ফ্যাসিস্টরা পদত্যাগ করার সুযোগ পায় না

Slider বাধ ভাঙ্গা মত


কথায় আছে, লোকটা মারা গেলেও চোখটা ঠিক আছে। যিনি দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন, তিনি পদত্যাগ করেছেন কি করেন নাই, সেই বিতর্ক প্রসঙ্গে পর্যবেক্ষকরা এমন মন্তব্য করেছেন। যিনি দেশে থাকার সাহস হারিয়েছেন তার পদত্যাগ করা না করার প্রশ্ন ঐ‘চোখটি ঠিক আছে’ মরা লোকটির মতোই বলে মনে করেন তারা।

হাসিনা ছাত্র-জনতার রক্তে বাংলাদেশের মাটি সিক্ত করে জান নিয়ে পালিয়ে তার প্রভূরাষ্ট্র ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। সাথে সাথে পালিয়ে গেছে তার সকল ডামি সংসদের সকল সদস্য ও মন্ত্রী পরিষদ। পুলিশ, সিভিল ও সামরিক প্রশাসনের হাসিনার দোসরদের মধ্যে যারা তার অতিঘনিষ্ঠ ও গণশত্রু হিসেবে পরিচিত তারাও পালিয়েছেন। এখন একটি মহল অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি করছে হাসিনা পদত্যাগ করে পালিয়েছে কিনা? সাজানো নির্বাচনে বিনা ভোটে স্বঘোষিত প্রধানমন্ত্রী হাসিনা পদত্যাগ করলো কী না করলো তা নিয়ে বিতর্ক করা, সময় নষ্ট বৈ অন্য কিছু নয় বলে মনে করেন রাজনীতি বিশ্লেষকরা। কারণ ইতিহাসের কোন নিষ্ঠুর স্বৈরাচার ও ফ্যাসিস্ট শাসকই পদত্যাগ করার সময় পায় না। কেউ জনরোষে জনতার হাতে নিহত হয়েছে, কেউ পালিয়ে জান বাঁচিয়েছে আবার কেউ গ্রেপ্তার হয়ে ফাঁসিতে ঝুলেছেন, নয় তো কারাগারে মারা গেছে।

ইতিহাস ও পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন সূত্রে প্রকাশ,‘দেশে দেশে স্বৈরাচার বা কর্তৃত্ববাদের পরিণতি যুগে যুগে এমনই হয়। পৃথিবীর বহু দেশে এর নজির বিদ্যমান। ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কো বাহামন্ডে একজন স্প্যানিশ সামরিক জেনারেল, যিনি ১৯৩৯ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত স্পেন একজন স্বৈরশাসক হিসেবে, কৌডিলো উপাধি গ্রহণ করেন। স্প্যানিশ ইতিহাসের এই সময়কাল, সাধারণত ফ্রাঙ্কোইস্ট স্পেন বা ফ্রাঙ্কোবাদী একনায়কত্ব হিসেবে পরিচিত। ১৯৭৫ সালে তার স্বাভাবিক মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে স্পেনে একনায়কত্বে অবসান হয়। এ ইতিহাস কারো জানার বাইরে?

তানজানিয়ার সেনাবাহিনী এবং বিদ্রোহী বাহিনী ১৯৭৯ সালে সফলভাবে কাম্পালা দখল করে এবং ইদি আমিনকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে। আমিন নির্বাসনে যান, প্রথমে লিবিয়ায়, তারপর ইরাকে এবং অবশেষে সৌদি আরবে, যেখানে তিনি ২০০৩ সালে তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বসবাস করেন। ইরানের পরাক্রমশালী শাহেনশাহ রেজা শাহ পাহলবির দোর্দ- প্রতাপে দীর্ঘ ৩৮ বছর প্রবল পরাক্রমে ইরানের রাজসিংহাসন দখলে রাখলেও ১৯৭৯ সালে বিদায় নিতে হয় জনবিক্ষোভের মুখে। পতনের পর তার স্থান জোটে মিসরে। সেখানেই তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পর তার লাশ দাফনের জন্যও কি ইরানে আনা সম্ভব হয়েছিল?

আরেক সাড়া জাগানো স্বৈরশাসক ফিলিপাইনের ফার্দিনান্দ মার্কোসও বড় হতভাগা। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত একজন সরকারপ্রধান যে কতটা নিষ্ঠুর স্বৈরশাসকে পরিণত হতে পারেন, মার্কোস তার দৃষ্টান্ত। ১৯৬৫ সালে ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে ১৯৭২ সাল থেকে তিনি দেশ শাসন করছিলেন সামরিক আইনের দ্বারা। ক্ষমতায় ছিলেন ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত। ১৯৮৩ সালে ম্যানিলা এয়ারপোর্টে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনীতিক বেনিগনো অ্যাকুইনোর হত্যাকা-ের পর মার্কোস প্রচ- জনবিক্ষোভের মুখে পড়েন। এরপর নির্বাচনে কারচুপিকে কেন্দ্র করে নিহত অ্যাকুইনোর স্ত্রী কোরাজন অ্যাকুইনোর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা তীব্র গণআন্দোলনের মুখে ১৯৮৬ সালে তার ক্ষমতাচ্যুতি ঘটে। দেশত্যাগে বাধ্য হন তিনি। আশ্রয় জোটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ১৯৮৯ সালে সেখানেই তার করুণ মৃত্যু হয়। । ১৯৮৯ সালের নভেম্বরে চাসেস্কু রোমানিয়ার কম্যুনিস্ট পার্টির প্রেসিডেন্ট পদে পুনরায় নির্বাচিত হন। এ বছরের ১৬ ডিসেম্বরে দেশটির পশ্চিমাঞ্চলে সরকার-বিরোধী দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়লো। ১৭ ডিসেম্বর দাঙ্গার নেতারা পার্টির সেন্ট্রাল অফিসের দিকে সমবেত হবার ঘোষণা দেয়। চাসেস্কু সমবেত বিদ্রোহীদের উপর গুলি চালানোর হুকুম দেন। প্রায় ৪,০০০ বিদ্রোহীর মৃতদেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। সরকারি হিসেবের নীতি অনুযায়ী চেপে যাওয়া হলো হতাহতের আসল সংখ্যা।

কিন্তু বিরোধীদের আন্দোলন থেমে থাকলো না। নৈরাজ্য আরো দ্বিগুণ হয়ে গেলো। অস্ত্র ব্যবহার করেও জনমনে জন্মানো ক্ষোভ দমন করা যাচ্ছিলো না। ২০ ডিসেম্বর উত্তেজিত জনতা কার্যত শহরের দখলদার হয়ে উঠলো। দলত্যাগী অনেক সামরিক সদস্যও তাদের সাথে যোগ দিলো। পূর্ব ইউরোপে সমাজতান্ত্রিক স্বৈরশাসকদের একক রাজত্বের দিন বুঝি শেষ হয়ে আসছিলো। চাসেস্কু ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখার শেষ চেষ্টা করলেন। পার্টির উপর জনগণের অসীম আস্থা প্রমাণে সমাবেশের আয়োজন করা হয়। প্রায় ৮০ হাজার থেকে ১ লক্ষ মানুষের সমাবেশের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিলো। বুখারেস্টে কম্যুনিস্ট পার্টির সেন্ট্রাল অফিসের সামনে

দেওয়া চাসেস্কুর ভাষণ জাতীয় টিভি চ্যানেলে প্রচারিত হয়েছিলো। সেখানেও জনরোষ ঠেকানো গেলো না। পরিস্থিতি তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিলো। এমনকি রোমানিয়ার সামরিক বাহিনীও নিকোলাই চাসেস্কুর উপর থেকে সমর্থন উঠিয়ে নিচ্ছিলো।

পরিস্থিতি আর বিদ্রোহ দমন করার মতো নয়- শাসকের নিজের প্রাণ বাঁচানোর মতো হয়ে গিয়েছিলো। ২২ ডিসেম্বর চাসেস্কু তার স্ত্রীকে নিয়ে হেলিকপ্টারে করে বিদেশে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করেন। কিন্তু শেষরক্ষা হলো না। রাজধানী থেকে কয়েকশ কিলোমিটার দূরে চাসেস্কু দম্পতি গ্রেফতার হলেন। ২৫ ডিসেম্বর বিশেষ সামরিক আদালতে তাদের বিচার শুরু হলো। তাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা, জনবিরোধী নির্যাতন, রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি ও অর্থনৈতিক দুরবস্থা তৈরির অভিযোগ আনা হলো। বিচার চলাকালে চাসেস্কু আদালতের বৈধতা মানতে অস্বীকার করলেন। কোনো রকম জিজ্ঞাসাবাদের উত্তর দিলেন না। পুরো বিচারপ্রক্রিয়াটি ৫৫ মিনিট ধরে চলেছিলো। সংক্ষিপ্ত এই বিচারে নিকোলাই চাসেস্কু ও তার স্ত্রীকে মৃত্যুদ- দেওয়া হয়। রায় ঘোষণার কয়েক ঘন্টার ভেতরেই নিকোলাই চাসেস্কু দম্পতির ফাঁসি কার্যকর করা হয়। সেদিন ছিলো ২৫ ডিসেম্বর ১৯৮৯। নিপীড়িত মানুষের এক বড় অংশ সেদিন এই ঘটনাকে বড়দিনের সেরা উপহার হিসেবে বিবেচনা করেছিলো।

লিবিয়ার মুয়াম্মর আল-গাদ্দাফি, ইরাকের সাদ্দাম হোসেন, জার্মানির হিটলার ও ইতালির মুসোলিনির করণ পরিণতির কথা কারো অজানা নয়।
২৯ এপ্রিল ১৯৪৬- সালে, মুসোলিনি, পেটাচ্চি এবং অন্যান্য ফাসিস্টরা বিক্ষোভকারীদের হাতে নিহত হওয়ার পর মৃতদেহগুলো একটি ভ্যানে বোঝাই করে দক্ষিণে মিলানে নিয়ে যাওয়া হয়। লাথি ও থুথু মারার পর লাশগুলো এসো গ্যাস স্টেশনের ছাদ থেকে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। তারপর বেসামরিক নাগরিকরা তার মৃতদেহে পাথর নিক্ষেপ করে মনে ক্ষোভ মিটিয়েছে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ফ্যাসিস্ট ও স্বৈরাচাররা পালায় পদত্যাগ করে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *