২৪ ঘণ্টার বেশি সরকারহীন বাংলাদেশ

Slider টপ নিউজ


শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও নতুন সরকার গঠিত না হওয়ায় কার্যত অচল হয়ে পড়েছে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড। সরকারি কর্মকাণ্ডের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয় খুললে হাতেগোনা কয়েকজন কর্মকর্তা অফিসে গিয়েছেন। সরকারি অনেক অফিসে কর্মকর্তাদের বাড়িতে চলে যেতে বলা বা তালাবদ্ধ করে রাখার তথ্যও পাওয়া গেছে।

বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব যেসব মন্ত্রী ছিলেন, তাদের কারো কোনো সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। তাদের অনেকের সরকারি বাসভবনে হামলা হয়েছে, তারা কোথায় রয়েছেন, কেউ জানে না।

অন্যদিকে সোমবার বিকেল থেকেই ঢাকাসহ সারাদেশে থানাগুলোতে হামলা ও কোথাও কোথাও অস্ত্র লুটের ঘটনায় কিছু পুলিশ সদস্যের মৃত্যুর পর নিরাপত্তাহীনতার মধ্যেই কার্যত অচল হয়ে গেছে পুলিশ প্রশাসন। দেশের বেশিভাগ জেলা ও থানায় পুলিশ সদস্যদের কোনো তৎপরতা নেই।

বিভিন্ন জেলা উপজেলা থেকে জানা যাচ্ছে, সেখানকার স্থানীয় প্রশাসনও কাজ করছে না। অনেক স্থানে ডিসি, ইউএনও, ভূমি কর্মকর্তাদের কর্মকাণ্ড দেখা যায়নি।

কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে জুলাই মাস থেকে যে তীব্র আন্দোলন শুরু হয়েছিল দেশে, তাতে এ পর্যন্ত প্রায় ৪০০ মানুষের মৃ্ত্যু হয়েছে।

আন্দোলনের একপর্যায়ে সোমবার পদত্যাগের পর দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর আওয়ামী লীগের সব নেতা ও মন্ত্রী আত্মগোপনে চলে যান। অবশ্য তাদের অনেকে আগেভাগে দেশের বাইরে চলে গেছেন বলে জানা যাচ্ছে।

সরকারহীন ২৪ ঘণ্টা
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় পার হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিষয়ে কোনো ঘোষণা আসেনি।

শেখ হাসিনা সোমবার দুপুরে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পর বেলা ৪টার দিকে প্রেস ব্রিফিং-এ সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান শেখ হাসিনার পদত্যাগের সিদ্ধান্ত প্রকাশ করে দ্রুতই রাষ্ট্রপতির সাথে পরামর্শ করে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের কথা বলেছিলেন।

পরে রাতে বঙ্গভবনে গিয়ে সেনাপ্রধান, জামায়াত ও বিএনপিসহ কয়েকটি দলের নেতারা রাষ্ট্রপতি মো: সাহাবুদ্দিনের সাথে বৈঠক করেন।

রাত সাড়ে ১১টার দিকে রাষ্ট্রপতি জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে দ্রুত একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সিদ্ধান্তের কথা জানান।

এর মধ্যে সোমবার রাত ৮টার দিকে একটি বেসরকারি টেলিভিশনে গিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আটজন সমন্বয়ক জানান যে সেনা-সমর্থিত কোনো সরকার তারা মানবেন না এবং তারা নিজেরাই সরকার গঠনের একটি রূপরেখা দিয়ে সেই সরকারে কারা থাকবেন তাদের নাম প্রকাশ করবেন।

মঙ্গলবার ভোরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে প্রকাশ করা এক ভিডিও বার্তায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে নোবেল বিজয়ী বাংলাদেশী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নাম ঘোষণা করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম।

যদিও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, দ্রুত অন্তর্বর্তী সরকার গঠন না করলে রাজনৈতিক শূন্যতা দেখা দিতে পারে।

ড. ইউনূসের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ছাত্রদের প্রতি আমাদের সম্পূর্ণ আস্থা আছে। তবে সর্বদলীয় ব্যাপারটাতে গুরুত্ব দিতে হবে।’

অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামির আমির শফিকুর রহমান বলেছেন, ড. ইউনূসকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দেখতে চেয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের প্রস্তাবকে তার দল শ্রদ্ধার চোখে দেখে।

এর মধ্যে মঙ্গলবার দুপুরেই সংসদ ভেঙে দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো: সাহাবুদ্দিন। ফলে এ মুহূর্তে সংসদ, মন্ত্রীসভা ও সরকার- এই তিনটির কোনোটিরই অস্তিত্ব নেই।

ফলে প্রশাসন, সরকারের বিভাগের মধ্যে এই মুহূর্তে কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে না। সারাদেশে অনেক সহিংসতা ও হামলার ঘটনা ঘটলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশের কোনো ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না।

পুলিশ ও প্রশাসন অচল
সোমবার দুপুরের পর থেকে ঢাকাসহ সারাদেশে বহু থানায় হামলা হয়। ঢাকায় পুলিশ সদর দফতর ও রাজারবাগ পুলিশ লাইনসেও হামলা হয়।

বাংলাদেশের কনস্টেবল থেকে ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার পুলিশ সদস্যদের সংগঠন পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন ঘোষণা করেছে, পুলিশ সদস্যদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তারা কর্মবিরতি পালন করবে। ফলে কার্যত সোমবার সন্ধ্যার পর থেকে পুলিশের কোনো তৎপরতা চলমান নেই।

এমনকি মঙ্গলবার ঢাকার কোথাও ট্রাফিক পুলিশ দেখা যায়নি এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সদর দফতর বন্ধ ছিল। ওই কার্যালয়ের সামনে দুপুর ১২টার দিকে সেনাবাহিনীর একটি দলকে অবস্থান করতে দেখা গেছে।

ট্রাফিক পুলিশ না থাকায় অনেক স্থানে শিক্ষার্থীদের যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে দেখা গেছে।

রাজধানীর বেশিভাগই থানাতেই হামলার পর অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে সোমবার বিকেলে। কিছু থানা থেকে অস্ত্র লুট করা হয়েছে। বেশ কিছু পুলিশ সদস্য নিহত ও আহত হয়েছেন। ফলে এসব থানার কোনো কার্যক্রমই এখন আর চলছে না।

ঢাকায় যাত্রাবাড়ী ও উত্তরায় থানায় হামলার পর পুলিশ সদস্যরা গুলি ছুড়লে তা নিয়েও অনেক সহিংসতা হয়েছে।

ঢাকার বাইরে কয়েকটি জেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পুলিশ সুপার ও থানাগুলোতে নিরাপত্তাহীন পরিবেশ বিরাজ করায় কেউই অফিস করছে না।

সোমবারই পুলিশ সদর দফতরের হামলা এবং রাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে হামলার পর পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন কর্মবিরতি ঘোষণা দিয়েছে।

তবে পুলিশের আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন এক ভিডিও বার্তায় পুলিশ ও পুলিশের স্থাপনার নিরাপত্তায় রাজনৈতিক নেতা ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের আহ্বান জানানোর জন্য অনুরোধ জানান। তিনি শিগগিরই পুলিশের কার্যক্রম স্বাভাবিক হবে বলে আশা প্রকাশ করেন।

পুলিশের অনুপস্থিতিতে থানা, ট্রাফিক ও বিমানবন্দরে নিরাপত্তার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীকে।

অন্যদিকে সরকারি কর্মকাণ্ডের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয় খুললে কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের হাতেগোনা কয়েকজন কর্মকর্তা অফিসে গিয়েছেন।

তবে সচিবালয়ের কাছেই একাধিক ভবনে হামলার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লে ১২টার দিকেই কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সচিবালয় থেকে বেরিয়ে আসেন।

এসব মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকার বা নির্দেশনা দেয়ার মতো বর্তমানে কেউ নেই। যেসব মন্ত্রীরা দায়িত্বে ছিলেন, সরকার পতন হওয়ায় কার্যত তারা আর দায়িত্বে নেই। তাদের অনেকে আগেই দেশের বাইরে পালিয়ে চলে গেছেন, অনেকের আপাতত কোনো সন্ধান মিলছে না।

ড. হাছান মাহমুদ ও জুনাইদ আহমদ পলকের মতো কেউ কেউ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হয়েছেন।

ঢাকার বাইরে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা নিজ নিজ স্টেশনে উপস্থিত আছেন বলে জানা গেছে। তবে অনেকেই নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে অফিস করেননি।

একজন জেলা প্রশাসক বলেন, নৌবাহিনী জেলায় আসার পর থেকে তিনি অফিস করা শুরু করেছেন।

অর্থাৎ জেলা উপজেলা পর্যায়ে সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন শুরু হয়েছে। সেটি হলে জেলা ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা পুরো দমে অফিস শুরু করতে পারবেন বলে মনে হচ্ছে।

তবে কয়েকটি জেলা থেকে খবর পাওয়া গেছে, সেখানে ডিসি, ইউএনও, এসি ল্যান্ডদের তাদের কার্যালয় ও বাসায় পাওয়া যায়নি। স্থানীয় কর্মকাণ্ডেও তাদের কোনো তৎপরতা বা নির্দেশনা দেখা যাচ্ছে না।

একজন কর্মকর্তা জানান, তার উপজেলায় সরকারি স্থাপনাতেও অনেকগুলো হামলা হওয়ায় তিনি নিরাপদ অবস্থানে রয়েছেন। সরকারি দায়িত্ব পালন করার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথেও যোগাযোগ করতে পারছেন না, এমনকি সহকর্মী অন্যরাও কার্যালয়ে আসতে সাহস পাচ্ছেন না।

‘নিরাপত্তার অভাব’ দেখিয়ে সরকারি অনেক অফিসে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাসায় চলে যেতে বলা হয়েছে। সরকারি অনেক অফিসের প্রধান ফটক ও বিভিন্ন কক্ষে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে।

এমনকি অনেক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক হাসপাতালেও চিকিৎসকরা আসেনি, তাদের চেম্বার তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে।

অন্যদিকে চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক জানান, বন্দরের কার্যক্রম তারা চালিয়ে যাচ্ছেন।

তিনি বলেন, ‘জাহাজ থেকে পণ্য ওঠা-নামা চলছে। তবে স্বাভাবিকের চেয়ে একটু কম ডেলিভারি হচ্ছে পর্যাপ্ত যানবাহন না থাকার কারণে। আশা করি দ্রুতই সব স্বাভাবিক হবে।’

তবে নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজের কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে। সেনাবাহিনীর একটি দল কাস্টমস হাউজ পরিদর্শন করেছেন বলে একজন কর্মকর্তা জানান।

মঙ্গলবার সব কিছু খোলার তথ্য জানানো হলেও অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান খোলেনি।

বিকেএমইএ-এর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বলছেন বিজেএমইএ ও বিকেএমইএ-এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বুধবার তারা কারখানাগুলো খুলে দেবেন।

তিনি বলেন, ‘তবে বাস্তবতা হলো পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়ায় জনমনে ভীতি আছে। আমরা মনে করি সেনাবাহিনী যেহেতু মোতায়েন আছে তাদের টহল দৃশ্যমান হলেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করবে।’
সূত্র : বিবিসি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *