজি ৯০ টাকা। টিসিবির সঙ্গে বাজারে বিক্রি হওয়া ডালের দামের ব্যবধান কেজিতে ৪০ টাকার বেশি।
গত মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে মসুর ডালের দাম ছিল ৬৮ থেকে ৭৩ টাকা। বছরে পৌনে চার লাখ টন মসুর ডালের চাহিদার বিপরীতে দেশে উৎপাদন হচ্ছে ২ লাখ ৬০ হাজার টন। চলতি অর্থবছরে মার্চ পর্যন্ত আমদানি হয়েছে ১ লাখ ৩৬ হাজার টন। বাড়তি মজুদ থাকার পরও দাম বাড়ানোর বিষয়টিকে অতি মুনাফার কৌশল হিসেবে মনে করছে ক্যাব। ছোলার দামও আগেভাগেই বাড়িয়ে বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৮৫ টাকা কেজি। এক মাস আগে ছিল ৭০ থেকে ৭৫ টাকা। গত মাসে ৬০ থেকে ৬১ টাকা কেজিতে ছোলা আমদানি হয়। সূত্র জানায়, ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে ছোলার দাম বাড়ানোর তথ্য পেয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ইতিমধ্যে ব্যবসায়ীদের সতর্কও করা হয়েছে; তার পরও দাম বাড়ছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ডাল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি শফি মাহমুদ দাম বাড়ানোর অভিযোগ অস্বীকার করে সমকালকে বলেন, আমদানি করা ডালের দাম বেড়েছে। এ কারণে ব্যবসায়ীরাও বাড়তি দামে বিক্রি করছেন।
চিনির দাম আবারও বাড়িয়েছেন ব্যবসায়ীরা। দেড় মাসের ব্যবধানে প্রতি কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে খোলা চিনি এখন ৫২ থেকে ৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্যাকেট চিনির দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৬ থেকে ৬০ টাকা। ব্যবসায়ীরা অবশ্য দাবি করছেন, মূসক ও শুল্ক বাড়ানোর ফলে চিনির দাম বাড়ছে। যদিও মূসক ও শুল্ক বাড়ানো হয় গত বছরের ডিসেম্বরে। তখন একদফা দাম বাড়ানো হয়েছিল। একই অজুহাতে এখন আবারও বাড়ানো হচ্ছে।
মৌসুমের নতুন পেঁয়াজ ও রসুনের পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকার পরও দাম বাড়ছে। গত দুই সপ্তাহে কেজিতে ১০ টাকা বেড়েছে। বর্তমানে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ৪৫ ও আমদানি করা ভারতীয় পেঁয়াজ ৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। চীনা রসুন পেঁৗছেছে ২০০ ও দেশি রসুন ১০০ টাকায়। এদিকে ভারতীয় পেঁয়াজ আমদানি হচ্ছে মাত্র ৮ থেকে ১০ টাকা দরে। চীনা রসুন ১৩০ থেকে ১৩৫ টাকায় আমদানি হচ্ছে। বাজারে প্রচুর পরিমাণ নতুন পেঁয়াজ ও রসুন রয়েছে। এ অবস্থায় দাম বাড়ার কথা নয়। বছরে ২২ লাখ টন পেঁয়াজের চাহিদার বিপরীতে বর্তমানে ১৭ লাখ টন পেঁয়াজ দেশে উৎপাদন হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে।
কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ী ইয়াসিন আলী বলেন, মৌসুমের পেঁয়াজ ও রসুন এখন সংরক্ষণ করা হচ্ছে। এ কারণে মোকামেই কিছুটা বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে। তা ছাড়া রমজানের আগে খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের আগাম প্রস্তুতির জন্য বাড়তি চাহিদা থাকায় বাজারেও কিছুটা দাম বেড়েছে। গত রমজানের পর থেকেই খোলা খেজুর ৮০ থেকে ২২০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছে। দুই সপ্তাহ ধরে এর দাম বেড়ে ১২০ থেকে ৩০০ টাকায় পেঁৗছেছে। প্যাকেটজাত ভালো মানের খেজুর ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বছরে ১৫ হাজার টন খেজুরের চাহিদার বিপরীতে এবার প্রায় ২০ হাজার টন আমদানি করা হয়েছে।
টিসিবির প্রস্তুতি :প্রতি বছরের মতো এবার রোজার মাসে বেশি ব্যবহার হওয়া কিছু পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নিয়েছে একমাত্র সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। রোজায় চিনি, সয়াবিন তেল, মসুর ডাল, ছোলা ও খেজুর এই পাঁচ পণ্য খোলাবাজারে ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করবে। এজন্য এসব পণ্য মজুদ শুরু করেছে সংস্থাটি। এবার রমজানের জন্য টিসিবি চিনি দেড় টন, সয়াবিন তেল ৫০০ টন, মসুর ডাল এক হাজার ১০০ টন, ছোলা দেড় হাজার টন বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে। এবার রমজানে ডিলারের পাশাপাশি সারাদেশে ১৭৪টি ট্রাকে করে পণ্য বিক্রি করবে টিসিবি। টিসিবির মুখপাত্র হুমায়ুন কবীর বলেন, রোজার মাসে সাধারণ মানুষের বাড়তি পণ্যের চাহিদা মেটাতে প্রস্তুতি নিয়েছে টিসিবি। এ সময়ে পণ্যের দাম যাতে স্বাভাবিক থাকে এ জন্য সব ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হবে।