গণতন্ত্রের ডায়েরী: ওই যে প্রার্থীর গাড়ি! টাকা দিয়ে যান!

Slider টপ নিউজ সম্পাদকীয়

ছবিঃ প্রতীকি

ঢাকা: ভোট আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। জনগনের ভোটে সরকার হয়। জাতীয় সরকার ও স্থানীয় সরকার। জনগন ভালো মানুষ নির্বাচিত করে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব দিবে এটার জন্যই ভোট। যারা একবার ভোটে পাশ করে ভালো কাজ করবে না, তাদের আরেকবার ভোট না দিয়ে অন্য ভালো মানুষ খোঁজে ভোট দিবে জনগন। রাষ্ট্র ও জনগনের দায়িত্ব হল একটি সুন্দর সরকার গঠনপূর্বক রাষ্ট্র ও জনগনকে নিরাপদ রাখা, উন্নত করা। রাষ্ট্রের মালিক জনগন যেন কোন সময় অনিরাপদ ও হতাশ না হয় সেদিকে খেয়াল রাখবে সরকার ও সরকারের জনপ্রতিনিধিরা। কিন্তু রাষ্ট্র ও জনগন যার যার অবস্থান থেকে সরে গিয়েছে। ভোট লুটের জন্য দায়ী রাষ্ট্র ও সরকার যেমন সত্য, তেমনি ভোট দিতে না পারা বা না জানার অজ্ঞতাও দায়ী কম নয়। ভোট আসলেই জনগনের ভিন্ন রুপের বহি:প্রকাশ ঘটে। কিছু লোক বিভিন্ন প্রার্থীর পক্ষে অবস্থান নিয়ে নিজেদের মধ্যে যেমন উত্তেজনা তৈরী করে আবার কোন কোন ক্ষেত্রে আইন শৃঙ্খলারও অবনতি ঘটায়। ভোটারদের মধ্যে মারামারির ফলে রক্তপাত হয়, খুনু-খুনী হয়, আবার জেল জুলুমও হয়। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর ভোট ম্যানোপুলেশনের পাশাপাশি ভোটাররাও পরিস্থিতির তৈরী কম করেন না। সব কিছু মিলিয়ে ভোট এখন লুটের অধিক্ষেত্র হয়ে গেছে এতে আর সন্দেহ রইল না। এর জন্য রাষ্ট্র যেমন দায়ী তেমনি জনগনও দায় এড়াতে পারে না।

সরেজিমন দেখা যায় ভোটের ভিন্ন ভিন্ন চিত্র। ভোট আসলেই ভোটাররা প্রার্থীদের পক্ষ নেয়। শুরু করে ভোটের উৎসব। এই উৎসবে কালো টাকার প্রভাব আর বেয়াদবীর গুরুত্ব বেশী। কারণ যে প্রার্থী যতবেশী শক্তি প্রদর্শন করতে পারবেন সেই প্রার্থীর পক্ষে ভোটাররা শক্ত অবস্থান নেন। যে প্রার্থীর কালো টাকা বেশী ভোটাররা সে দিকে ঝুঁকে পড়েন। যে প্রার্থী নিরাপত্তা হুমকি তৈরী করতে পারেন সে প্রার্থীর পাল্লা ভারী। যে প্রার্থী রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রন রাখেন সে প্রার্থীরও পাল্লা ভারী হয়ে যায়। ভোটাররা প্রার্থী নির্বাচনে আবেগকে বেশী গুরুত্ব দেয়। প্রার্থী ভালো না মন্দ মানুষ সেটা দেখার সুযোগ নেই ভোটারদের।

মাঠে ঘুরে দেখা গেছে, যে সকল প্রার্থী সামাজিকভাবে বেশী ঝামেলা বুঝেন তাদের পাল্লা ভারী হয়ে যায়। স্থানীয় সরকারে ভিলেজ পলিটিক্স মারাত্বকভাবে কাজ করে। একজন ভোটার গোপনে গোপনে একাধিক প্রার্থীর লোক সেজে থাকেন। জনপ্রতিনিধি হয়ে যারা বেশী অনৈতিক সুবিধা দিতে পারবেন তাদের পাল্লা ভারী হয়ে যায়। জমি দখল, চাাঁদাবাজী, মানুষকে নির্যাতন করে টাকা আদায়, অবৈধভাবে ব্যবসা বানিজ্য সহ সব মিলিয়ে অনৈতিক সুবিধা যারা দিতে পারবেন ভোটের মাঠে তাদের জনপ্রিয়তা বেশী। এসব ছাড়া যারা জনপ্রিতিনিধি হলে খারাপ লোক মূল্যায়িত হবে তাদের দলে খারাপ লোকের ভীড় বেশী। জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে যে যোগ্যতা প্রার্থীর জন্য জরুরী তা হলো পাশ করে ওই প্রার্থী কতটুকু শক্ত হাতে সেবা নয়, সমাজ শাষন করতে পারবেন এবং অনৈতিক কর্মকান্ড করে বেশী বেশী অনৈতিক সুবিধা বেশী দিতে পারবেন। যে প্রার্থী বেশী টাকা খরচ করতে পারবেন সে বেশী যোগ্য, এই যোগ্যতাটা এখন প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে। কিন্তু জনপ্রতিনিধি হয়ে বিপুল অংকের টাকা কি ভাবে উঠাবেন, সেই ভাবনা ভোটারদের নেই। এখানে যে ভোটার টাকা নিয়ে ভোট দিচ্ছেন বা পক্ষ নিচ্ছেন, সেই ভোটারকেই অনেক বেশী টাকা দেয়া লাগতে পারে তার ভুরি ভুরি উদাহরণ থাকলেও মানুষ বড্ড আবেগী। সামনে দেখে কিন্তু আগে-পরে বুঝে না। এই অসম ও বিপদজ্জনক আবেগ নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করে গনতন্ত্রের ১২টা বাজিয়ে দিয়েছে। রাষ্ট্র নিজের পছন্দমত লোককে পাশ করানোর জন্য ভোট যেমন লুট করে, তেমনি জনগন মূল্যবান ভোট আবেগী হয়ে বিপদের দিকে ঠেলে দেয় এতেও আর সন্দেহ রইল না। ভোট আসলে টাকা আর টাকা। প্রার্থী চায়ের ষ্টলে বসলেই চা শুরু হয়। একশ টাকার চা খেলে এক হাজার টাকার বিল রাখা হয়। নির্বাচন আসলে চিকিৎসার টাকা, লেখাপড়ার টাকা, মসজিদ মাদ্রাসার উন্নয়ন, ওয়াজ মাহফিল, খেলাধূলা সহ বিভিন্ন উৎসব যেন এক যোগে শুরু হয়ে যায়। এমনো দেখা গেছে, কোন প্রার্থীর গাড়ি যাওয়ার সময় পিছন থেকে বলতে শুনা যায়, ওই যে প্রার্থীর গাড়ি, চলো টাকা নিয়ে আসি। গাড়ির পিছনে দৌড়াতে দৌড়াতে ভোটাররা বলছেন, ভাই ভোট দেব, কিছু টাকা দিয়ে যান। এই হল ভোটারদের একটি বৈশিষ্ঠ্য।

ডায়েরীতে জমানো কথার মধ্যে আছে, নির্বাচন আসলে একটি চক্র সক্রিয় হয়ে যায়। নেতার আবরণে ভালো মানুষের মুখোশ পড়ে এরা মারাত্বক অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। নিজের প্রভাব ও প্রতিপত্তিকে পুঁজি করে তারা অসম খেলায় মেতে উঠে। কেন্দ্রে পাশ করার কথা বলে এই চক্র প্রার্থীদের নিকট থেকে বড় অংকের টাকা আদায় করে। ভোটাররা তাদের কথা শুনবে কি না, তা তাদের জানা না থাকলেও তাদের টাকা দিলেই তাদের কেন্দ্রে পাশ, এই ব্যবসায় নেমে পড়েন তারা। কিছু রাজনৈতিক নেতা দলের আদর্শ বা নিজের নীতি নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে একজন প্রতারক ভোটার বা ভোটারের দালাল সেজে যায়। এই চক্র টাকার জন্য সব কাজ করতে পারেন এমন অনেক উদাহরণ বিদ্যমান। যারা ভোট লুটে তারাও কিন্তু ভোটার। তাহলে ভোটার সচেতন থাকলে ভোট লুটার মানুষ পাওয়া যাবে না, এটাও অস্বীকার করা ঠিক না।

পরিশেষে বলতে হয়, শুধু রাষ্ট্রের দোষ নয়, ভোটারদেরও দায় আছে ভোট লুট ও প্রহসনের নির্বাচনে। কারণ রাষ্ট্র যদি ভুল সিদ্ধান্ত নেয় তবে ভালো প্রার্থী বাছাই করলে জনগনও রাষ্ট্রের ভুল পদক্ষেপ সামাল দিতে সক্ষম হবে। কারণ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যতগুলো রাষ্ট্রীয় পরিবর্তন হয়েছে তার প্রায় অনেকগুলোই গণআন্দোলনের মাধ্যমে সঠিক ইস্যুর উপর দাঁড়িয়ে সফল হয়েছে। তাই বলা যায়, সাধারণ মানুষ যতক্ষন না সচেতন হয়ে নৈতিক দাবী নিয়ে রাজপথে না আসবে, ততক্ষন একটি রাষ্ট্র সঠিক পথে চলবে এমন আশা কোন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য কাম্য নয়। কাজেই নিজেরা ক্ষেত্র তৈরী করে হায়-হুতাশ করলে করা যাবে এবং সেটা হবে নাটক বা সিনেমার মত কোন কনটেন্ট। সুন্দর সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে বাস্তবে তার কোন প্রভাব পড়বে না। মানুষ যতদিন না নির্লোভভাবে তাদের সেবক নির্বাচিত করতে সক্ষম হবে এবং ভোট বিক্রি করা থেকে মুখ ফিরিয়ে না নিবে, ততদিন পর্যন্ত ভোট লুটের ইতিহাস মুছে যাবে এমন আশা করা মুশকিল।

রিপন আনসারী
সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *