ভারতের কলকাতায় ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আনোয়ারুল আজীম আনারকে পরিকল্পিতভাবে হত্যার ঘটনায় থানায় মামলা দায়ের হয়েছে।
বুধবার (২২ মে) রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় খুন করার উদ্দেশ্যে অপহরণের অভিযোগে মামলাটি দায়ের করেন এমপি আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন।
সন্ধ্যায় শেরে-বাংলা নগর থানায় মামলাটি নথিভুক্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আহাদ আলী। তিনি বলেন, অজ্ঞাতদের আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়েছে (মামলা নম্বর ৪২)। এখন তদন্ত করে আসামিদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।
তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) এইচ এম আজিমুল হকও মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
এমপি আনার সংসদ ভবন এলাকায় থাকতেন। সেখান থেকে তিনি ভারতে গেছেন। তাই ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) প্রধান হারুন-অর-রশিদের পরামর্শে শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা দায়ের করেন তার মেয়ে।
এর আগে, আজ সকালে কলকাতার গণমাধ্যম সূত্রে প্রথম খবর ছড়ায়, বাংলাদেশের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম হত্যার শিকার হয়েছেন। এরপর এ ব্যাপারে গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে সর্বপ্রথম পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, ভারতে গিয়ে নিখোঁজ বাংলাদেশের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারের মরদেহ উদ্ধারের খবর পেয়েছি গণমাধ্যম সূত্রে। তবে, ইন্ডিয়ান বা কলকাতা পুলিশ আমাদের এখনো কিছু নিশ্চিত করেনি। তিনি জীবিত নাকি মৃত তা এখনো অফিসিয়ালি নিশ্চিত নই। আমরা যৌথভাবে কাজ করছি।
পরে দুপুরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীমকে পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়েছে। কারা তাকে খুন করেছে তা জানতে বাংলাদেশ ও ভারতের পুলিশ কাজ করছে।
এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত তিনজনকে আটক করা হয়েছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, আটক তিনজন বাংলাদেশ পুলিশের কাছে আছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
মন্ত্রী বলেন, চিকিৎসার জন্য আনোয়ারুল আজীম দেশের বাইরে গিয়েছিলেন। সেখানে তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। ভারতের পুলিশ আমাদের নিশ্চিত করেছে, তাকে হত্যা করা হয়েছে।
প্রাথমিক তদন্তের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, খুনের সঙ্গে ভারতের কেউ জড়িত নয়। বাংলাদেশিরাই খুন করেছে। সেহেতু বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক খারাপ হওয়ার কোনো কারণ নেই। ভারত আমাদের যথেষ্ট কো-অপারেশন করছে। আমাদের কাছে আরও তথ্য আছে। তবে তদন্তের স্বার্থে এখন জানাতে পারছি না।
এদিকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন-অর-রশিদ জানান, ঝিনাইদহ-৪ আসনের এমপি আনার হত্যাকাণ্ডের কারণ জানতে নিবিড়ভাবে তদন্ত চলছে।
সাংবাদিকদের ডিবি প্রধান বলেন, ঘটনাটি খুবই মর্মান্তিক। ঝিনাইদহ-কালিগঞ্জ এলাকার জনপ্রিয় জনপ্রতিনিধি ছিলেন তিনি। তার এলাকার সাধারণ মানুষ স্তম্ভিত। আমরা অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছি। তিনি তিনবারের সংসদ সদস্য। এটি নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড, এটা মনে করেই তদন্তকারী কর্মকর্তারা কাজ করছেন। নিবিড়ভাবে ভারতীয় পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। কয়েকজন আমাদের কাছে আছে, তাদের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাচ্ছি। তদন্তের স্বার্থে আমরা সবকিছু বলতে পারছি না।
হারুন-অর-রশিদ বলেন, একজন সংসদ সদস্যকে বাংলাদেশি অপরাধীরা নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকি যারা আছে তাদের প্রত্যেককে আমরা আইনের আওতায় আনব। বিচারের মুখোমুখি করব। তদন্তের স্বার্থে নাম প্রকাশ করতে চাচ্ছি না।
বিভিন্ন ধরনের ভুল তথ্য ছড়ানো হচ্ছে, কী কারণে হত্যার ঘটনা ঘটেছে জানা গেছে কি না? এ প্রশ্নের জবাবে ডিবি প্রধান বলেন, আসলে এটা কী কারণে ঘটেছে জানতে আমাদের তদন্ত চলছে। এটা পারিবারিক নাকি আর্থিক নাকি এলাকায় কোনো দুর্বৃত্ত দমন করার কারণে এমন ঘটনা ঘটেছে- সবকিছু আমরা তদন্তে আনব।
প্রসঙ্গত, গত ১২ মে চিকিৎসার জন্য ভারতের পশ্চিবঙ্গে যান এমপি আনোয়ারুল আজীম আনার। সেদিন সন্ধ্যা ৭টার দিকে কলকাতায় তার পারিবারিক বন্ধু গোপাল বিশ্বাসের সঙ্গে দেখা করতে যান। পরের দিন, ১৩ মে চিকিৎসক দেখাতে হবে জানিয়ে দুপুর ১টা ৪১ মিনিটে গোপালের বাড়ি থেকে বের হন আনার। সন্ধ্যায় ফিরবেন বলেও জানান তিনি। পরে বিধান পার্কের কাছে কলকাতা পাবলিক স্কুলের সামনে থেকে ট্যাক্সিতে উঠেছিলেন তিনি।
চলে যাওয়ার পর সন্ধ্যায় আজিম তার বন্ধু গোপালকে জানান, তিনি দিল্লি যাচ্ছেন এবং সেখানে পৌঁছে তাকে ফোন করবেন। পরে তার সঙ্গে ভিআইপিরা আছেন জানিয়ে বন্ধু গোপালকে ফোন না দেওয়ার জন্য সতর্ক করেছিলেন।
গত ১৫ মে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো বার্তায় এমপি আনার বন্ধু গোপালকে জানান, তিনি দিল্লি পৌঁছেছেন এবং ভিআইপিদের সঙ্গে আছেন। তাকে ফোন করার দরকার নেই। একই বার্তা পাঠান বাংলাদেশে তার ব্যক্তিগত সহকারী রউফের কাছেও।
১৭ মে আনারের পরিবার তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে গোপালকে ফোন করেন। ওই সময় তারা গোপালকে জানান, তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না তারা। পরিবারের পক্ষ থেকে ওই দিনই ঢাকায় থানায় অভিযোগ করা হয়। এরপর থেকে এমপি আনারের খোঁজ পাওয়া যায়নি।
পরে আজ ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যমে বলা হয়, কলকাতার নিউ টাউনের সঞ্জিভা গার্ডেন্সের একটি ফ্লাটে এমপি আনারকে খুন করা হয়েছে। এনডিটিভি বলে, ১২ মে কলকাতায় আসার পর নিখোঁজ হওয়া এমপি আনারের খোঁজে তল্লাশি শুরুর পর বুধবার সকালে তার খুনের ব্যাপারে নিশ্চিত হয় পুলিশ। প্রাথমিকভাবে এনডিটিভির প্রতিবেদনে এমপি আনারের মরদেহ উদ্ধারের তথ্য জানিয়ে বলা হয়, সেখানে মরদেহের খণ্ডিত অংশ পাওয়া গেছে।
পরবর্তী সময়ে এনডিটিভির ওই প্রতিবেদন থেকে খণ্ডিত মরদেহ উদ্ধারের তথ্য সরিয়ে ফেলা হয়। এতে বলা হয়, বাংলাদেশি ওই এমপি খুন হয়েছেন বলে ধারণা করছে কলকাতা পুলিশ। তার মরদেহ কলকাতার নিউ টাউন এলাকায় বিভিন্ন স্থানে ফেলে রাখা হয়েছে। তল্লাশি অভিযানের সময় নিউটাউনের একটি ফ্লাটে রক্তের দাগ দেখতে পেয়েছে পুলিশ।
এদিকে, কলকাতা পুলিশের বরাত দিয়ে বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া একজন ক্যাবচালক জানিয়েছেন, এক সপ্তাহ আগে নিখোঁজ হওয়া ঝিনাইদহের এমপি আনারকে হত্যা করা হয়েছে এবং মরদেহ খণ্ড-বিখণ্ডিত করে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। যদিও পরে বিবিসি বাংলাও ক্যাব চালকের স্বীকারোক্তির তথ্য তাদের প্রতিবেদন থেকে সরিয়ে ফেলেছে।
পুলিশের কর্মকর্তারা বলেছেন, যে ফ্ল্যাটে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে; সেটি পুলিশ ঘিরে রেখেছে। সেখানে কাউকে এখন ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। পুলিশের সূত্র বলেছে, ওই ফ্ল্যাটে তিনজনকে ঢুকতে সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে। তাদের মধ্যে একজন নারী। তবে ওই তিনজনকে সেখান থেকে বের হতে আর দেখা যায়নি।
এর আগে, ২০ মে এমপি আনারের খোঁজ করতে গিয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তার মোবাইল লোকেশন ট্র্যাক করে। তারা জানতে পারে, কলকাতায় বন্ধুর বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর তার মোবাইলের লোকেশন একবার পাওয়া গিয়েছিল সেখানকার নিউমার্কেট এলাকায়। এরপর ১৭ মে তার ফোন কিছুক্ষণের জন্য সচল ছিল বিহারে।