ঈদের ছুটিতে ঘুরে আসুন অপরূপ মিরসরাই

Slider কৃষি, পরিবেশ ও প্রকৃতি


বন্দী জীবন থেকে ছুটি পেলে কার না মন চায় একটু ঘুরে বেড়াতে। আর তা যদি হয় ঈদের ছুটি তাহলে তো কথা নেই। তাই এবারের ঈদের ছুটিতে বেড়াতে যেতে পারেন পর্যটন স্পটের সৌন্দর্যভূমি খ্যাত চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে। পাহাড়-সমুদ্রবেষ্টিত এই উপজেলার বিভিন্ন পর্যটন স্পট যেন সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়ে অপেক্ষায় রয়েছে পর্যটকদের বরণ করতে।

এখানে রয়েছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম কৃত্রিম লেক মহামায়া সেচ প্রকল্প, দেশের ৬ষ্ঠ সেচ ও প্রথম বায়ু বিদ্যুৎ প্রকল্প মুহুরী প্রজেক্ট, আট স্তর বিশিষ্ট জলপ্রভাত খৈয়াছড়া ঝরনা, রূপসী ঝরনা, বাওয়াছড়া প্রকল্প, বোয়ালিয়া ঝরনা, নাপিত্তাছড়া ঝরনা, ডোমখালী সমুদ্র সৈকত, হিলসডেল মাল্টি ফার্ম, আরশিনগর ফিউচার পার্ক ও মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলের বসুন্ধরা পয়েন্ট। ঈদের ছুটিতে প্রকৃতির অতি কাছাকাছি যে যেতেই হবে। অপার সৌন্দর্যমণ্ডিত প্রকৃতির সাথে এবার ঈদে তাই এখানকার মুখরিত জনপদ হয়ে উঠবে আরও মুখর।

বাওয়াছড়া
উপজেলার ওয়াহেদপুর ইউনিয়নের মধ্যম ওয়াহেদপুর বাওয়াছড়া পাহাড়ি এলাকায় যুগ যুগ ধরে ঝর্ণা প্রবাহিত হচ্ছে। সবুজ শ্যামল পাহাড়ি লেকে পাখিদের কলতানে আবাল, বৃদ্ধ, বণিতা সকলের প্রান জুড়িয়ে যাবে। প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এ স্থানে ছুটে আসে শত শত পর্যটক।
লোকেশন : ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বড় কমলদহ বাজার থেকে থেকে ২ কিলোমিটার পূর্ব দিকে এটি অবস্থিত।

মুহুরী প্রজেক্ট
প্রকৃতির আরেক নাম মুহুরী। যেখানে আছে আলো-আঁধারির খেলা। আছে জীবন-জীবিকার নানা চিত্র। মুহুরীর চর, যেন মিরসরাইয়ের ভেতর আরেক মিরসরাই। অন্তহীন চরে ছোট ছোট প্রকল্প। এপারে মিরসরাই, ওপারে সোনাগাজী। ৪০ দরজার রেগুলেটরের শোঁ শোঁ আওয়াজ শোনা যায় দূর থেকে। পশ্চিমে মৎস্য আহরণের খেলা, আর পূর্বে মন কাড়ানিয়া প্রকৃতি। নুয়ে পড়া মনোবল জেগে উঠবে পূবের জেগে ওঠা চরে। ডিঙি নৌকায় ভর করে কিছুদূর যেতেই দেখা মিলবে সাদা সাদা বক। এখানে ভিড় করে সুদূরের বিদেশী পাখি, অতিথি পাখি বলেই অত্যধিক পরিচিত এরা। চিকচিকে বালিতে জল আর রোদের খেলা চলে সারাক্ষণ। সামনে পেছনে, ডানে-বামে কেবল সৌন্দর্য আর সুন্দরের ছড়াছড়ি। এ অবস্থায় মন আঁধারে ঢেকে যেতে পারে, যদি ক্যামেরা সঙ্গে না থাকে। মুহুরীর প্রকৃতির ছোঁয়ায় উদ্ভাসিত স্মৃতিরা যেন হারিয়ে যাওয়ার নয়। এসব ক্যামেরার ফিল্মে আটকে রাখার মত হাজার বছর ধরে।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের (পুরাতন) জোরারগঞ্জ বাজারে নেমে ধরতে হবে সংযোগ সড়কের পথ। জোরারগন্জ-মুহুরী প্রজেক্ট সড়ক নামে এ সড়কে দেখা মিলবে হরেক রকমের মোটরযানের। ভাঙাচোরা আঁকাবাঁকা আধাপাকা সড়ক পাড়ি দিতে হবে প্রায় আট কিলোমিটার। এরপর মুহুরী প্রকল্পের বাঁধ। যেতে যেতে দুই কিলোমিটার পরই দেখা মিলবে আসল সৌন্দর্য।

ডোমাখালী সমুদ্র সৈকত
বায়ান্ন বাঁকের বড়দারোহাট-বেড়িবাঁধ সড়ক অতিক্রম করে দেখা মিলবে বিশাল সমুদ্র সৈকতের। শোনা যাবে সাগরের গর্জন। দখিনা মিষ্টি হাওয়ায় শরীর টা শীতল হয়ে যাবে। উত্তরে দুচোখ যতটুকু যাবে দেখা মিলবে সৈকতের, দক্ষিণে কেওড়া গাছের সবুজ বাগান। পশ্চিমে শুধু সাগর আর সাগর। চোখে পড়বে দুষ্ট ছেলেদের সাগরের স্বচ্ছ পানিতে লাফালাফি দৃশ্য। ঘাটে রয়েছে সারি সারি ডিঙ্গি নৌকা। জেলেরা কেউ মাছ ধরে সাগর থেকে ঘাটে ফিরছে, কেউ আবার সাগরে যাচ্ছে। এমন নৈসর্গিক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখার জন্য সেখানে প্রতিদিন ছুটে যাচ্ছেন অসংখ ভ্রমণপিপাসু নানা বয়সের মানুষ। বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরের কাজ শুরু করার পর মেরিনড্রাইভের বাঁধ নির্মাণের কারণে বিশাল এলাকাজুড়ে সমুদ্র সৈকতের সৃষ্টি হয়েছে। মিরসরাই উপজেলার একেবারে দক্ষিণ সীমান্তে অবস্থিত এই স্পটের নাম ‘ডোমখালী সমুদ্র সৈকত’। শুধু দিনে নয়, রাতেও সাগর পাড়ে দেখা মেলে অসংখ্য মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকারের। রাতে বেলায় বিশাল সমুদ্রের গর্জন কানপেতে শুনে সেখানে ছুটে যান তরুণেরা। পূর্ণিমার রাতে সেখানে তরুণ-যুবকদের ঢল নামে। এই সমুদ্র সৈকতের দুরত্ব প্রায় চার কিলোমিটার।

মহামায়া ইকোপার্ক
দূর থেকে দেখা যায় প্রায় পাহাড়সম বাঁধ। উভয় পাশে শুধু পাহাড় আর পাহাড়। বাঁধের ধারে অপেক্ষমান সারি সারি ডিঙি নৌকো আর ইঞ্জিনচালিত বোট। ১১ বর্গকিলোমিটার আয়তনের লেক কেবল সুভা ছড়ায়। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে স্বচ্ছ পানিতে তাকাতেই দেখা যায় নীলাকাশ। পূর্ব-দিগন্তের সারি পাহাড়ের বুক চিরে যেতে যেতে একসময় হারিয়ে যেতেও মন চাইবে কল্পনায়। সঙ্গের সাথী পাশে নিয়ে গেলে তো কথাই নেই। পরিবার-পরিজন নিয়ে গেলেও কোনো বারণ নেই। কিছুদূরেই দেখা যাবে পাহাড়ের কান্না। অঝোরে কাঁদছে। অথচ তার কান্না দেখে নিজের কাঁদতে ইচ্ছে হবে না। উপরন্তু কান্নার পানিরেত গা ভাসাতে মন চাইবে। তারও আগে যেখানে লেকের শেষ প্রান্ত, সেখানেও বইছে ঝর্ণাধারা। কী নীল, কী সবুজ, সব রঙের ছড়াছড়ি যেন ঢেলে দেয়া হয়েছে মহামায়ার প্রকৃতিতে। এর সাথে মিশতে গিয়ে মন এতটাই বদলে যাবে, যেন মন বারবার ঘুরে আসতে চাইবে ফেলে আসা স্মৃতিতে।

রূপসী ঝর্ণার রূপে পাগল হবে যে কেউ
প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য্যের আরেক নাম বড় কমলদহ রূপসী ঝর্ণা। আঁকাবাঁকা গ্রামীণ সবুজ শ্যামল মেঠো পথ পার হয়ে পাহাড়ের পাদদেশে গেলেই শোনা যাবে ঝর্ণার পানি গড়িয়ে পড়ার অপরূপ নুপুরধ্বনি। দুই পাশে সুউচ্চ পাহাড়। সাঁ সাঁ শব্দে উঁচু পাহাড় থেকে অবিরাম শীতল পানি গড়িয়ে যাচ্ছে ছড়া দিয়ে। রূপসী র্ঝণা প্রথম দেখেই তার রূপে পাগল হবে যে কেউ। মেঘের মতো উড়ে আসা শুভ্র এ পানি আলতো করে ছুঁয়ে দেখলেই এর শীতল পরশ মুহূর্তে ক্লান্তি ভুলিয়ে দেবে। টলটলে শান্ত পানির চুপচাপ বয়ে চলার ধরনই বলে দেবে এর উৎস অবশ্যই বিশাল কিছু থেকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পর্যটকেরা আবিষ্কার করবেন লাল আর নীল রঙের ফড়িঙের মিছিল! যত দূর পর্যন্ত ঝিরিপথ গেছে তত দূর পর্যন্ত তাদের মনমাতানো ঝিঁঝি পোকার গুঞ্জন শোনা যায়। চলার পথে শোনা যায় হরিণের ডাক। অচেনা পাখিদের ডাক, ঘাসের কার্পেট বিছানো উপত্যকার সাথে। রূপসী ঝর্ণার পানিতে গোসল করার লোভ সামলানো কারো পক্ষেই সম্ভব নয়।

দেশের বিভিন্ন স্থান হতে যে কোন বাস যোগে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বড়দারোগাহাট বাজারে নামবেন। এরপর সিএনজি অটোরিক্সা যোগে বাজারের উত্তর পাশের ব্রিকফিল্ড সড়ক দিয়ে পাহাড়ের পাদদেশ পর্যন্ত যাবে। এরপর পায়ে হেঁটে ঝর্নায় যাওয়া যাবেন। অথবা যেকোনো বাস থেকে ব্রিকফিল্ড সড়কের মাথায় নেমে অটোরিক্সা ছাড়া আধা কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে যেতে
পারবেন।

সৌন্দর্যের আরেক নাম খৈয়াছড়া ঝর্ণা
প্রকৃতির নান্দনিক তুলিতে আঁকা সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হচ্ছে দেশের ভ্রমণপিয়াসী মানুষ। প্রকৃতির অপরূপ সৃষ্টি সেতুবন্ধন করে, সবুজের চাদরে ঢাকা বনানী রূপের আগুন ঝরায়, যেখানে প্রকৃতি খেলা করে আপন মনে, ঝুম ঝুম শব্দে বয়ে চলা ঝরনাধারায় গা ভিজিয়ে মানুষ যান্ত্রিক জীবনের অবসাদ থেকে নিজেকে ধুয়ে সজীব করে তুলছে খৈয়াছরা ঝরনায়। গ্রামের সবুজ শ্যামল আঁকা বাঁকা মেঠো পথ পেরিয়ে শরীরটা একটু হলেও ভিজিয়ে নেয়া যায় নিঃসন্দেহে। আট স্তরের ঝরনা দেখতে দেশী-বিদেশী পর্যটকের ভিড় পড়েছে। দেশের অন্যতম বড় প্রাকৃতিক ঝরনাটি দেখতে প্রতিদিন ছুটে যাচ্ছে হাজার হাজার দেশী-বিদেশী পর্যটক। উপজেলার খৈয়াছরা ইউনিয়নের বড়তাকিয়া বাজারের উত্তর পাশে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ৪.২ কিলোমিটার পূর্বে ঝরনার অবস্থান। এরমধ্যে এক কিলোমিটার পথ গাড়িতে বাকি পথ হেঁটে যেতে হবে।

এছাড়া উপজেলার সোনাপাহাড় এলাকায় গড়ে উঠেছে আরশিনগর ফিউচার পার্ক ও অলিনগর এলাকায় রয়েছে হিলসডেলস মাল্টি ফার্ম ও মধুরিমা রিসোর্ট।

কিভাবে যাবেন?
দেশের যেকোনো স্থান থেকে যে কোন গাড়ি হয়ে সড়ক পথে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে নামতে হবে। এরপর ওইসব জায়গা থেকে পর্যটন স্পট পর্যন্ত গাড়ি যোগে যাতায়াতের ব্যবস্থা রয়েছে।

থাকা ও খাওয়া
মিরসরাই খাবারের অনেক রেস্টুরেন্ট রয়েছে। দুএকটি আবাসিক হোটেলও গড়ে উঠেছে। তবে পর্যটকের তুলনায় অপ্রতুল। মিরসরাই থেকে মাত্র ৪০ থেকে ৫০ মিনিটের পথ চট্টগ্রাম শহরে রয়েছে একাধিক আবাসিক হোটেল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *