বিএনপির ডাকা সর্বাত্মক অবরোধ এবং একে ঘিরে নানা সহিংস ঘটনার কারণে আতঙ্কে থাকেন বলে জানিয়েছেন স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা। তারা বলছেন, সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে এখন বাড়তি সতর্কতা নিচ্ছেন তারা।
রাজধানীর মুগদা এলাকার একটি স্কুলের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা এক অভিভাবক জানান, স্কুল থেকে তার বাসা কাছেই। আগে সন্তানকে স্কুলে দিয়ে বাসায় চলে যেতেন তিনি। কিন্তু অবরোধের কারণে সন্তানকে স্কুলে দিয়ে ছুটি না হওয়া পর্যন্ত বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি।
ওই অভিভাবক বলেন, ‘যদি কিছু ঘটে তাহলে তো ওরা কিছু করতে পারবে না, আমার বাসা থেকে আসতেও সময় লাগবে। যদি কিছু ঘটে যায়, সেই ভয়ে স্কুলের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকি। বাসায় আর যাই না।’
স্কুলটির বাইরে থাকা আরেক অভিভাবক জানান, এর আগে তার সন্তানকে তার স্ত্রী স্কুলে পৌঁছে দেয়া এবং তাদের আবার নিয়ে যাওয়ার কাজটি করতেন।
তবে অবরোধের কারণে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির আশঙ্কায় এখন আর স্ত্রীকে সন্তানদের পৌঁছে দিতে দেন না। বরং নিজেরই সন্তানদের নিয়ে স্কুলে যান এবং তাদের ছুটি না হওয়া পর্যন্ত স্কুলের বাইরে অপেক্ষা করেন।
তিনি বলেন, ‘ওর মা আসলে, যদি কিছু ঘটে তাহলে তো সামলাতে পারবে না। তাই আমিই আসি এখন।’
নভেম্বর মাস হওয়ার কারণে স্কুলগুলোতে বার্ষিক সমাপনী পরীক্ষা চলছে। তাই অবরোধ হলেও স্কুলে যেতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের।
যানবাহন চলাচলের যে চিত্র দেখা যাচ্ছে
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন এবং সরকার পতনের দাবিতে বিএনপির ডাকা চতুর্থ দফা সর্বাত্মক অবরোধের দ্বিতীয় দিন চলছে। এদিন রাজধানীতে যান চলাচল অনেকটা স্বাভাবিক দেখা গেছে।
গতকালের তুলনায় আজ রাস্তায় যান চলাচল অনেক বেশি দেখা গেছে। কিছু কিছু এলাকায় হালকা যানজটও চোখে পড়েছে।
রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে ট্রাফিক সিগনালগুলোতে হালকা যানজটও দেখা গেছে।
বিশেষ করে মালিবাগ মোড়, আবুল হোটেল মোড়, কমলাপুরে গাড়ির চাপ বেশি ছিল। এসব মোড়গুলোতে সিগনালে পরিবহনগুলোকে দাঁড়িয়ে থাকতেও দেখা গেছে।
গণপরিবহনের সাথে সাথে রাস্তায় ব্যক্তিগত গাড়ির চলাচলও গতকালের তুলনায় বেশ বেড়েছে।
সোমবার অফিসগামী এবং স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের রাস্তায় বেশ চাপ চোখে পড়েছে। গতকালের তুলনায় আজ মানুষের চলাচল আরো বেড়েছে।
ঢাকার বাইরের কয়েকটি জেলা থেকে বেশ কিছু যানবাহন সকালে রাজধানীতে প্রবেশ করেছে। তবে অবরোধের কারণে এসব পরিবহন সংখ্যায় বেশ কম ছিল। পরিবহনগুলোতে যাত্রী সংখ্যাও কম দেখা গেছে।
রাজধানীর সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল ঘুরে দেখা যায়, সকাল ৯টা পর্যন্ত এই টার্মিনালটি থেকে ১০টার বেশি গাড়ি ঢাকা ছেড়ে গেছে।
গতকাল সকালে মাত্র তিনটি গাড়ি ছেড়ে গিয়েছিল বলে জানায় টার্মিনালে বিভিন্ন বাস কোম্পানির অপারেটররা।
তারা বলছেন, দক্ষিণবঙ্গের বরিশাল ও খুলনা রুটে এসব পরিবহন ছেড়ে গেছে। তবে সকাল থেকে বেশ কয়েকটি বাস ছেড়ে গেলেও সেগুলোতে যাত্রী সংখ্যা খুব বেশি ছিল না।
একজন বাস অপারেটরের সাথে কথা বলে জানা যায়, সকাল সাড়ে ৯টা পর্যন্ত দু’টি বাস ছেড়েছে তার কোম্পানির। এর মধ্যে একটি বাসে পাঁচজন এবং আরেকটি বাসে ছয়জন যাত্রী ছিল।
ওই অপারেটর জানান, যাত্রী কম থাকলেও ‘নেতাদের চাপে’ বাস ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন তারা।
আর অবরোধের মধ্যেও ঢাকাসহ সারাদেশে সব রুটে বাস-মিনিবাসসহ সব ধরণের গণপরিবহন চালু রাখার ঘোষণা দিয়েছে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি।
অবরোধের সময় ঢাকার সদরঘাট এলাকা থেকে কিছুটা লঞ্চ চলাচল করছে। তবে স্বাভাবিক দিনের তুলনায় কম সংখ্যক লঞ্চ ছাড়ছে। তবে স্বাভাবিকের তুলনায় যাত্রী সংখ্যাও কম ছিল বলে জানা যাচ্ছে।
কমলাপুর ঘুরে দেখা গেছে, রাজধানী ঢাকা থেকে দেশের বিভিন্ন জেলার সাথে রেল চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে।
অবরোধে গতকালের মতো আজও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ঢাকা শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে অবস্থান নিতে দেখা গেছে। গতকালকের মতো আজও তারা অবরোধ বিরোধী অবস্থান কর্মসূচি এবং শান্তি সমাবেশ চালিয়ে যাবে বলে জানা যায়।
রোববারও অবরোধ বিরোধী শান্তি সমাবেশ করেছে আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
অবরোধ শুরুর আগের দিন শনিবার এক সংবাদ পুলিশ জানিয়েছে, অবরোধ চলার সময়ে সারাদেশের সার্বিক নিরাপত্তা জোরদার করা হবে। নাশকতা রোধে গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানোর কথাও জানানো হয়েছে।
এদিকে র্যাব জানিয়েছে, গাড়িতে আগুন দেয়ার সময় আব্দুল্লাহপুর এলাকায় একজন ‘নাশকতাকারীকে’ গ্রেফতার করা হয়েছে।
পরিবহনে আবারো আগুন
অবরোধের সময় গতকালকের মতো রোববার রাতে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটেছে।
ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, গত রাতে রাজধানীর অন্তত তিনটি স্থানে বাস ও কাভার্ডভ্যানে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে।
সংস্থাটির নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে জানা যায়, গত রাত আনুমানিক পৌনে ৩টার দিকে সায়েদাবাদ এলাকায় বলাকা পরিবহনের একটি বাসে আগুন দেয়া হয়। পরে ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
রাজধানীর মিরপুর-৬ নম্বর এলাকায় ইতিহাস পরিবহনের একটি বাসে আগুন দেয়া হয়। ভোর সাড়ে ৫টার দিকে আগুন লাগার এই ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এতে প্রায় আড়াই লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানানো হয়।
এছাড়া মুগদা বিশ্বরোড সবুজবাগ এলাকায় রাত ১টার দিকে একটি কাভার্ডভ্যানে আগুন দেয়া হয়। ফায়ার সার্ভিস খবর পেলেও ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর আগে স্থানীয় জনতাই আগুন নিভিয়ে ফেলে। এতে দুই লাখ টাকার মতো ক্ষয়ক্ষতির কথা জানায় ফায়ার সার্ভিস।
এছাড়া নোয়াখালীর সোনাইমুড়িতে প্রিতমপুর বাজারে ২০টি দোকানে আগুন লাগার খবর পাওয়া গেছে। রাত আনুমানিক দেড়টার দিকে দোকানগুলোতে আগুন লাগে বলে জানায় ফায়ার সার্ভিস। খবর পেয়ে পরে ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। তবে এতে কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সেটি সম্পর্কে এখনো কিছু জানা যায়নি।
দোকানে আগুন লাগার ঘটনাটি অবরোধের সাথে সম্পর্কিত কিনা তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
রোববার ভোর থেকে বিএনপির ডাকা চতুর্থ দফার অবরোধ শুরু হয়। ৪৮ ঘণ্টার এই অবরোধ চলবে মঙ্গলবার ভোর ৬টা পর্যন্ত।
গত ২৮৬ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর থেকে ধারাবাহিকভাবে হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচি দিয়ে আসছে বিএনপি।
ওই সমাবেশের পরদিন ২৯ অক্টোবর হরতাল পালন করে বিএনপি, তাতে জামায়াতে ইসলামীসহ সমমনা দলগুলো সমর্থন দিয়েছিল।
এরপর ৩১ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর এবং ৫ ও ৬ নভেম্বর আরো দুই দফা সড়ক-রেল-নৌপথে সর্বাত্মক অবরোধ বিএনপি। ওই কর্মসূচির পরে ৮ ও ৯ নভেম্বর তৃতীয় দফা ৪৮ ঘণ্টার সর্বাত্মক অবরোধ করে বিএনপি এবং সমমনা দলগুলো।
সর্বশেষ রোববার সকাল ছয়টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৬টা পর্যন্ত তারা চতুর্থ দফার অবরোধ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছে।
এই দফা কর্মসূচি শেষে আবার নতুন কর্মসূচি দেয়া হবে বলে দলের নেতারা জানিয়েছেন।
সূত্র : বিবিসি