সুনামগঞ্জ: ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা, যমের দুয়ারে পড়লো কাঁটা, যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা, আমি দেই আমার ভাইকে ফোঁটা…। বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। ভাইফোঁটা তারই একটা অংশ। তবে ভাইফোঁটা কোনো প্রচলিত পূজা নয়। ভাইয়ের মঙ্গল কামনায় ঈশ্বরের কাছে বোনের আকুতি, ভাইয়ের সাফল্য, দীর্ঘায়ু লাভের জন্য বোনের প্রার্থণাই ‘ভাইফোঁটা’ হিসেবে উদযাপন করা হয়।
প্রথা অনুযায়ী শুক্লাতিথির দ্বিতীয়াতে ভাইফোঁটা উদযাপিত হয়। প্রয়োজনে পরবর্তী সাতদিন ভাইফোঁটা উদযাপণ করা যায়। পঞ্জিকার হিসেব মতে কালীপূজার দুই দিন পরে ভাইফোঁটা অনুষ্ঠিত হয়। ভাইফোঁটার ধর্মীয় গুরুত্ব অপেক্ষা সামাজিক ও পারিবারিক গুরুত্ব অনেক বেশি, যেখানে ভাই-বোনের মধ্যেকার প্রীতি ও ভালোবাসার স্বর্গীয় সম্পর্কটিই মুখ্য। ভাইবোন দুজনেই বছরের এই একটি দিনের অপেক্ষায় থাকে।
বোন যতো দুরেই থাকুক না কেনো, যতো প্রয়োজনীয় কাজ থাকুক না কেনো শত বাধা বিপত্তি ঠেলে ছুটে আসে ভাইয়ের কপালে ফোঁটা দিতে। আর ভাইও অধির আগ্রহের সঙ্গে অপেক্ষা করে বোনের জন্য।
সামনে থালা। ফুল আর মিষ্টি দিয়ে সাজানো। কাঁসা বা পিতলের থালায় ধান-দুর্বা, ঘরে আমপাতায় পারা কাজল, চন্দন। সঙ্গে থাকে ঘিয়ের প্রদীপ আর শাঁখ। ভাইকে বসতে দেয়া হয় নকশিকাঁথার কাজ করা সুতির আসনে। বোন বাঁ হাতের কড়ে আঙুলে কাজল নিয়ে এঁকে দেয় ভাইয়ের ভ্রু-যুগল। আর পুরো প্রাঙ্গণজুড়ে ভেসে বেড়াচ্ছিল গানের সেই সুর ‘ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা,যমের দুয়ারে পড়লো কাঁটা,যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা, আমি দেই আমার ভাইকে ফোঁটা…।’
সম্প্রতি সন্ধ্যায় সুনামগঞ্জ শহরের রামকৃষ্ণ আশ্রমে ভাই ফোঁটা উৎসবে সমবেত হয়েছিলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা। অনুষ্ঠানে ৫০ জন বোন তাদের ভাইয়ের কপালে ফোঁটা দিয়ে মঙ্গল কামনা করেন। ভাইয়ের সকল আপদ বিদায় হয়ে যেতে প্রার্থনা করেন।
হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মানব সভ্যতার ইতিহাসের সঙ্গে সংস্কৃতির রয়েছে অদৃশ্য যোগসূত্র। সেই ধারায় অনেক আচার-অনুষ্ঠান শতাব্দীর পর শতাব্দী পালিত হয়ে আসছে নিয়মনিষ্ঠার সঙ্গে। এমনই একটি সংস্কার ‘ভাই ফোঁটা’। এর পোশাকি নাম ‘ভাতৃদ্বিতীয়া’। প্রতি বাংলা বছরের কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে পালিত হয়ে আসছে এ অনুষ্ঠান। এ দিন ভাইয়ের মঙ্গল কামনায় তার কপালে ফোঁটা দেন বোন।
ভাই ফোঁটা নিয়ে রয়েছে অনেক গল্প-কাহিনী। শোনা যায়- মৃত্যুদূত যম ও যমুনা যমজ ভাইবোন। সূর্যের ঔরসে জন্ম তাদের। বড় হওয়ার পর দুজনে আলাদা হয়ে যান। থাকতেন পরস্পর থেকে অনেক দুরে। লম্বা সময়ের ব্যবধানে যমুনার খুব ইচ্ছে হলো ভাইকে দেখতে। বার্তা পাঠালেন তাকে। বোনের নিমন্ত্রণে যমরাজকে আসতেই হলো। যথাসাধ্য আপ্যায়ন করলেন যমুনা। ফেরার সময় আবারও আসার প্রতিশ্রুতি দিলেন যম। তখন খুশিতে ভাইকে আর্শীবাদ করে টিকা পরিয়ে দিলেন কপালে। সেই থেকেই নাকি ভাই ফোঁটার প্রচলন।
আবার কথিত আছে, নরকাসুর নামের এক দৈত্য বধের পর কৃষ্ণ ফিরে এসেছেন বোন সুভদ্রার কাছে। তখন তাকে কপালে ফোঁটা দিয়ে মিষ্টি খেতে দেন সুভদ্রা। অনেকে মনে করেন, ভাই ফোঁটার শুরু এর মধ্য দিয়েই।
যম-যমুনা বা কৃষ্ণ-সুভদ্রা, যাদের দ্বারাই এ অনুষ্ঠানের প্রচলন হোক না কেন, আজো তা বজায় রয়েছে। হিন্দু ধর্মাবলম্বী ভাইবোনের মধ্যে পবিত্র সম্পর্কের বার্তাকে আরও সুদৃঢ় করে এ রীতি।