সমঝোতা না হলে নির্বাচন পর্যন্ত হরতাল-অবরোধ চালিয়ে যাবে বিএনপি। জানা গেছে, প্রাথমিকভাবে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত কর্মসূচি অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। আন্দোলন পরিচালনার সাথে যুক্ত নেতাদেরও ইতোমধ্যে এ নির্দেশনা দিয়েছে হাইকমান্ড। নির্দেশনা বাস্তবায়নে নেতাকর্মীদের যথাসম্ভব গ্রেফতার এড়িয়ে রাজপথে থাকার কথা বলা হয়েছে। দলটির শীর্ষ নেতাদের আশা, আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি পাল্টে যেতে পারে।
বিএনপির কয়েকজন দায়িত্বশীল নেতা জানিয়েছেন, তাদের প্রত্যাশা- চলমান কর্মসূচি আগামী দুই সপ্তাহ টেনে নিয়ে গেলে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে পারে। কারণ আসন্ন জাতীয় নির্বাচন গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক করতে পশ্চিমা বিশ্বের চাপ আরো বাড়তে পারে।
‘একতরফা’ তফসিলের প্রতিবাদ এবং সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের একদফা দাবিতে কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে রয়েছে বিএনপি। টানা দুই দিন হরতালের পর আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় গতকাল সোমবার নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। কর্মসূচি অনুযায়ী, আগামীকাল বুধবার (২২ নভেম্বর) সকাল ৬টা থেকে শুক্রবার (২৪ নভেম্বর) সকাল ৬টা পর্যন্ত দেশব্যাপী ৪৮ ঘণ্টার সর্বাত্মক অবরোধ পালন করবে বিএনপি। গতকাল বিকেলে এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী নতুন এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন। যুগপৎভাবে এই কর্মসূচি পালিত হবে।
আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় গত রোববার থেকে সারা দেশে ৪৮ ঘণ্টা হরতালের কর্মসূচি পালন করেছে বিএনপি ও যুগপতের শরিকরা, যা আজ মঙ্গলবার সকাল ৬টায় শেষ হয়েছে। এর আগে গত ২৯ অক্টোবর থেকে দেশব্যাপী পাঁচ ধাপে ১১ দিন অবরোধ এবং এক দিনের হরতাল পালন করে বিএনপি ও মিত্ররা।
দাবি আদায়ে বিএনপির চলমান কর্মসূচি পালনের ধরন নিয়ে সমর্থকদের মধ্যে কিছুটা আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসা, ঢাকায় মহাসমাবেশের আগে প্রায় এক বছর ধরে ঢাকাসহ সারা দেশে হাজার হাজার এমনকি লক্ষাধিক নেতাকর্মী নিয়ে সফলভাবে সমাবেশসহ কর্মসূচি পালিত হয়েছে। গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশ ঘিরে সংঘর্ষের ঘটনায় গ্রেফতার অভিযান চললেও সব নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়নি। তাহলে বাইরে থাকা নেতাকর্মীরা কেন রাজপথে নেমে শক্তভাবে কর্মসূচি পালন করতে পারছে না, কেন ঝটিকা মিছিলে কর্মসূচি পালন করতে হচ্ছে। তবে বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, গত ২৮ অক্টোবরের পরে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। মহাসমাবেশ ঘিরে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নেতাকর্মীদের গ্রেফতার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্র্যাকডাউন চলছে। পুরো বিষয়টি মাথায় রেখেই কর্মসূচি চালিয়ে যেতে হচ্ছে। কর্মসূচি বাস্তবায়নের ধরনও সে অনুযায়ী নির্ধারণ করতে হচ্ছে।
নেতারা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চলমান অভিযানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন চৌধুরী, ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর, শামসুজ্জামান দুদু, যুগ্ম মহাসচিব মজিবুর রহমান সরোয়ার, খায়রুল কবির খোকন, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্সসহ দলটির প্রথম সারির বেশির ভাগ নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আন্দোলন কৌশলের অংশ হিসেবে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিকভাবে দলের দ্বিতীয় সারির নেতাদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। কৌশল অনুযায়ী, কেউ গ্রেফতার হলেই তার পরের জন দায়িত্ব গ্রহণ করে নেতাকর্মীদের সংগঠিত করে কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে আন্দোলন অব্যাহত রাখবেন। বিএনপির জেলাপর্যায়ে ইতোমধ্যে অনেক সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক গ্রেফতার হয়েছেন। সেখানে বিকল্প নেতৃত্বের মাধ্যমে আন্দোলন চলছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দলীয় কৌশলের অংশ হিসেবে কর্মসূচি বাস্তবায়নে নেতাকর্মীদের একযোগে মাঠে না নামার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। দলটি মনে করছে, সবাই একত্রে রাজপথে নামলে সেখানে পুলিশের পদক্ষেপ নেয়ার সুযোগ তৈরি হয়। তা ছাড়া দলের প্রত্যাশা অনুযায়ী, আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তন না হলে আন্দোলন নির্বাচন পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতে হতে পারে। তাই নেতাকর্মীদের গ্রেফতার এড়িয়ে কর্মসূচি পালন করতে বলা হয়েছে।
জানা গেছে, কর্মসূচি এখন পর্যন্ত যেভাবে পালিত হচ্ছে তাতে বিএনপির হাইকমান্ড সন্তুষ্ট। চলমান আন্দোলন আরো দুই সপ্তাহ টেনে নিতে পারলে কী ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে সেটা স্পষ্ট না করলেও বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা ধারণা দিয়েছেন, এই সময়ের মধ্যে ঘোষিত তফসিল পেছানো হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশে^র অব্যাহত চাপে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করতে কোনো সমঝোতামূলক পরিস্থিতির তৈরি হতে পারে। কারণ রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়াই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হওয়ায় সমঝোতামূলক পরিস্থিতি তৈরি এবং নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক করতে সামনে সরকারের ওপর বিদেশীদের চাপ আরো বাড়তে পারে, যা ক্ষমতাসীনদের পক্ষে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নাও হতে পারে।
বিএনপির হাইকমান্ডের সাথে নিয়মিত যোগাযোগে থাকা দলটির একজন দায়িত্বশীল নেতা জানান, হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে নেতাকর্মীদের হতাশ না হয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। আরো বলা হয়েছে, আন্দোলন অব্যাহত রাখতে পারলে আগামী ৫ ডিসেম্বরের মধ্যে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে পারে। তবে প্রয়োজনে চলমান আন্দোলন নির্বাচন পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতে হতে পারে। সেক্ষেত্রে ২০১৪ সালের মতো আসন্ন জাতীয় নির্বাচনও বয়কট করে ভোট প্রতিহত করতে লাগাতার আন্দোলনে নামতে পারে বিএনপি ও শরিকরা।
এ দিকে গত ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশের পর থেকে বিএনপির পক্ষ থেকে শুধু দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী গণমাধ্যমে কথা বলছেন। এমন অবস্থায় সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরতে হাইকমান্ডকে দলের পক্ষ থেকে আরো কিছু নেতাকে দায়িত্ব দেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে শিগগির সেই উদ্যোগ নেয়া হবে বলে সূত্রে জানা গেছে।