৫ আগস্ট, দিনটি হয়তো ভুলে যেতে চায় আওয়ামী লীগ। টানা চারবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসা দলটিকে এ দিনে বিদায় নিতে হয় করুণভাবে। আওয়ামী লীগের সভাপতি ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। দলের শীর্ষ নেতারা চলে যান আত্মগোপনে। কেউ কেউ বিদেশে আশ্রয় নেন। অন্যদিকে, তৃণমূলের নেতাকর্মীরা হয় ধরা পড়েন, না হয় নির্যাতনের শিকার হন।
ফলে দলটির মধ্যে তৈরি হয় রাজনৈতিক শূন্যতা। ছেদ পড়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে। এ কারণে ২০২৪ সালকে বলা যায় আওয়ামী লীগের জন্য অন্ধকারময় বছর। বছরটি পার হয়েছে, এসেছে নতুন বছর। নতুন বছরে দেশবিরোধী অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করার অঙ্গীকার করেছে দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দলটি। তারা বলছে, শুভ ও কল্যাণময় সময় প্রতিষ্ঠা করতে তারা নতুন করে নিজেদের আত্মনিয়োগ করবে। পাশাপাশি বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর সমর্থন চাওয়া হবে।
দলটির একাধিক সূত্র বলছে, ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে একের পর এক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে হাজার হাজার নেতাকর্মীকে। আজগুবি দুর্নীতির তথ্য ফাঁস করা হচ্ছে শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দের। আওয়ামী লীগের টুঁটি চেপে ধরতে এমন কোনো কাজ নেই, যা করছে না বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। গঠন করা হয়েছে গুম কমিশন। আওয়ামী লীগ সরকারের গুম-খুন-দুর্নীতি নিয়ে জনমত তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে।
নতুন বছরে দেশবিরোধী অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করার অঙ্গীকার করেছে দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দলটি। তারা বলছে, শুভ ও কল্যাণময় সময় প্রতিষ্ঠা করতে তারা নতুন করে নিজেদের আত্মনিয়োগ করবে। পাশাপাশি বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর সমর্থন চাওয়া হবে
ইতোমধ্যে নিষিদ্ধ করা হয়েছে আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে। সবমিলিয়ে আওয়ামী লীগকে পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় করতে সব ধরনের তৎপরতা চালানো হচ্ছে। দলটির নেতারা বলছেন, নতুন বছরে তারাও সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা ও ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে নতুন আঙ্গিকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করতে চান। এজন্য নেওয়া হচ্ছে বিশেষ পরিকল্পনা ও উদ্যোগ। যেগুলো তৃণমূলের নেতাকর্মীদের নতুন করে উজ্জীবিত করবে, পাশাপাশি আওয়ামী লীগের হারিয়ে যাওয়া জনসমর্থন নতুন করে ফিরে পেতে সহায়ক হবে।
আওয়ামী লীগের এক সিনিয়র নেতা এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘বিশ্বায়নের এ যুগে ছোট দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে পরাশক্তিগুলো। আওয়ামী লীগ মনে করে, আন্তর্জাতিক চক্রান্তে তাদের এমন পরাজয়। এজন্য আওয়ামী লীগ আন্তর্জাতিক শক্তিকে গুরুত্ব দিয়ে নতুন বছর ২০২৫ সালেই মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয় হবে।’
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘অবৈধ, অসাংবিধানিক, দখলদার ও অনির্বাচিত অন্তর্বর্তীকালীন এ সরকারের হাত থেকে ২০২৫ সালেই বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক, সাংবিধানিক ও নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারের নেতৃত্বে দেশ পরিচালিত হোক— এটিই আমাদের দৃঢ় প্রত্যয়।’
‘বাংলাদেশের মানুষ শান্তি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, সমৃদ্ধি, গণতান্ত্রিক অধিকার, আইনের শাসন ও মানবাধিকারে বিশ্বাসী। মানুষের প্রত্যাশার সঙ্গে তাল মিলিয়ে একটি শান্তি, স্থিতিশীল ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে, প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলকে স-মহিমায় নিজেদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে, সর্বোপরি দেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে আমরা নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করব।’
অবৈধ, অসাংবিধানিক, দখলদার ও অনির্বাচিত অন্তর্বর্তীকালীন এ সরকারের হাত থেকে ২০২৫ সালেই বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক, সাংবিধানিক ও নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারের নেতৃত্বে দেশ পরিচালিত হোক— এটিই আমাদের দৃঢ় প্রত্যয়
এদিকে, আওয়ামী লীগের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে নতুন বছরে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে দলটির সভাপতি শেখ হাসিনার একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়, ‘স্বাভাবিক নিয়মেই সময়ের কাঁটা ঘোরে, ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে নতুন বছর এসে কড়া নাড়ে। সময়, সমাজ ও সভ্যতা সামনের দিকে এগিয়ে চলে। বিরূপ পরিস্থিতিতে শক্ত মনোবল নিয়ে দাঁড়িয়ে দেশবিরোধী অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে আমাদের শুভ ও কল্যাণময় সময় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। স্বাভাবিকভাবেই আমার প্রত্যাশা থাকবে, নতুন বছরে পদার্পণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। বাংলার জনগণ সুখ-সমৃদ্ধি ও শান্তিতে বসবাস করবে।’
‘নতুন বছর আওয়ামী লীগের শপথ নেওয়ার বছর’— বলেও মনে করছেন দলটির নেতারা। বর্তমান সরকারের নৈরাজ্য ও অরাজকতা থেকে দল ও দেশকে রক্ষা করতে এবং নতুন উদ্যমে দল পরিচালনা করতে চান তারা। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমাদের নতুন বছর হলো শপথ নেওয়ার বছর। দেশের যে অরাজকতা তৈরি হয়েছে, সংকট তৈরি হয়েছে, দেশ যে দখলদারির খপ্পরে পড়ে গেছে, দেশের মানুষ যে বেদনার মধ্যে রয়েছে; অসাংবিধানিক ও অনির্বাচিত এ সরকারের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে নতুন উদ্যমে আমরা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করব। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে এটি আমরা করব। কারণ, নব্য স্বৈরাচার এ সরকারের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।’
প্রসঙ্গত, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে দেশত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। যদিও দলটির নেতাদের দাবি, তাদের নেত্রীকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত দলটির কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চোখে পড়েনি। কেবল অজ্ঞাত স্থান থেকে অনলাইনে দলটির ফেসবুক পেজ থেকে কিছু কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে। সেই কর্মসূচি পালনে রাজপথে তাদের নেতাকর্মীদের তৎপরতাও লক্ষ করা যায়নি।
দেশের যে অরাজকতা তৈরি হয়েছে, সংকট তৈরি হয়েছে, দেশ যে দখলদারির খপ্পরে পড়ে গেছে, দেশের মানুষ যে বেদনার মধ্যে রয়েছে; অসাংবিধানিক ও অনির্বাচিত এ সরকারের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে নতুন উদ্যমে আমরা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করব
খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক, আওয়ামী লীগ
এমনকি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ১৫ আগস্ট শোক দিবস পালন করতেও দেখা যায়নি। ওই দিন ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে আওয়ামী লীগের কিছু নেতাকর্মী জড়ো হলে তাদের ওপর শিক্ষার্থীদের হামলার ঘটনা ঘটে। এরপর থেকে এক অর্থে আত্মগোপনে চলে যায় দলটি। নতুন কোনো কর্মসূচিও ঘোষণা দেয়নি আওয়ামী লীগ। তবে, নতুন বছরে দলটি আবারও মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয় হতে যাচ্ছে। দেশ-বিদেশে নিজেদের জানান দিতে ইতোমধ্যে লবিস্টও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
৫ আগস্টের পর বিভিন্ন সময় আটক ও গ্রেপ্তার হওয়া আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা । ছবি- ঢাকা পোস্ট
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল ঢাকা পোস্টকে বলেন, ৫ আগস্ট থেকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর নির্মম নির্যাতন চলছে। মব জাস্টিসের নামে নেতাকর্মীদের হত্যা করা হয়েছে। তারপরও আমাদের নেতাকর্মীরা কিছু কর্মসূচি পালন করেছেন। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালিয়েছে। যার কারণে আমরা সতর্কতার সঙ্গে কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলাম। এখন পরিস্থিতি পাল্টিয়েছে। মানুষ বুঝতে পারছে যে, দেশকে কীভাবে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
লবিস্ট হিসেবে একটি ফার্মকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তারাও বিভিন্ন দেশের সরকারি দলের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছে এবং দেশের বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরছে। আমরা দেশের জঙ্গিবাদ বিস্তারের বিষয়ে পশ্চিমা ও বিভিন্ন দেশের সরকারকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছি। বর্তমান সরকার জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে কাজ করছে— সেটাও তুলে ধরা হচ্ছে
‘চলতি মাসের মধ্যে আমরা রাজনৈতিক কর্মসূচি দেব। এ সরকারের বিদায় ঘণ্টা বেজে গেছে, এখন সময়ের ব্যাপার। আমরা জেলা, মহানগর, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খুলে নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। আমাদের নেত্রীও বিভিন্ন দেশে প্রবাসী নেতাকর্মীদের সঙ্গে ভার্চুয়াল মাধ্যমে কথা বলেছেন।’
নতুন করে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাজপথের সক্রিয় রাজনীতিতে অংশ নিতে চায় আওয়ামী লীগ । ছবি- ঢাকা পোস্ট
আওয়ামী লীগের এ সাংগঠনিক সম্পাদক আরও বলেন, ‘বিভিন্ন দেশে আমাদের নেতাকর্মীরা সেই দেশের সরকারি দলের জনপ্রতিনিধি ও সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। লবিস্ট হিসেবে একটি ফার্মকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তারাও বিভিন্ন দেশের সরকারি দলের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছে, দেশের বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরছে। আমরা দেশের জঙ্গিবাদ বিস্তারের বিষয়ে পশ্চিমা ও বিভিন্ন দেশের সরকারকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছি। বর্তমান সরকার জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে কাজ করছে— সেটাও তুলে ধরা হচ্ছে।’