আগৈলঝাড়ায় বানিজ্যিকভাবে কুঁচিয়া চাষ শুরু হচ্ছে : প্রকল্প বরাদ্দ ৩৬ কোটি টাকা

Slider কৃষি, পরিবেশ ও প্রকৃতি বরিশাল

mail.google.com

 

 

 

 

অপূর্ব লাল সরকার, আগৈলঝাড়া (বরিশাল) থেকে :
বরিশালের আগৈলঝাড়ায় বানিজ্যিকভাবে কুঁচিয়া চাষের উপর তিনটি স্থানে প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যেই চাষীদের প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হয়েছে এবং স্থান নির্ধারণের প্রক্রিয়া চলছে। দু’টি প্রকল্পের মাধ্যমে কুঁচিয়া ও কাঁকড়ার খামার স্থাপনের জন্য পৃথকভাবে ৩৬ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। প্রতি বছর কুঁচিয়া ও কাঁকড়া রপ্তানী করে কয়েকশ’ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেছে সরকার। ফলে সরকারও কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আয় করেছে। শুধুমাত্র আগৈলঝাড়া উপজেলা থেকে প্রতি বছরে ১০-১২ কোটি টাকার কুঁচিয়া বিদেশে রপ্তানী করা হয়। কুঁচিয়া শিকার করে এ ্উপজেলার ৫ শতাধিক পরিবার জীবিকা নির্বাহ করছে। একারণেই বরিশাল বিভাগের মধ্যে আগৈলঝাড়া উপজেলায় কুঁচিয়া চাষের জন্য প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।
কুঁচিয়া শিকারী ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত খামারীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বরিশাল জেলার আগৈলঝাড়া উপজেলার প্রায় ১৫ বছর পূর্বে কুঁচিয়া শিকার এবং বানিজ্যিকভাবে বিক্রয় শুরু হয়। এই উপজেলার সুশীল মন্ডল, জয়দেব মন্ডল, অর্জুন মন্ডল, জহর লাল মন্ডল, ভীম চন্দ্র মন্ডল ও প্রদীপ বাড়ৈ কুঁচিয়া ব্যবসা করে আসছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ আগে মাছ এবং কচ্ছপের ব্যবসা করত, কেউবা ছিল বেকার। ব্যবসার জন্য ঢাকা যাতায়াতের সূত্র ধরে যোগাযোগ হয় ঢাকার উত্তরার টঙ্গীর কামারপাড়া ও নলভোগ এলাকার অর্কিড ট্রেডিং কর্পোরেশন, আঞ্জুম ইন্টারন্যাশনাল ও গাজী এন্টারপ্রাইজসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সাথে। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কুঁচিয়া বিদেশে রপ্তানী হয়। এরা দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় কুঁচিয়া ব্যবসাকে সম্প্রসারণ করার জন্য স্থানীয় ব্যবসায়ীদেরকে দাদনে টাকা দেয়। প্রথমে কুঁচিয়া ব্যবসা শুরু হয় সুশীল মন্ডলের মাধ্যমে। বর্তমানে আগৈলঝাড়ায় ছয়জন এই ব্যবসার সাথে জড়িত। এদের মাধ্যমে কুঁচিয়া শিকারে জড়িত রয়েছে প্রায় পাঁচশ’ পরিবার।
কুঁচিয়া ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান থেকে আগৈলঝাড়ার ব্যবসায়ীরা প্রতিজনে প্রায় পাঁচ থেকে দশ লাখ করে দাদনে টাকা এনে ব্যবসা পরিচালনা করে। তারা আবার এলাকার বেকার যুবকদের মাঝে দশ থেকে ত্রিশ হাজার করে টাকা দাদন দেয় কুঁচিয়া শিকারের জন্য। আগৈলঝাড়ার কুচিয়া শিকারের সাথে স্থানীয় মানুষ ছাড়াও রয়েছে ময়মনসিংহ এলাকার যুবকরা। জীবিকার প্রয়োজনে এরা কুঁচিয়া শিকার করে। এই কাজ করে দিনমজুর মানুষগুলো আগের চেয়ে ভাল আছে। তাদের উপার্জন পূর্বের চেয়ে বেশি হয়। শিকারীরা তিনটি কৌশলে কুঁচিয়া শিকার করে। প্রথমত: গর্তের ভিতরে হাত বা লাঠি দিয়ে। দ্বিতীয়ত: গর্তের মুখে বড়শি দিয়ে এবং তৃতীয়ত: মাছ ধরা চাঁইয়ের ভিতরে খাবার দিয়ে কুঁচিয়া শিকার করে। শিকার করা কুঁচিয়া প্রতি শনিবার ছয়টি আড়তে বিক্রি করে। আড়তগুলোর মধ্যে আগৈলঝাড়া উপজেলা সদরে দু’টি, গৈলায় তিনটি এবং ঐচারমাঠে একটি। প্রতি কেজি কুঁচিয়া বিক্রি হয় আড়াইশ’ থেকে তিনশ’ টাকা দরে। সেই হিসেবে প্রতি মনের মূল্য দাঁড়ায় দশ থেকে বার হাজার টাকা। তবে এ মূল্য অনেক সময় ওঠানামা করে। আগৈলঝাড়ার এই ছয়টি আড়ৎ থেকে প্রতি সপ্তাহে ৭-৮ টন এবং মাসে ২৮-৩০ টন কুঁচিয়া ঢাকায় প্রেরণ করা হয়। যার মূল্য দাঁড়ায় ৭০ থেকে ৮০ লাখ টাকা। ঢাকার উল্লে¬খিত প্রতিষ্ঠানগুলো এই কুঁচিয়া কিনে বিদেশে রপ্তানী করে। বাংলাদেশ লাইট এন্ড জিলড ফুড এক্সপোর্ট এসোসিয়েশনের সভাপতি, আঞ্জুম ইন্টারন্যাশনালের স্বত্ত্বাধিকারী মো. শিহাব উদ্দিন মুঠোফোনে জানান, তারা বরিশালের আগৈলঝাড়া থেকে প্রতি সপ্তাহে ৭-৮ টন  কুঁচিয়া মাছ আমদানি করে। আর সারা দেশ থেকে আমদানি হয় সপ্তাহে প্রায় একশ’ টন। আমদানিকৃত কুঁচিয়ার ৯০ ভাগ রপ্তানী হয় চীনে। বাকি ১০ ভাগ রপ্তানী হয় সিঙ্গাপুর, কোরিয়া, তাইওয়ান এবং আমেরিকায়। তিনি আরও জানান, কুঁচিয়া মাছ রপ্তানী করে ২০১৪-১৫ অর্থ বছরে তিনশ’ কোটি টাকার উপরে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়েছে। এ খাত থেকে সরকার ৪৫ কোটি টাকার উপরে রাজস্ব পেয়েছে। সম্ভাবনাময় এ খাত থেকে রাজস্ব বৃদ্ধির বিষয়টি মাথায় রেখে বরিশালের দক্ষিণাঞ্চলে পাইলট প্রোগ্রাম হিসেবে কুঁচিয়া এবং কাঁকড়া চাষ এবং গবেষণা প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার।
বরিশাল জেলা মৎস্য অধিদপ্তরের জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ড. ওয়াহেদুজ্জামান জানান, আগৈলঝাড়ায় প্রাথমিকভাবে এ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। তিনটি প্রদর্শনীর জন্য স্থান নির্ধারনের কাজ চলছে। এছাড়া আরও চারটি জেলায় এ প্রকল্পের আওতায় কাঁকড়া চাষও বাস্তবায়ন করা হবে।
কুঁচিয়া ও কাঁকড়া চাষ প্রকল্প পরিচালক ড. বিনয় চক্রবর্তী জানিয়েছেন, দু’টি ধাপে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। প্রথম ধাপে মৎস্য অধিদপ্তর এবং দ্বিতীয় ধাপে স্বাদু পানি গবেষণা কেন্দ্র। ২০১৫ থেকে ২০১৮সাল পর্যন্ত এই তিনটি অর্থ বছরের জন্য প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে মৎস্য অধিদপ্তরের ২২ কোটি এবং স্বাদু পানি গবেষণা কেন্দ্রের ১৪ কোটি টাকা। তিনি আরও জানান, কুঁচিয়া চাষের জন্য বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলা এবং কাঁকড়া চাষের জন্য ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা এবং পিরোজপুর জেলা নির্ধারণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে এই প্রকল্পের আওতায় একশ’ চাষীকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে আগৈলঝাড়ার প্রদীপ বাড়ৈ, ভীম চন্দ্র মন্ডল, জহর লাল মন্ডল এবং জয়দেব মন্ডল কুঁচিয়া চাষের উপর প্রশিক্ষণ পেয়েছেন।
এব্যাপারে উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা রোজিনা আক্তার সাংবাদিকদের জানান, এলাকা জরীপ করতে গিয়ে দেখা যায় বেশ কিছু মানুষ কুঁচিয়া শিকার ও বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে। তাছাড়া এটি লাভজনক এবং রপ্তানীযোগ্য। তাই তিনি জেলা মৎস্য কর্মকর্তার সঙ্গে পরামর্শ করে প্রকল্পটি বাস্তবানের জন্য আগৈলঝাড়া উপজেলাকে সুপারিশ করেন। তিনি আরও জানান, মাঠ পর্যায়ে কুঁচিয়া চাষ প্রদর্শনীর জন্য এ পর্যন্ত আগৈলঝাড়ার দু’টি স্থান নির্ধারণ এবং দু’টি দল গঠন করা হয়েছে। তার মধ্যে বাকাল চ্যাটার্জী বাড়ি এবং রাজিহারে একটি করে। যারা কুঁচিয়া শিকার করে তাদের মধ্য থেকে প্রতিটি দলে ১০ জন করে নেয়া হয়েছে। এখনও একটি স্থান নির্ধারণ বাকি আছে। পর্যায়ক্রমে সেটিও নির্ধারণ করা হবে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে প্রধান করে যে কমিটি গঠন করা হয়েছে, সেই কমিটির অনুমোদনের পরই কার্যক্রম শুরু হবে।
উপজেলার গৈলা গ্রামের সুশীল চন্দ্র মন্ডল জানান, আগে আমি মাছ এবং কচ্ছপের ব্যবসা করতাম। বর্তমানে কুচিয়ার ব্যবসা করে ভালো আছি। জয়দেব মন্ডল জানান কুঁচিয়া শিকারের সাথে জড়িতদের উপার্জন ভাল এবং তারা স্বাচ্ছন্দে আছেন। সরকার যদি এই খাতে আমাদের সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করত তাহলে দাদন ব্যবসায়ীদের হাতে জিম্মি থাকতে হতনা। তাহলে এ ব্যবসা আরও প্রসার লাভ করায় সরকার আরও বেশি রাজস্ব আয় করতে পারত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *