ঢাকা : বিএনপির ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলকে ঘিরে নানা মেরুকরণ শুরু হয়েছে। নেতা-কর্মীদের মাঝে উৎসবের আমেজ বিরাজ করলেও বাদ পড়ার আশঙ্কায়ও রয়েছেন অনেকে। বেগম খালেদা জিয়া বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পুনরায় দলের চেয়ারপারসন নির্বাচিত হচ্ছেন, এটা নিয়ে নেতা-কর্মীরা নিশ্চিত। তারেক রহমানও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান থাকছেন। তবে নানা সমীকরণ চলছে দলের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ মহাসচিব পদ নিয়ে।
সূত্র মতে, বিএনপির সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটিতে সংযোজন-বিয়োজন ঘটবে। পাশাপাশি দলে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব পদ নিয়ে হতে পারে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা। তবে ছোট হতে পারে নির্বাহী কমিটির কলেবর। বর্তমানে আলোচিত ‘এক নেতার এক পদ’র বিষয়টি বাস্তবায়িত হলে অনেকের ঝরে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া নিষ্ক্রিয়তার কারণেও বাদ পড়তে পারেন অনেকে। দুটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের বিষয়ে আলোচনা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা বাস্তবায়িত হচ্ছে না। গঠনতন্ত্র সংশোধনের মাধ্যমে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদ দলের উপদেষ্টা পরিষদে রূপান্তরিত হতে পারে। স্থায়ী কমিটি থেকে বাদ পড়া সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করা হতে পারে ওই উপদেষ্টা পরিষদে। সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের পদ বাতিল করে ‘কো-চেয়ারম্যানের পদ’ সৃষ্টির আলোচনা হলেও বাস্তবায়িত হচ্ছে না তা-ও।
এদিকে, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সর্বশেষ বৈঠকে আলোচিত ‘এক নেতার এক পদ’র প্রস্তাব নিয়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে। দলীয় স্বার্থেই চেয়ারপারসন এ বিষয়টি বাস্তবায়ন করবেন, এমন প্রত্যাশা তাদের। দলের বেশিরভাগ নেতাই কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে একাধিক পদের অধিকারী।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘‘এক নেতা একাধিক পদে থাকলে সব কুক্ষিগত হয়ে যায়। ফলে অন্যদের জন্য তেমন সুযোগ থাকে না। তাই ‘এক নেতার এক পদ’র ব্যাপারটিকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে। এ ব্যাপারে কাউন্সিলে ‘ইতিবাচক’ সিদ্ধান্ত আসতে পারে।’’
কমিটির কলেবর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আশা করছি, কাজ করার সুবিধার্থে বিএনপির আগামী কমিটির কলেবর ছোট হবে। কারণ, বড় কলেবরের কমিটিতে অধিকাংশ নেতাই নিষ্ক্রিয় হয়ে যান।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির শূন্যপদ, বয়সজনিত কারণ ও নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগে কিছু নেতার স্থায়ী কমিটি থেকে বাদ পড়ার আশঙ্কা এবং শূন্যপদে অন্তর্ভুক্তি নিয়েও চলছে নানা সমীকরণ। খন্দকার দেলোয়ার হোসেন ও ড. আর এ গণির মৃত্যু এবং সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসি হওয়ায় ১৮ সদস্যবিশিষ্ট স্থায়ী কমিটিতে তিনটি পদ শূন্য হয়েছে। বয়সজনিত কারণে কমিটি থেকে বাদ পড়তে পারেন এম শামসুল ইসলাম ও বেগম সারোয়ারি রহমান। এছাড়া গত প্রায় এক বছর দলের কোনো কর্মসূচিতে না থাকা ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়াও বাদ পড়তে পারেন স্থায়ী কমিটি থেকে।
স্থায়ী কমিটির এসব শূন্যস্থান পূরণে সর্বাধিক আলোচনায় রয়েছেন-বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, আব্দুল্লাহ আল নোমান, বেগম সেলিমা রহমান ও সাদেক হোসেন খোকা; চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ড. ওসমান ফারুক ও অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন।
এছাড়া স্থায়ী কমিটিতে দলের ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম ও এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরী; চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আব্দুল আউয়াল মিন্টু ও শামসুজ্জামান দুদুর নামও আলোচিত হচ্ছে।
বিএনপিকে গতিশীল করতে দলের একটি অংশ চাচ্ছে, সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী ফোরামে তরুণ নেতৃত্ব আসুক। সেক্ষেত্রে তরুণ নেতাদের মধ্যে স্থায়ী কমিটিতে সর্বাধিক আলোচনায় রয়েছেন বর্তমান দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী আহমেদ। এছাড়া যুগ্ম মহাসচিব আমান উল্লাহ আমান, মো. শাহজাহান ও সালাহউদ্দিন আহমেদের নামও আলোচিত হচ্ছে। তবে এদেরকে ‘সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব’ পদেও অধিষ্ঠিত করার কথা ভাবা হচ্ছে।
মহাসচিব পদে দলীয় প্রধানের আনুগত্য ও জনপ্রিয়তার দৌঁড়ে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছেন বর্তমান ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এ কারণে কৌশলী অবস্থান নিয়েছেন বাকিরা। তাদের কেউ প্রকাশ্যে নিজেদের প্রার্থিতা ঘোষণা না করলেও চেয়ারপারসন দায়িত্ব দিলে তা গ্রহণে প্রস্তুত।
২০১১ সালে বিএনপির দুঃসময়ের কাণ্ডারিখ্যাত খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের মৃত্যুর পর থেকেই সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ‘ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তবে ওই সময়টিতে ‘ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব হিসেবে’ অনেক সিনিয়র নেতাই তাকে মেনে নেননি, এমনকি তারা বাড়াননি সহযোগিতার হাতও।
রাজনীতিতে স্বচ্ছ, পরিচ্ছন্ন ও সুবক্তা হিসেবে পরিচিত মির্জা ফখরুলের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত ৮৪টি মামলা দায়ের করেছে সরকার। এসব মামলায় তিনি কারাগারে গিয়েছেন সাতবার। বিএনপিতে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের পরই জনপ্রিয়তার শীর্ষে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব। এছাড়া দলের নেতা-কর্মীদের বাইরেও দেশি-বিদেশি কূটনীতিক, গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ, অন্যান্য রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছেও মির্জা ফখরুলের গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। বিএনপির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতা তারেক রহমানের গুডবুকেও তিনি রয়েছেন বলে জানা যায়।
সদ্য কারামুক্ত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনেরও দীর্ঘদিনের স্বপ্ন দলের মহাসচিব হওয়ার। বিএনপির বহিষ্কৃত প্রয়াত মহাসচিব আব্দুল মান্নান ভুইয়ার সময় থেকেই মহাসচিব পদে শক্তিশালী প্রার্থী তিনি। তবে মোশাররফের পক্ষে তার সমর্থকরা তেমন জোরালো যুক্তি উপস্থাপন করতে পারেন না।
দলের একটি শক্তিশালী অংশ মনে করে, বর্তমান আন্তর্জাতিক ও আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় একজন পোড়খাওয়া ও অভিজ্ঞ নেতাকেই মহাসচিবের দায়িত্ব দেয়া প্রয়োজন, যিনি দলের ‘টপ টু বটম’ সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার পাশাপাশি দলীয় প্রয়োজনে তাদেরকে নিয়ন্ত্রণও করতে পারবেন। আর সেক্ষেত্রে দলের সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য ও আলোচিত নাম হচ্ছে তরিকুল ইসলাম। বিএনপির নানা সঙ্কটময় মুহূর্তে তিনি দলীয় প্রধানের প্রদত্ত দায়িত্ব সফলতার সঙ্গে পালন করেছেন। তবে তিনি কখনোই নিজ থেকে দলের মহাসচিবের দায়িত্ব নিতে আগ্রহ দেখাননি। দলের চেয়ারপারসন বিভিন্ন সময় ‘দায়িত্ব’ দিতে চাইলেও বিনয়ের সঙ্গে তা এড়িয়ে গেছেন। দলের জন্য অন্তঃপ্রাণ প্রবীণ এই রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধেও রয়েছে বেশ কয়েকটি মামলা। উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে এখন কিছুটা প্রকাশ্যে তিনি। বর্তমান সঙ্কটময় মুহূর্তে দলকে সংগঠিত করতে চেয়ারপারসন দায়িত্ব দিলে তা গ্রহণে তরিকুল প্রস্তুত বলে তার ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা যায়।
মহাসচিব পদে স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে ঘিরেও তৈরি হয়েছে আরেকটি বলয়। দলের প্রতি আনুগত্য, জেল-জুলুম ও সর্বশেষ তার সভাপতিত্বে মহাসমাবেশ সফল হওয়ায় গয়েশ্বরও খালেদা জিয়ার গুলবুকে রয়েছেন বলে জানা যায়। চেয়ারপারসন দায়িত্ব দিলে তা পালনে প্রস্তুত গয়েশ্বরও।
এ প্রসঙ্গে গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘মহাসচিব হিসেবে নেত্রী (খালেদা) যাকে উপযুক্ত মনে করবেন তাকেই দায়িত্ব দিবেন। আমি এখন যেখানে (স্থায়ী কমিটি) আছি, সেটাও তো অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তবে মহাসচিবের দায়িত্ব দিলে আমি তা পালন করতে পারব না, বিষয়টি মোটেই এমন নয়।’
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব পদেও আসতে পারে নানা পরিবর্তন, অন্তর্ভুক্ত হতে পারে এক ঝাঁক তরুণ। এর মধ্যে আলোচিত নামগুলো হচ্ছে-ড. আসাদুজ্জামান রিপন, অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, হাবিবুর রহমান হাবিব, গোলাম আকবর খন্দকার, রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, খায়রুল কবির খোকন ও হাবিব-উন-নবী খান সোহেল।
জানতে চাইলে লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘দলে দীর্ঘদিন ধরে অনেকেই নিষ্ক্রিয় রয়েছেন, আগামী কমিটিতে তারা ঝরে পড়বেন-এটিই স্বাভাবিক। একইসঙ্গে আমি আশা করছি- সক্রিয়, ত্যাগী, প্রজ্ঞাবান ও দলের প্রতি অনুগতদের কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।’
প্রসঙ্গত, ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় বিএনপির পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিল। সর্বশেষ ওই কাউন্সিলে দলটির গঠনতন্ত্রে বেশকিছু পরিবর্তন আনা হয়। নির্বাহী কমিটির সদস্য ২৫১ থেকে বাড়িয়ে ৩৮৬ করা হয়। এছাড়া ‘সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান’ নামে নতুন পদ সৃষ্টি করা হয়। বিএনপির গঠনতন্ত্রে প্রতি তিন বছর পরপর কাউন্সিল করার বিধান রয়েছে।