গ্রাম বাংলা ডেস্ক: প্রকৃতির নিয়মে বর্ষা শেষে শরতে ফোটে শেফালি ফুল। কিন্তু সুবাস ছড়ানো এই ফুলটি এখন জ্যেষ্ঠ মাসেও ফুটছে! তা-ও আবার রাজধানী ঢাকার বুকে, মগবাজার এলাকায়। তেমনি বর্ষার কদমও ফুটছে মাঘ মাসে!
অবাক হওয়ার কিছু নেই। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসের বৃষ্টি ঝরানো বর্ষাকালের চিরাচরিত রূপ বদলে ফেলাতেই এমন সব ঘটনা ঘটছে।
বৃষ্টির হিসাব গোলমেলে: আসলে বর্ষা ঋতু তার চরিত্র-রূপ-বৈশিষ্ট্য সবই বদলাতে শুরু করেছে প্রায় সাত-আট বছর আগে থেকে। আষাঢ়-শ্রাবণে অবিরাম বৃষ্টি এখন বলতে গেলে স্মৃতি। বর্ষার বৃষ্টি যেন কেড়ে নিয়েছে জ্যৈষ্ঠ, হেমন্তের কার্তিক কখনো বা শীতের মাঘ মাস। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রকৃতির এই রূপ বদলেই এখন অসময়ে ফুটছে শিউলি আর কদমফুল। আর এই রূপবদল মানুষের জন্য কোনো সুখবর বয়ে আনবে না।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশে বর্ষাকাল শুরুর আগে কখনো বৃষ্টি হচ্ছে। কখনো বর্ষার পর বৃষ্টি হচ্ছে। আষাঢ়-শ্রাবণের সেই মুষলধারার বৃষ্টি এখন আর নেই। বর্ষাকালে বৃষ্টির পরিমাণও কমে গেছে। এতটাই কমেছে যে, সেটি স্বাভাবিকের চাইতে গড়ে প্রায় ২৫ ভাগ কম।
বাংলাদেশে জুনের মাঝামাঝি সময় থেকে শুরু হয় আষাঢ় মাস, আর শ্রাবণ শেষ হয় আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে। কিন্তু ২০১৩ সালের জুন মাসে আবহাওয়া অধিদপ্তরের প্রত্যাশার চেয়ে বৃষ্টি হয়েছে ১৩ দশমিক ৪ ভাগ কম। পুরো বাংলাদেশে তখন ১৫ হাজার ৬১৯ মিলিমিটারের চেয়ে দু হাজার ১০০ মিলিমিটার কম বৃষ্টি ঝরেছে। অথচ একই বছরের অক্টোবরে (মধ্য আশ্বিন-কার্তিক) ৪৬ দশমিক ১ ভাগ বেশি বৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশে।
২০১৪ সালে জুলাই মাসের বৃষ্টির হিসাব তো আরও কম। ওই মাসে আবহাওয়া অধিদপ্তরের আশা ছিল, বাংলাদেশে ১৭ হাজার ৭৮৪ মিলিমিটার বৃষ্টি হবে। সে জায়গায় বৃষ্টি হয়েছে ১২ হাজার ৪৯৮ মিলিমিটার। অর্থাত্, স্বাভাবিক বৃষ্টির চেয়ে ৫ হাজার ২৮৬ মিলিমিটার বা ২৯ দশমিক ৭ ভাগ কম।
এর আগে এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে (বাংলায় মাঘ-ফাল্গুন) আশার চেয়ে ৪ দশমিক ৩ ভাগ বেশি বৃষ্টি হয়েছে। তবে বছরের অন্যান্য মাসে প্রত্যাশার ধারেকাছে যাওয়ার মতোও বৃষ্টি হয়নি। গত জুনে (মধ্য জ্যৈষ্ঠ থেকে মধ্য আষাঢ়) লঘুচাপের প্রভাবে ১৮ দশমিক ৪ ভাগ বেশি বৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু ভরা বর্ষাকাল মধ্য আষাঢ় থেকে মধ্য শ্রাবণ, অর্থাত্ এ বছরের জুলাই মাসে প্রায় ৩৪ ভাগ বৃষ্টি কম হয়েছে, যা ২০১৩ সালের চেয়ে ৪ ভাগ কম।
তবে বৃষ্টি কম-বেশি হওয়ার ধকলে কেবল বাংলাদেশ নয়, প্রতিবেশী ভারতও ভুগছে। মৌসুমি বায়ু আগের মতো সক্রিয় না থাকায় ভারতের পাঞ্জাব, উত্তর প্রদেশ, হরিয়ানা, রাজস্থান এবং জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যে এ বছর স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় অর্ধেক বৃষ্টি হয়েছে। ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তর আশঙ্কা করছে, এবারের বর্ষাকালে স্বাভাবিকের চেয়ে সাত ভাগ কম বৃষ্টি হতে পারে। কারণ, গত জুন মাসে দেশটিতে ৪৩ ভাগ কম বৃষ্টি হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক শাহ আলম অবশ্য বৃষ্টি কম-বেশির কারণে লাভ-ক্ষতি দুটিই হতে পারে বলে মনে করছেন। তিনি জানান, এ বছরের জুলাই মাসে বৃষ্টি স্বাভাবিকের চেয়ে কম হয়েছে। কিন্তু আগস্ট মাসে বৃষ্টি বেশিই হবে।
শাহ আলম বলেন, ‘বর্ষাকালে বৃষ্টি কম হওয়ায় বন্যা হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে, তেমনি আবার পাটের মতো ফসল উত্পাদনে ক্ষতি হতে পারে। তাই বলা যায়, বৃষ্টি কম-বেশির জন্য লাভ-ক্ষতি দুটিই হতে পারে।’
কেন বর্ষাকালে বৃষ্টি কম: বর্ষাকালে কম বৃষ্টির জন্য জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বৈশ্বিক উষ্ণতাকে প্রধান কারণ বলে মনে করছেন। আইনুন নিশাতের মতে, পৃথিবীতে বৃষ্টি কমেনি। তবে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বিশ্বের কোথাও কমেছে, আবার কোথাও বৃদ্ধি পেয়েছে। যেসব জায়গায় আগে বৃষ্টি একেবারেই হতো না, সেখানে এখন বৃষ্টি হচ্ছে।
আইনুন নিশাত বলেন, ‘মৌসুমি বায়ু এখন বঙ্গোপসাগরের চেয়ে আরব সাগরের ওপর বেশি সক্রিয়। তাই পাকিস্তানের করাচি, সৌদি আরবে বৃষ্টি-বন্যা হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এমনটি হচ্ছে। আমরা সচেতন না হলেও প্রকৃতিই প্রতিশোধ নিয়ে আগের রূপে ফিরে যেতে চাইবে।’