আসছে দুর্বল ব্যাংককে একীভূত করার নীতিমালা

Slider অর্থ ও বাণিজ্য

দেশের ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণ হ্রাস ও করপোরেট সুশাসন নিশ্চিত করতে বিশেষ রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ রোডম্যাপ অনুযায়ী করপোরেট সুশাসন নিশ্চিত করতে কয়েকটি দুর্বল ব্যাংক অপেক্ষাকৃত সবল ব্যাংকের সাথে একীভূত করা হবে। আর দুর্বল ব্যাংকে যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী থাকবেন তাদেরকে তিন বছর চাকরিচ্যুত করা যাবে না- এমন শর্ত রাখা হয়েছে। এ জন্য একটি নীতিমালা তৈরি করা হবে। পাশাপাশি খেলাপি ঋণ কমাতে রোডম্যাপে ১১টি ধাপ রাখা হয়েছো। এর মধ্যে যেসব খেলাপি ঋণের মেয়াদ দুই বছর পার হয়েছে ওই সব খেলাপি ঋণ অবলোপন করা হবে। অবলোপন হলো খেলাপি ঋণের হিসাব থেকে আলাদা হিসাবে রাখা। এটা করা হলে ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণের হিসাব থেকে ৪৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা কমে যাবে, যা শতকরা হিসাবে ২ দশমিক ৭৬ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্ষদ সভায় গতকাল এ রোডম্যাপ উত্থাপন হলে তা অনুমোদিত হয় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার সভায় সভাপতিত্ব করেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, একশ্রেণীর গ্রাহক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা ফেরত দিচ্ছেন না। অপর দিকে হাজার হাজার কোটি টাকার বেনামী ঋণ নেয়া হয়েছে। ওই সব ঋণ ফেরত দেয়া হচ্ছে না। এমনকি ওই সব ঋণের মুনাফাও দিচ্ছেন না একধরনের গ্রাহক। আবার জালজালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ আকারে ব্যাংকের অর্থ বের করে নেয়া হয়েছে। সুশাসনের অভাবে ব্যাংকিং খাত এমন অবস্থায় পৌঁছেছে। এমনি পরিস্থিতি ব্যাংকিং খাতে সুশাসন নিশ্চিত করার মাধ্যমে সীমাতিরিক্ত, বেনামী স্বার্থ সংশ্লিষ্ট এবং জালিয়াতি বা প্রতারণার মাধ্যমে ঋণ বিতরণের পরিমাণ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ জন্যই এ রোডম্যাপ তৈরি করা হয়েছে। আর এসব লক্ষ্য বাস্তবায়ন করা হবে ২০২৬ সালের ৩০ জুনের মধ্যে। আর এ সময়ের মধ্যে ব্যাংকিং খাতের সামগ্রিক খেলাপি ঋণের হার ৮ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে হবে। এর মধ্যে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার ১০ শতাংশ এবং বেসরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে হবে। এসব লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ১৭টি কর্মপরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। প্রথম ১১টি কর্মপরিকল্পনা খেলাপি ঋণ হ্রাস করার জন্য এবং ছয়টি কর্মপরিকল্পনা ব্যাংকিং খাতে সুশাসান নিশ্চিত করার জন্য হাতে নেয়া হয়েছে। এসব কর্মপরিকল্পনা পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
সুশাসন নিশ্চিতের বিষয়ে ছয় কর্মপরিকল্পনার মধ্যে ব্যাংকের সামগ্রিক ঋণ ও ঝুঁকিব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করতে উদ্যোক্তা পরিচালক নিয়োগের বর্তমান ধারা পরিবর্তন করে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ জন্য উদ্যোক্তা পরিচালক নিয়োগের জন্য বিদ্যমান ফিট এবং প্রোপার টেস্ট প্রক্রিয়া এবং দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কিত নীতিমালা সংশোধন বা হালনাগাদ করা হবে। পাশাপাশি আমানতকারী ও শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগের বিদ্যমান নীতিমালা পরিবর্তন করে নতুন নীতিমালা করা হবে।

দেশের ব্যাংকিং খাতে সুশাসান নিশ্চিত করতে দক্ষ প্রধান নির্বাহীর বিকল্প নেই। দক্ষ ও যোগ্য এমডি বা প্রধান নির্বাহী নিয়োগের জন্য তাদের অতিত কার্য সম্পাদন সূচক মূল্যায়ন করা হবে। এজন্য এমডি নিয়োগ ও বাছাই প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। আগামীতে তা কঠোরভাবে বাস্তবায়নের জন্য নির্দেশনা থাকবে। করপোরেট সুশাসন নিশ্চিত করতে ও খেলাপি ঋণের হার কমাতে একক গ্রাহক ঋণসীমা কোনো ক্রমেই অতিক্রম না করার বিশেষ নির্দেশনা থাকবে। পরিচালনা বোর্ড শক্তিশালী করা, ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি দূর করা ও প্রশাসনিক ব্যয় কমে আনার জন্য আগামী দুই বছরে কয়েকটি দুর্বল ব্যাংক সবল ব্যাংকের সাথে একীভূত করা হবে। তবে দুর্বল ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তিন বছরের আগে ছাঁটাই করা যাবে না এমন শর্ত থাকবে। এজন্য ব্যাংক একীভূত নীতিমালা জারি করা হবে।

খেলাপি ঋণ কমানোর জন্য বলা হয়েছে, তফসিলি ব্যাংকের কোনো ঋণ দুই বছর মন্দ বা ক্ষতিজনক মানে শ্রেণিকৃত থাকলে তা অবলোপন (রাইট অব) করা যাবে। তবে সেসব ঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ প্রভিশন রাখতে হবে। বর্তমানে তিন বছর মন্দ বা ক্ষতিজনিত মানে শ্রেণিকৃত থাকলে ঋণ অবলোপন করার সুযোগ রয়েছে। এর ফলে খেলাপির পরিমাণ ৪৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা বা ২ দশমিক ৭৬ শতাংশ কমবে বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অবলোপন করা ঋণ আদায়ের জন্য দেশের প্রত্যেকটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা প্রধান নির্বাহীর সরাসরি তত্ত্বাবধানে ‘অবলোপনকৃত ঋণ আদায় ইউনিট’ নামে একটি পৃথক ইউনিট গঠন করা হবে। মন্দ ঋণ ও রাইট অব করা সম্পদ বিক্রির জন্য বেসরকারি খাতে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির প্রতিষ্ঠায় আইন প্রণয়ন করা হবে। এই আইনটি খসড়া করা হয়েছে, যা অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। এই আইনের ফলে ব্যাংকগুলো তাদের ব্যালেন্স শিট পরিষ্কার করতে পারবে এবং প্রাপ্ত অর্থ ব্যাংকের আয় খাতে দেখাতে পারবে। মন্দ, অবলোপন, পুনর্গঠন করা ঋণ বা স্টিজ অ্যাসেটের বিপরীতে আরোপিত প্রকৃত সুদ আদায় না করে আয় খাতে দেখানো যাবে না। স্টিজ অ্যাসেট আদায় বা নিয়মিত না হওয়া পর্যন্ত ব্যালেন্স শিটে দেখাতে পারবে না। কারণ এই অ্যাসেট ভবিষ্যতে খেলাপি ঋণে পরিণত হতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু ফরাহ মো: নাসের এ বিষয়ে গতকাল সংবাদিকদের বলেন, ব্যাংকিং খাতে ২০২৬ সালে ৩০ জুনের মধ্যে খেলাপি ঋণের হার সার্বিক ৮ শতাংশের পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার যথাক্রমে ১০ ও ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে চায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ ছাড়া ব্যাংকিং খাতে করপোরেট সুশাসন নিশ্চিত করার মাধ্যমে সীমাতিরিক্ত, বেনামি স্বার্থ সংশ্লিষ্ট এবং জালিয়াতি, প্রতারণার মাধ্যমে ঋণ বিতরণের পরিমাণ শূন্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে ১১ দফা রোডম্যাপ করা হয়েছে। ডেপুটি গভর্নর বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপিদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে। কোনো গ্রাহক ঋণ নিয়মিত পরিশোধ না করলে তাকে ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করবে। এই খেলাপিদের সমাজে অনেক সুবিধা থেকে বঞ্চিত করার সুযোগ সৃষ্টি হবে। আগামীতে খেলাপিরা জমি কিনতে গেলে রেজিস্ট্রশন করতে পারবে না। নতুন প্রতিষ্ঠান কিংবা কোম্পানি চালু কিংবা ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে পারবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক চিঠি দেবে যেন তাদের কোনো সহযোগিতা না করে। গাড়ি-বাড়ি কিনতে পারবে না। এমন অবস্থায় পড়তে কোনো ব্যবসায়ী চাইবে না। তাই তারা ঋণ নিয়মিত পরিশোধ করবে। বেনামে ঋণ কত জানতে চাইলে ডেপুটি গভর্নর বলেন, বেনামে ঋণ চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। তাই কত আছে এর সঠিক তথ্য নেই। পত্র-পত্রিকায় বেনামে ঋণের তথ্য আসছে। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে যেহেতু লেখা হচ্ছে কিছু না কিছু আছে, এটি চিহ্নিত করা হবে। তিনি বলেন, ব্যাংকিং আইন বজায় রেখে ও গত তিন বছরের শ্রেণিকৃত ঋণের তথ্য পর্যালোচনা করে ১১ দফার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এটি বাস্তবায়ন করতে পরলে খেলাপি ঋণ কমে আসবে বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *